বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ঘাটতি না থাকলেও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বমুখী, ফলে খেটে খাওয়া মানুষসহ দুর্নীতির সুযোগহীন সাধারণ মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস, উন্নয়নের নানা ফিরিস্তি সত্ত্বেও কর্মহীন ও কর্মপ্রত্যাশী মানুষের দুর্বিষহ জীবন, করোনার আঘাত ও ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতসহ নানা অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে বাজেট ২০২২-২৩ আসছে। ৯ জুন সংসদে বাজেট উত্থাপন করা হবে।
বাজেটকে যদি এক বছরের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বলা হয়, তাহলে তা নিয়ে সমালোচনা তো হবেই। জবাবদিহিও থাকতে হবে। আয় করার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল, তার কতটুকু অর্জিত হয়েছে, কোন খাতে কত বরাদ্দ, কেন বরাদ্দ আর এক বছরে তার কতটুকু ব্যয় করা সম্ভব হলো এবং তার ফলে সাফল্য কতটুকু অর্জিত হলো, তা নিয়ে বিশ্লেষণ না হলে গত অর্থবছর থেকে শিক্ষা নেওয়া হবে না।
বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়া গণতান্ত্রিক করার অংশ হিসেবে সমাজের নানা অংশের মানুষের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করার কথা বলা হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও ব্যবসায়ী মহল এবং পছন্দসই ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করেই দায়িত্ব শেষ করা হয়। দেশের প্রধান খাত কৃষি কিন্তু কৃষক প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করার কোনো প্রয়োজনই বোধ করে না, ৬ কোটি ৮২ লাখ শ্রম শক্তি, কিন্তু শ্রমিক প্রতিনিধিদের কথা শোনা হয় না, ৪ কোটির বেশি শিক্ষার্থী; কিন্তু তাদের সমস্যা বা প্রয়োজন নিয়ে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট মহল যেমন ছাত্র প্রতিনিধি, শিক্ষক প্রতিনিধি কাউকেই কিছু জিজ্ঞেস পর্যন্ত করা হয় না। বলা হয় কৃষকবান্ধব, শ্রমিকবান্ধব এবং শিক্ষানুরাগী সরকার কিন্তু কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র কোনো স্তরের প্রতিনিধিরাই বাজেট প্রণয়নের আগে মতামত দেওয়ার সুযোগ পান না। শুধু বিভিন্ন ধরনের আর বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরাই বাজেট প্রণয়নের আগে আলোচনার অধিকার পান। যেমন কাজ তার ফলাফলটাও তেমনি হয়। বাজেট প্রণয়ন করে সরকার, আর সুবিধা পায় ব্যবসায়ী মহল, দায় বহন করে সারা দেশের জনগণ।
স্বাধীনতার পর দেশের জিডিপি বেড়েছে ৬ বিলিয়ন ডলার থেকে ৪১১ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ৬৮ গুণ বেশি। মানুষের মাথাপিছু আয় ১২৯ ডলার থেকে ২ হাজার ৮২৪ ডলার হয়েছে অর্থাৎ আয় বেড়েছে প্রায় ২২ গুণ। বাজেট বেড়েছে ৭৮৬ কোটি টাকা থেকে (এবারের সম্ভাব্য বাজেট) ৬ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা অর্থাৎ বাজেট বাড়ছে ৮৫২ গুণ। এই সব হিসাব সবই উন্নতির সূচক এবং অগ্রগতির দিক নির্দেশ করে। কিন্তু জিডিপি বৃদ্ধিতে কার অবদান কত এবং প্রাপ্তি কত, মাথাপিছু আয় কারা বাড়াল এবং কাদের পেছনে ফেলে কারা সেই আয় পকেটে পুরল, বাজেট যত গুণ আকারে বাড়ল, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি খাতে সে অনুযায়ী কতটুকু বরাদ্দ বাড়ল, তা দেখলে আশাবাদের বিপরীতে বেদনা ও বিক্ষোভ জমে ওঠে।
স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিবছরই বাজেটের আকার বৃদ্ধি পেলেও আনুপাতিক হারে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষির মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে বরাদ্দ দিন দিন কমছেই। বলা হয়ে থাকে কৃষি হচ্ছে বর্তমানের নিরাপত্তা আর শিক্ষা চিকিৎসা হচ্ছে ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা। কোনো দেশের অর্থনীতি এবং উন্নয়নকে যদি স্থায়ী রূপ দিতে হয়, তাহলে কৃষিকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো দরকার। আর ভবিষ্যতের মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হলে মানসম্পন্ন শিক্ষা আর আধুনিক চিকিৎসার কোনো বিকল্প নেই।
দেশের অর্থনীতিতে জিডিপির ১৪ শতাংশ হলেও কর্মসংস্থানের ৪০ শতাংশ অবদান কৃষি খাতের। খাদ্য নিরাপত্তা যেকোনো দেশের প্রধান উদ্বেগের বিষয়। সে কারণেই কৃষি খাত সবচেয়ে বেশি মনোযোগ পাওয়ার দাবি রাখে।
শিক্ষা খাতে যা বরাদ্দ হয়, তার মধ্যে আবার রয়েছে নানা ধরনের ফাঁকফোকর। শিক্ষা খাতের সঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, তথ্য ও যোগাযোগ খাত যুক্ত করে বরাদ্দের পরিমাণ ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হয়। করোনা মহামারি সবচেয়ে বেশি আঘাত হেনেছে শিক্ষাব্যবস্থায়। এক জরিপে দেখা যাচ্ছে ৩৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে এবং ১৬ শতাংশ আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরতে পারবে না। করোনার আঘাত আর অনলাইন ক্লাস-পরীক্ষার উদ্যোগ শিক্ষাক্ষেত্রে শহর-গ্রাম, ধনী-গরিব বৈষম্য আরও প্রকট করেছে। বাজেটে এই বৈষম্য দূর করা ও করোনায় ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য বিশেষ বরাদ্দ থাকা দরকার।
করোনা দেখিয়ে দিয়েছে স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্বলতা আর দুর্নীতি। এত আলোচনার পরও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ৫ শতাংশের বেশি হচ্ছেই না। দুর্নীতি কমছে না, বরাদ্দও বাড়ছে না। দ্বিমুখী সংকটে স্বাস্থ্য খাত। বরাদ্দ বৃদ্ধি আর দুর্নীতির ছিদ্র বন্ধে কী থাকবে এবারের বাজেটে? শ্রমজীবীদের হাসপাতাল ও ওষুধে বরাদ্দ থাকবে কি?
প্রতিবছর ২২ লাখ যুবশক্তি আসে দেশের শ্রমবাজারে। তাদের কর্মসংস্থানের দিকনির্দেশনা থাকতে হবে বাজেটে। কালোটাকার মালিকেরা খুবলে খাচ্ছে অর্থনীতি, পাচার করছে টাকা, কলুষিত করছে রাজনীতি আর ধ্বংস করছে সমাজের নৈতিক ভিত্তি। এদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। কালোটাকা সাদা করার অনৈতিক কাজ আর প্রশ্রয় পাবে না বাজেটে। যাদের আয় যত বেশি, তাদের ট্যাক্স তত বেশি, এই নীতিকে দেখতে চাই আমরা বাজেটে।
যারা যৌবন ব্যয় করছেন সমাজের কাজে তারা কি বৃদ্ধ বয়সে পেনশন পাবেন না? দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি যাদের জীবনে নাভিশ্বাস তোলে, সেই শ্রমজীবীরা কি রেশন পাবে না? তাদের আবাসনের জন্য বরাদ্দ কি থাকবে না বাজেটে? কর্মজীবী নারীদের ডরমিটরি, শিশুদের জন্য শিশুযত্ন কেন্দ্র নির্মাণে বাজেটে বরাদ্দ দরকার।
শিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ, যুবাদের কাজের ব্যবস্থা, বৃদ্ধদের বাকি জীবনের নিশ্চয়তা না থাকলে জিডিপি বৃদ্ধি আর মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির পরিসংখ্যান দিয়ে তৈরি বাজেট জনজীবনে স্বস্তি আনবে না। তাই সাধারণ মানুষের স্বস্তির বাজেট দেখতে চাই।
লেখক: রাজনীতি বিশ্লেষক