শিক্ষার সঙ্গে কর্মের সমন্বয় হোক

জান্নাতুল যূথী প্রকাশিত: জুন ১০, ২০২২, ০৯:২৫ এএম

শিক্ষায় শক্তি, শিক্ষায় মুক্তি। মুক্তি দুই অর্থে। প্রথমত, বিবেকসম্পন্ন মানুষ হিসেবে মুক্তি। দ্বিতীয়ত, শিক্ষা গ্রহণের ফলে সঠিক কর্মের মাধ্যমে মুক্তি। বর্তমানে শিক্ষার প্রকৃত অর্থে এই দুই ধরনের মুক্তি খুব একটা চোখে পড়ছে না। দেশে বর্তমানে শিক্ষার হার বেড়েছে। কিন্তু সুশিক্ষায় শিক্ষিতের হার কতটা, তা প্রশ্নবিদ্ধ!

আজকাল শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্যের প্রতি কারওই মনোযোগ নেই। বরং সবাই কর্মের পেছনে ছুটছে। কারণ, একটা সার্টিফিকেট কিছু রুটি-রুজির ব্যবস্থা করে দিতে সক্ষম। তাই শিক্ষা গ্রহণের ফলে ব্যক্তির আত্মিক উন্নতি কতটা হলো, অজ্ঞতা ও গোঁড়ামি কতটা দূর হলো, সে বিষয়ে সবাই উদাসীন। শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য তো ব্যাহত হচ্ছেই, সেটা সমাজের দিকে দৃষ্টি দিলেই বোধগম্য হবে সহজেই।

বর্তমানে সমাজে বেড়েছে দুর্নীতি, ধর্ষণ, হত্যা, পরস্পরের সঙ্গে রেষারেষি, দ্বন্দ্ব-সংঘাত; সেই সঙ্গে মানবিকতার চরম অবক্ষয়। বৃদ্ধদের কাছে শোনা যায়, আগের দিনে কেউ ম্যাট্রিক পাস করলে দূর গ্রাম থেকে শত শত লোক তাকে দেখতে যেত। সবাই শিক্ষার কদর করত, শ্রদ্ধা করত। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে সে প্রথার বিলোপ ঘটেছে।

এটাই স্বাভাবিক যে, সময়ের সঙ্গে জীবনযাপন, শিক্ষা, রুচির পরিবর্তন ঘটবে। কিন্তু পরিবর্তন যদি সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, তবে সেটা নিয়ে ভেবে দেখা দরকার। শিক্ষা শুধু সার্টিফিকেটসর্বস্ব না হয়ে যেন তা ফলপ্রসূ হয়। শিক্ষার মাধ্যমে মনের কালিমা, অজ্ঞানতা দূর হয়। মানবিকতা ও বিবেক দ্বারা পরিচালিত হয় সবাই। তবেই শিক্ষায় শক্তি ও মুক্তি মেলা অসম্ভব হবে না।

এ তো গেল শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে কিছু কথা। কিন্তু শিক্ষার সঙ্গে আরও একটি বিষয় বিশেষভাবে জড়িত—শিক্ষা ও কর্ম। বর্তমানে শিক্ষার সঙ্গে কর্মের কতটা সমন্বয় হচ্ছে। দেশে এখন শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা কত, তা পরিসংখ্যান ঘাঁটলে সহজেই বোঝা যাবে। একই সঙ্গে শিক্ষা ও কর্মের সমন্বয় হওয়া কতটা জরুরি, তা-ও দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দেখলে বোঝা যাবে।

বর্তমানে শিক্ষার হার বেড়ে যাওয়ায় দেশে কর্মসংস্থানের অভাব দেখা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষিত মানুষের কাছে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করার একমাত্র উপায় চাকরি। সেই চাকরি আবার সরকারি চাকরি। ফলে সবার আশা যেমন বেড়ে চলেছে, তেমনি পছন্দমতো ও যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি না পেয়ে হতাশাও বেড়ে চলেছে।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও কর্মের মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক। আজকাল বাংলাদেশের পেশা বলতে জনগণ বোঝে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে সরকারি চাকরি। গ্রামের ছেলে থেকে বৃদ্ধ; সবার মুখেই একই বিষয় ঘুরেফিরে। কিন্তু শিক্ষিত বেকারের তুলনায় বিসিএসে পদসংখ্যা খালি থাকে হাতেগোনা। ফলে শিক্ষিত বেকারেরা চাকরি হিসেবে বিসিএসের পেছনে ছুটতে গিয়ে হতাশায় ভুগছে। অনেকে হতাশা কাটিয়ে না উঠতে পেরে নাশকতামূলক ঘটনা ঘটাচ্ছে। বর্তমানের পত্রপত্রিকা ঘাটলে দেখা যাবে, বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগই হতাশায় দিন যাপন করে। কারণ একটাই। পড়াশোনা শেষ করে তার জীবিকা নির্বাহের পথ কী হবে। বাবা-মা পড়া শেষ হওয়ার আগেই পাশের বাড়ির কারও উদাহরণ টেনে জানিয়ে দেন, তাকেও এ ধরনের চাকরি পেয়ে তাদের মুখ উজ্জ্বল করতে হবে। এদিকে শিক্ষার্থীরা দিনের পর দিন হাড়ভাঙা খাটুনি খেটেও সন্তোষজনক চাকরি পেতে ব্যর্থ হচ্ছে।

বিগত বছরের পরিসংখ্যান দেখলে সহজেই বোঝা যায়, এখন শিক্ষার সঙ্গে কর্মের সমন্বয় কত জরুরি। যেহেতু সামাজিক সম্মান, ঝুঁকিমুক্ত চাকরি, ক্ষমতার প্রাচুর্য, বেতন কাঠামো অপেক্ষাকৃত বেশি; সব মিলিয়ে শিক্ষিত চাকরিপ্রার্থী সবাই একদিকেই ঝুঁকছে। একের ভেতর সব ব্যাপারটা ঠিক বিসিএসের ক্ষেত্রে খাটে। এ কারণেই ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেও বেশির ভাগ চাকরিপ্রার্থীই বিসিএসকে প্রাধান্য দিচ্ছে। ফলে জাতির জন্য উভয় দিক সংকটাপন্ন হয়ে উঠছে।

সাধারণ ক্যাটাগরির একজন শিক্ষার্থী বুয়েট, রুয়েট, চুয়েট, ঢাকা মেডিকেল, রাজশাহী মেডিকেলের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা একজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় গেলে সেখানে পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। সেটা ঘটছেও। এখন প্রশ্ন উঠছে, যিনি ডাক্তারি পাস করে প্রশাসনে আসছেন, তার ডাক্তারি কী অর্থে কাজে লাগছে। আবার যিনি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে পুলিশে যাচ্ছেন, তিনিই বা কতটা সংযোগ ঘটাচ্ছেন শিক্ষার। এসব জিজ্ঞাসার উত্তর প্রায়ই ‘না’ হতে বাধ্য। ফলে শিক্ষার সঙ্গে কর্মের কোনো যোগসাজশই নেই। এক্ষেত্রে জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে সর্বত্র। তাই শিক্ষার সঙ্গে কর্মের সমন্বয় করাটা আজ সময়ের দাবি।

শিক্ষা ও কর্মের সমন্বয় যুগের দাবি। শিক্ষার্থীদের সুযোগ্য নাগরিক করে তোলার দায়িত্ব যারা পালন করেন তার হলেন শিক্ষক। কিন্তু শিক্ষার সঙ্গে তাদের কর্মের সমন্বয় কতটা। একজন শিক্ষক দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হন। এরপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিযুক্ত হয়ে তাকে নিতে হয় বিভিন্ন ধরনের ট্রেনিংসহ উচ্চশিক্ষা। কিন্তু তাদের ভাগ্যে জোটে সবচেয়ে করুণ চিত্র। বাংলাদেশের নব্বই ভাগ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষকদের নামমাত্র মূল্যে পেশায় নিযুক্ত করা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে শিক্ষকদের মানসিক স্থিতি তলানিতে। ফলে শিক্ষিত হয়ে এই মহান পেশা বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে বেশির ভাগই নারাজি থাকেন। কিন্তু জাতির মেরুদণ্ড গঠনের একমাত্র পন্থা যেহেতু শিক্ষা, সেহেতু শিক্ষার সঙ্গে শিক্ষকের মূল্যায়নটাও সঠিক হওয়া জরুরি।

একটি কথা সমাজে আজও প্রচলিত আছে, লেখাপড়া করে যে গাড়িঘোড়ায় চড়ে সে, কিন্তু বর্তমান সমাজে লেখাপড়া শিখে বরং জটিলতায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে প্রকৃত শিক্ষার যেমন অভাব তেমনি শিক্ষার হার অনুযায়ী কর্মের অভাব। দুইয়ের সমন্বয় না হলে ভবিষ্যতে আরও জটিলতা বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে শিক্ষিতমহলের চেয়ে যারা ব্যবসা বা অনন্যা পেশাজীবী তারাই যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছেন। কারণ, জীবন-জীবিকার মান যত বেড়েছে, সে অনুযায়ী চাকরির মূল্যমান বৃদ্ধি পায়নি। ফলে শিক্ষায় ব্যক্তির গলার কাঁটা হয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় বলা প্রয়োজন, শিক্ষিত ব্যক্তিরা রুচি-মনের সঙ্গে মিল রেখে যেকোনো কাজে যুক্ত হতে পারে না। ফলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এখনই সময় শিক্ষাকে কর্ম উপযোগী করে তুলতে হবে। একজন ব্যক্তি সব বিষয়ে অভিজ্ঞ হয়ে কী করবেন। তাতে জটিলতা সৃষ্টি হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। লেখাপড়া তাই বিষয়ভিত্তিক হয়ে গেলে সবদিক রক্ষা হয়। শিক্ষার দ্বারা একজন মানুষ হয়ে ওঠেন জ্ঞানী, প্রাজ্ঞ, বিবেকসম্পন্ন। এ জন্য সঠিক শিক্ষার প্রয়োজন। শুধু গোগ্রাসে পুস্তক পড়ে উগরে দিলেই তা শিক্ষা নয়! বাস্তব ও জীবনঘনিষ্ঠ শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা। যার দ্বারা মানবজাতির মুক্তি সম্ভব। অন্যভাবে দেখলে শিক্ষা যে উদ্দেশ্যে গ্রহণ করা হয়, তার প্রকৃত কারণ কর্ম বা জীবিকার তাগিদে। কিন্তু সেখানেও প্রকৃত মুক্তি ব্যাহত হচ্ছে। শিক্ষা ও কর্মের সমন্বয় নাহলে মুক্তি সম্ভব নয়। তাই এখনই সময় শিক্ষাকে জীবনমুখী করে তুলতে হবে।

লেখক : গবেষক-শিক্ষক, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়