মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ও এর অপপ্রয়োগ

প্রমা ইসরাত প্রকাশিত: আগস্ট ৮, ২০২১, ০৭:১১ পিএম

বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আইনের কিছু ফাঁক থাকে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ সংশোধন করা হয় ২০২০ সালে। এবং সে ক্ষেত্রে আইনটির নাম পরিবর্তন করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ (সংশোধন) আইন ২০২০ উল্লেখ করা হয়।    

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ-সম্পর্কিত এই আইনের মজার ব্যাপার হলো, ধারা ২১-এ বলা আছে প্রকাশ্য স্থান থেকে আটক বা গ্রেপ্তার করা যাবে যদি দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ‘বিশ্বাস’ করে থাকেন সেই জায়গায় মাদকদ্রব্যজনিত অপরাধ ঘটছে বা ঘটার সম্ভাবনা আছে।

ধারা ২৩-এ বলা আছে, ওয়ারেন্ট ছাড়া তল্লাশি ও গ্রেপ্তারের কথা। এইখানে যদি দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সন্দেহ করেন, তাহলে সন্দেহের বসেই তল্লাশি বা গ্রেপ্তার করা যাবে।

ধারা ৫৫-এ উল্লেখ আছে মাদকদ্রব্য অপরাধ সংঘটনে আইনানুগ অনুমানের (presumption) কথা। বলা আছে, যদি কোনো ব্যক্তির নিকট অথবা তাহার দখলকৃত বা নিয়ন্ত্রণাধীন কোনো স্থানে কোনো মাদকদ্রব্য সেবন, অন্য কোনোভাবে মাদকদ্রব্য ব্যবহার বা প্রয়োগ অথবা মাদকদ্রব্য প্রস্তুতে ব্যবহারযোগ্য সরঞ্জাম, যন্ত্রপাতি অথবা মাদকদ্রব্য প্রস্তুতের জন্য প্রয়োজনীয় বস্তু বা উপাদান পাওয়া যায়, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি, ভিন্নতর প্রমাণ করিতে ব্যর্থ হইলে, এই আইন লঙ্ঘন করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে।’’

মূলত পুরো আইনটার ভিত্তিই হচ্ছে অনুমান, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার ‘বিশ্বাস’ এবং ‘সন্দেহ’। এসবের ওপর ভিত্তি করেই একজন মানুষকে কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়া আটক বা গ্রেপ্তার করা সম্ভব। যেটা এই আইনের একটি দুর্বল দিক। কারণ এতে সবচেয়ে সহজ হয়ে যায় আইনটির অপপ্রয়োগ করা।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী অপরাধগুলো আমলযোগ্য এবং জামিন পাওয়া কঠিন।

মানে খুব সহজ হিসাব মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ (সংশোধন) আইন ২০২০ একটি কঠিন আইন, যেখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার একটা বড় ভূমিকা আছে। ভূমিকা হচ্ছে তার ‘অনুমান’, ‘বিশ্বাস’ এবং তার ‘সন্দেহ’। এখন টিভিতে এসে ‘রাতের রানি’ বলে আগে থেকেই এজিউম করে নেওয়া লোকদের মানসিকতা অনুযায়ী, সন্দেহ আর বিশ্বাস যদি বজায় থাকে, তাহলে গাঁজার নৌকা অবশ্যই পাহাড়তলি যাবে এবং আসার সময় কয়েক কার্টন মদ নিয়ে ফেরতও আসবে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮-এর ৪৪ এবং ৪৫ ধারা দুটি ছিল ট্রাইব্যুনাল স্থাপন ও বিচারকেন্দ্রিক ধারা।২০২০-এ সংশোধন করে, ৪৫ নং ধারাটি বিলুপ্ত করা হয়, এবং ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এবং ট্রাইব্যুনালের পরিবর্তে ‘এখতিয়ারসম্পন্ন আদালত’ শব্দটি স্থাপন করা হয়। অর্থাৎ ট্রাইব্যুনালের কনসেপ্টটি বাতিল করা হয়।

এই আইনের আরেকটি বড় ফাঁক হচ্ছে,  ধারা ৫০। ধারা ৫০-এ বলা আছে, বিচারাধীন মাদকদ্রব্য অপরাধের সহিত জড়িত অন্য অপরাধের বিচারের কথা।

এই আইনের অন্য কোনো বিধান অথবা অন্য কোনো আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, এখতিয়ারসম্পন্ন আদালতে বিচারাধীন কোনো মামলার মাদকদ্রব্য অপরাধের সহিত অন্য কোনো অপরাধ যদি এমনভাবে জড়িত থাকে যে, ন্যায়বিচারের স্বার্থে উক্ত অন্য অপরাধের বিচার বিচারাধীন মাদকদ্রব্য অপরাধের সহিত একই সঙ্গে হওয়া উচিত, তাহা হইলে উক্ত অন্য অপরাধটি বিচারাধীন মাদকদ্রব্য অপরাধের সহিত, যতদূর সম্ভব, এখতিয়ারসম্পন্ন আদালতে একই সঙ্গে বিচার্য হইবে।’’

অর্থাৎ ন্যায়বিচারের স্বার্থ দেখিয়ে অন্য কোনো অপরাধের বিচারও একই সাথে করা যাবে। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে যে ন্যায়বিচারের স্বার্থটা নির্ধারণ যারা করবে, আদতে তাদের মানসিকতা কতটুকু নিরপেক্ষ থাকবে? অর্থাৎ এ ক্ষেত্রেও অপপ্রয়োগ হওয়ার সুযোগ আছে। কীভাবে হবে অপপ্রয়োগ? কোন ব্যক্তিকে আটকের ধরনটা হালকা পালটে দিলেই হলো, যে বিষয়ে আটক করতে চাচ্ছে সেই বিষয়ে আটক না করে মাদক মামলায় আটক করে, পাশাপাশি ওই অপরাধের কথা উল্লেখ করে দিলেই, এই আইনের এই ধারা অনুযায়ী তা জাস্টিফায়েড হয়ে যায়।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ধারা ১১-তে অ্যালকোহল পানের ব্যাপারে বিধিনিষেধ আছে। প্রশ্ন ওঠে যে, রাষ্ট্র অ্যালকোহল পানের ক্ষেত্রে লাইসেন্স, পারমিটের ক্ষেত্রে বিধান দিতে পারে, কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনো ধর্মের মানুষ লাইসেন্স বা পারমিট পাবে কি পাবে না, এই ব্যাপারে কি রাষ্ট্র বিধান দিতে পারে? একজন ব্যক্তি তার ধর্ম কীভাবে পালন করবে, জীবনযাপন কীভাবে করবে, সেই ব্যপারে নাক গলানো কি রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে?

ধারা ২৩ নিয়ে আরও একটু বিস্তারিত বললে বলা যায়, যেকোনো ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা যদি বিশ্বাস করেন, সন্দেহ করেন বা অনুমান করেন যে মাদকদ্রব্য অপরাধ ঘটছে বা ঘটার সম্ভাবনা আছে, তাহলে যেকোনো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা তিনি নিতে পারেন, সে ক্ষেত্রে যেকোনো সময়, যেকোনো জায়গায় তিনি প্রবেশ করতে পারেন, বাধাপ্রাপ্ত হলে দরজা জানালা ভাঙতে পারেন।

যে দেশের একাধিকবার রেকর্ড আছে দুর্নীতিতে প্রথম হওয়ার, যে দেশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মানসিকতায় নারীবিদ্বেষ থাকে,  যে ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত মানুষকে মোরাল পুলিশিংয়ের শিকার হতে হয়, সে ক্ষেত্রে, যেকোনো নাগরিক যেকোনো সময় এই আইনের অপপ্রয়োগের ফলে ভুক্তভোগী হতে পারে, হয়রানির শিকার হতে পারে।

সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হতে পারে নারীরা। কেননা, এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে, পুরুষ মদ নিয়ে ধরা পড়লে তেমন কোনো অপরাধ হিসেবে দেখা হয় না, কিন্তু একজন নারী যদি অ্যালকোহলসহ ধরা পড়েন, তবে তার অপরাধ শুধু মাদকদ্রব্য অপরাধ হয় না, তাকে অপরাধী বানানো হয়—সমাজ নষ্টের জন্য, পুরুষকে প্রলোভন দেখানোর জন্য; তখন নারী হওয়াটাই তার অপরাধ হয়ে যায়।   

আইনটি  মাদকদ্রব্যের নিয়ন্ত্রণ, সরবরাহ ও চাহিদা হ্রাস, অপব্যবহার ও চোরাচালান প্রতিরোধ এবং মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য যুগোপযোগী করে আইন প্রণয়নের কথা ছিল, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে আলোচিত বিভিন্ন ঘটনায় দেখা যাচ্ছে আইনটি প্রয়োগ হচ্ছে অন্যভাবে। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে হবে। আইনের অপপ্রয়োগ বন্ধ করতে হবে।

 

লেখক: আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী