উপেক্ষিত ভোক্তা-সামর্থ্য, জয় তেল-সিন্ডিকেটের

কবির য়াহমদ প্রকাশিত: মে ৭, ২০২২, ০৪:৩১ পিএম

নিত্যপণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ‘স্যাবোটাজ’ চলে তেল নিয়ে। স্যাবোটাজ সরকারের সঙ্গে, ভোক্তাসাধারণের সঙ্গে। সরকারি দপ্তর নিয়ন্ত্রক সংস্থা হলেও, নিয়ন্ত্রক আদতে ‘মহাজন’ শ্রেণি। সংখ্যায় তারা হাতেগোনা হলে অসীম ক্ষমতার। তাদের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে, সরবরাহ করে আবার সময়ে-সময়ে তেল উধাও করে দিয়ে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে মূল্য বৃদ্ধিতে বাধ্য করে সরকারকে। এই মূল্যবৃদ্ধি প্রক্রিয়ায় সরকার নিয়ন্ত্রক হওয়ার কথা থাকলেও তারা মূলত মহাজনশ্রেণির স্বার্থই রক্ষা করে চলে, চলেছে। এতে ক্ষতির শিকার দেশের অন্তত চার কোটি পরিবার। চার কোটি পরিবারের অন্তত ষোল কোটি ভোক্তার স্বার্থ এখানে উপেক্ষিত হলেও সরকারের যেন করার কিছু নেই!

সাম্প্রতিক বিশ্ব-পরিস্থিতিতে তেলের দাম বৃদ্ধি অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তাই বলে একবারে এত বড় লাফ! দেশের ইতিহাসে এমন বড় ধরনের মূল্যবৃদ্ধি এর আগে কখনও ঘটেছে বলে আমরা নিশ্চিত নই। ‘উন্নয়নের মহাসড়ক’ স্লোগানে এগিয়ে যাওয়া সরকার মিল মালিকদের অযৌক্তিক ও উচ্চাভিলাষী দাবি মেনে নিয়েছে কোনো ধরনের সংশোধনী ছাড়াই। মূল্য সমন্বয়ের নামে মিল মালিকদের সঙ্গে যে বৈঠক করেছেন বাণিজ্যসচিব, তাতে ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘিত হয়ে মহাজনশ্রেণির স্বার্থই রক্ষা করা হয়েছে। ওই বৈঠকে ছিলেন না ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা কোনো সংগঠনের প্রতিনিধি, ছিলেন কেবল সরকার ও ভোজ্যতেল পরিশোধন ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানের মালিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা। এ থেকেই প্রমাণ হয়, মূল্য সমন্বয়ের নামে যে বৈঠক, যে সিদ্ধান্ত সেটা কেবলই ব্যবসায়ীক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার। অথচ দেশে রাজনৈতিক সরকার ক্রিয়াশীল, সচল এবং জনগণের অধিকার আদায় ও রক্ষায় গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগই ক্ষমতায়। ভোক্তাসাধারণের আর্থিক সামর্থ্যকে উপেক্ষা করে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষায় আওয়ামী লীগের এই ভূমিকা আমাদেরকে হতাশ করেছে। যদিও এমন রূপান্তর একদিনের ঘটনা নয়, দীর্ঘ দিনের পরিবর্তিত রাজনৈতিক চরিত্রের ফল।

বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফেকচার অ্যাসোসিয়েশন বৃহস্পতিবার দাম বাড়ানোর যে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে—এখন থেকে বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন তেল খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হবে ১৯৮ টাকায় (আগের দাম ১৬০ টাকা), ৫ লিটারের বোতলের দাম হবে ৯৮৫ টাকা (আগের দাম ৭৬০ টাকা)। এ ছাড়া খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৮০ টাকা (আগের দাম ১৩৬ টাকা) এবং খোলা পাম তেল প্রতি লিটার ১৭২ টাকায় (আগের দাম ১৩০ টাকা) বিক্রি হবে। বৃহস্পতিবারের এই দাম বাড়ানোর আগে গত ২০ মার্চ ভোজ্যতেলের দাম সমন্বয় করা হয়। তখন বোতল সয়াবিনের দাম লিটারে ৮ টাকা কমানো হয়। এছাড়া, খোলা সয়াবিনের দাম লিটারে ৬ টাকা ও পাম তেলের দাম লিটারে ৩ টাকা কমানো হয়। সমন্বয়ের জন্যে যৌক্তিক কারণে সরকার ভোজ্য তেলের আমদানি পর্যায়ে শুল্ক ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণ এবং উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়ে শুল্ক প্রত্যাহার করে। এর আগে  এ বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি বাণিজ্য সচিবের সঙ্গে বৈঠক শেষে মিল মালিকদের সংগঠন তেলের নতুন দাম নির্ধারণ করে যেখানে বলা হয় প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১৬৮ টাকা এবং খোলা তেলের দাম ১৪৩ টাকা, পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ৭৯৫ টাকা ও পাম অয়েলের দাম ১৩৩ টাকা। এখন সরকার যে দাম বাড়াল তাতে তেলের দাম বাড়লেও আমদানি এবং উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়ের শুল্ক আগের জায়গায় রয়ে যাচ্ছে। ফলে সরকার শুল্কে যেমন মার খাচ্ছে, তেমনি মার খাচ্ছে ভোক্তা সাধারণও। এতে কার লাভ—এটা অনুমিতই!

সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যের বরাত দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম জানাচ্ছে, গত এক বছরে সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ৮০ টাকা। এক বছর আগে ২০২১ সালের ৫ মে বোতলজাত সয়াবিনের দাম ছিল ১১৮ টাকা। ২০১৯ সালে দেশের বাজারে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিনের দাম ছিল ১০৪ টাকা। ২০২০ সালে সেটি বেড়ে হয় ১১৩ টাকা, ২০২১ সালে ১৩০ টকা এবং ২০২২ সালের শুরুতে এসে হয় ১৬৮ টাকা। পামওয়েলের লিটার (খোলা) ২০১৯ সালে ছিল ৫৮ টাকা, ২০২০ সালে লিটারে ৭৮ টাকা, ২০২১ সালে ১০৭ টাকা এবং ২০২২ সালের শুরুতে হয় ১৫০ টাকা।

এই যে বাজার পরিস্থিতি এখানে সরকার মিল মালিকদের সংগঠনের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছে বলে অভিযোগ ওঠেছে। মিল মালিকরা যখনই চাইছেন তখনই সামান্য বিরতি নিয়ে দাম বাড়ানো হচ্ছে। রমজানের আগে থেকেই এবার মিল মালিকেরা দাম বাড়াতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এবার ঈদের পর সমন্বয়ের নামের দাম বাড়ানোর আশ্বাসে তারা সন্তুষ্ট ছিলেন। তবে পুরো রমজান মাসে বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে তেলের দাম বাড়াতে বাধ্য করা হয়েছে। এখানে নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা হতাশাজনক। সরকার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে ঈদের পরপরই কি তবে পুরস্কৃত করল না?

ভোক্তা সাধারণের ওপর অতিরিক্ত দামের বোঝা চাপানোর আগে তাদের স্বার্থের দিকটি দেখা উচিত ছিল জনকল্যাণকামী রাজনৈতিক সরকারের। কিন্তু এখানে তারা পুরো বিষয়টি অবজ্ঞা করে গেছে। অবজ্ঞার কারণ কি তবে রাজনৈতিক সরকারে ব্যবসায়ী-আধিক্যের বিষয়টি? প্রতিনিয়ত উত্তর খুঁজে ফেরা প্রশ্ন আমাদের এটাই! বাণিজ্যমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার অনেকেই পেশায় ব্যবসায়ী, জাতীয় সংসদ সদস্যদের অধিকাংশের পেশায়ও একই। এমন অবস্থায় ভোক্তাসাধারণ ও ব্যবসায়ীর স্বার্থরক্ষার প্রসঙ্গ যখন আসে ব্যবসায়ীদের স্বার্থের অগ্রাধিকার তখন কি আপনা থেকেই আসে না? কষ্টকঠিন হলেও আমাদের শঙ্কা এমনই ঘটেছে, ঘটছে। অথচ আওয়ামী লীগ বরাবরই ছিল সাধারণ মানুষের দল। এই দলের এমন রূপান্তর অনেকেরই কাছে হতাশার!

বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়ছে, বাড়তি দামে তেল আমদানি করতে হচ্ছে—এসব অস্বীকার করছে না কেউ। কিন্তু ভোক্তার আর্থিক সামর্থ্যের দিকটা দেখা উচিত। সরকারকেই এটা দেখতে হবে। প্রয়োজনে নির্দিষ্ট কিছু পণ্যে ভর্তুকি দিয়ে হলেও ভোক্তা সাধারণের স্বার্থ দেখতে হবে। পরিবারের সদস্য সংখ্যা বিবেচনায় ক্রয়ের সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দেওয়ার পাশাপাশি নির্দিষ্ট কিছু পণ্যে টিকেটিং ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। এই টিকেটিং ব্যবস্থার আওতায় প্রান্তিক পর্যায়ে কিছু নির্দিষ্ট দোকান যুক্ত হতে পারে যেখানে প্রতি ভোক্তা মাসে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য গ্রহণ করবে সুনির্দিষ্ট খাতা/টিকেট প্রদর্শন করে। বাড়তি পণ্য নেওয়ারও সুযোগ থাকতে পারে। তবে তার জন্যে বাজারদর পরিশোধ সাপেক্ষে। এই কাজের জন্যে স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনকে কাজে লাগানো যেতে পারে। প্রয়োজনে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগানো যেতে পারে। সরকার চাইলে এটা খুব কঠিন কিছু নয়।  

তেল নিয়ে সিন্ডিকেট, চাল নিয়ে সিন্ডিকেট, পেঁয়াজ নিয়ে সিন্ডিকেট চলছে একের পর এক। সরকারকে এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না। বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকারের ব্যর্থতা কিংবা অনাগ্রহের শিকার হচ্ছে ভোক্তা সাধারণ। অথচ রাজনৈতিক সরকারের লক্ষ্য ব্যবসায়ী নয়, ভোক্তার স্বার্থ রক্ষাই! বিশ্ববাজার পরিস্থিতি ভোক্তা সাধারণের কাছে স্রেফ অজুহাত, কারণ আন্তর্জাতিক রাজনীতি দিয়ে তাদের পেট ভরে না, গাঁটেও পয়সা ঢুকে না!

 

লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক