তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে লাভ কার?

রাজেকুজ্জামান রতন প্রকাশিত: মে ৬, ২০২২, ০২:৫৩ পিএম

তেল কিনে খান যারা, তাদের কোনো মতামত নেওয়ার প্রয়োজন আছে কি? সংখ্যায় তারা ৪ কোটি পরিবার; কিন্তু কী এসে যায় তাতে? তেল যারা আমদানি করেন, পরিশোধন এবং বিপণন করেন, তারাই তো দেশের হর্তাকর্তা। তাদের মহাজনদের সর্বোচ্চ সংখ্যা ৫ থেকে ৭ জন এবং তাদের হাতে সর্বোচ্চ ক্ষমতা। তারা সিদ্ধান্ত নেবেন কত দামে বিক্রি করলে তাদের সর্বোচ্চ লাভ এবং সর্বনিম্ন ঝুঁকি থাকে। সরকার কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে কাজ করবে না, শুধু সহায়তা করবেন মাত্র। কাকে সহায়তা করবেন, সে প্রশ্ন করার মতো বোকামি নিশ্চয়ই কারও করা উচিত হবে না। 

বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ছে চড়চড়িয়ে। ফলে দেশে তো বসে থাকা যায় না। জনগণের স্বার্থে দেশে কোনো জিনিসের দাম বাড়ানোর কথা বলা যাবে না, তাই বলতে হয় মূল্য সমন্বয় করতে হবে। ভোক্তারা হাড়ে হাড়ে বোঝেন সমন্বয় কাকে বলে। তেলের মূল্য সমন্বয়ের বিষয়ে বাণিজ্যসচিবের সঙ্গে মিলমালিকেরা বৈঠক করেছেন। এই বৈঠকে ভোক্তা অধিকার রক্ষার বিষয়ে যারা কাজ করছেন, তাদের কোনো প্রতিনিধিকে ডাকার প্রয়োজনবোধ করা হয়েছিল কি না, তা জানা যায়নি। বৈঠক শেষে ভোজ্যতেল পরিশোধন ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেন এবং বিদ্যুৎ গতিতে সারা দেশে তা কার্যকর শুরু হয়েছে।

বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ঘোষণা দেওয়া হয়, এখন থেকে বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন তেল খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হবে ১৯৮ টাকায়, যার দাম ছিল ১৬০ টাকা। আর ৫ লিটারের বোতলের দাম হবে ৯৮৫ টাকা, যেটি ৭৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এ ছাড়া খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৮০ টাকা এবং খোলা পাম তেল প্রতি লিটার ১৭২ টাকায় বিক্রি হবে। ঘোষণা দেওয়ার আগে বাজারে খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৩৬ টাকা ও পাম তেল ১৩০ টাকায় বিক্রি হতো। এ হিসাবে খোলা সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে লিটারে ৪৪ টাকা। রোজার আগে বলা হয়েছিল রোজায় জিনিসের দাম বাড়বে না। সে কথা রাখেনি কেউ। কিন্তু আশঙ্কা ছিল ঘোষণা অনুযায়ী ঈদের পর দাম বাড়বে। কিন্তু এতটা বাড়বে, তা নিশ্চয়ই ধারণা করেননি কেউ।

সরকারের পক্ষ থেকে রোজার আগে ভোজ্যতেল আমদানি, উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়ে দুই দফা মূল্য সংযোজন কর কমানো হয়েছিল, বাজারে তার প্রভাব তেমন পড়েনি, কিন্তু সরকার হারিয়েছে রাজস্ব। গত ২০ মার্চ সরকার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৮ টাকা কমিয়ে ১৬০ টাকা নির্ধারণ করে। সে সময় খোলা সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৭ টাকা কমিয়ে ১৩৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এরপর তেলের দামের এই লম্বা লাফ। দেশের ভোজ্যতেলের বাজারে একসঙ্গে এত বেশি মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা এর আগে ঘটেনি। 

পাম অয়েলের প্রধান রপ্তানিকারক দেশ ইন্দোনেশিয়া নিজের দেশের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ নিশ্চিত রাখার উদ্দেশ্যে তেল রপ্তানিতে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার না করলে ইন্দোনেশিয়া থেকে পাম তেল আমদানির সুযোগ নেই। সে ক্ষেত্রে বিকল্প দেশ মালয়েশিয়া থেকেই আমদানি করতে হবে। আমাদের দেশে সাধারণত নিম্ন আয়ের মানুষ পাম তেলের প্রধান ক্রেতা। খোলা আকারে বিক্রি হয় এ তেল। হোটেল, রেস্তোরাঁয় খাবার তৈরিতে পাম তেল ব্যবহার হয়। এ ছাড়া খাদ্যপণ্য ও প্রসাধনী তৈরির কোম্পানিগুলোও পাম তেল ব্যবহার করে।
বাংলাদেশে বছরে প্রায় ১৩ লাখ টন পাম তেল আমদানি হয়। যার ৯০ শতাংশই আমদানি হয় ইন্দোনেশিয়া থেকে। মালয়েশিয়া থেকে আমদানি হয় বাকি ১০ শতাংশ। মালয়েশিয়ার চেয়ে তুলনামূলক কম দামের কারণেই ইন্দোনেশিয়া থেকে বেশি পাম তেল আমদানি হতো। কৃষি উৎপাদন ও বাণিজ্যবিষয়ক তথ্যের অন্যতম প্রধান উৎস যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, গত মৌসুমে বিশ্বে পাম তেল রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪ কোটি ৮১ লাখ টন। এই রপ্তানির ৫৬ শতাংশ বা ২ কোটি ৬৮ লাখ টনই করেছে ইন্দোনেশিয়া। মালয়েশিয়া রপ্তানি করেছে ১ কোটি ৫৮ লাখ টন, যা বৈশ্বিক রপ্তানির ৩৩ শতাংশ। বাকি ১১ শতাংশ রপ্তানি করেছে কয়েকটি দেশ মিলিয়ে। ফলে ইন্দোনেশিয়ার রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা বিশ্ব বাণিজ্যের বাজারে কিছুটা অস্থিরতা তৈরি করে। এর সুযোগ নিতে দেরি করেননি বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। 

আমদানি কত হয় আর বাজারে কত সয়াবিন তেল আছে, তার হিসাব মেলে না কিছুতেই। খুচরা বাজারে সবচেয়ে বেশি থাকার কথা বসুন্ধরা গ্রুপের সয়াবিন তেল। এরপর সিটি, মেঘনা, বাংলাদেশ এডিবল অয়েল, টিকে ও সেনাকল্যাণ সংস্থার তেল। এই ছয় কোম্পানি এপ্রিল মাসের ১ থেকে ২৮ তারিখ পর্যন্ত  ৮ কোটি লিটার সয়াবিন তেল বাজারজাত করেছে।

এ ছয়টিসহ দেশে এখন মোট সাতটি কোম্পানি সয়াবিন তেল বাজারজাত করছে। বাজারজাতকরণে কোনো মাসে এক কোম্পানি  শীর্ষে তো অন্য মাসে আরেক কোম্পানি শীর্ষে ক্রমতালিকায় এমন উত্থান-পতনে এপ্রিল মাসে সয়াবিন তেল বাজারজাতে শীর্ষে ছিল বসুন্ধরা গ্রুপ। এই বাজারজাত করা সয়াবিন তেল ডিলারদের হাত ঘুরে খুচরা বাজারে আসার কথা। এ ক্ষেত্রে নিয়ম হলো, সয়াবিন তেল আমদানি করে প্রথমে জাহাজ থেকে কর্ণফুলী নদীর তীরে কাস্টমস বন্ডেন্ড ট্যাংক টার্মিনালে রাখা হবে। সেখান থেকে পরিশোধন করে বাজারজাত করার জন্য শুল্ক কর পরিশোধ করে খালাস করে নিয়ে যাবে কোম্পানিগুলো। 

তথ্যানুসারে, এপ্রিল মাসের ২৮ দিনে বসুন্ধরা গ্রুপ পরিশোধন করে বাজারজাত করেছে সোয়া তিন কোটি লিটার সয়াবিন তেল, যা গত মাসে বাজারজাত হওয়া মোট সয়াবিনের ৩৯ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা সিটি গ্রুপ বাজারজাত করেছে ১ কোটি ৪৩ লাখ লিটার সয়াবিন তেল। তৃতীয় অবস্থানে থাকা মেঘনা গ্রুপ ১ কোটি ৩০ লাখ লিটার, বাংলাদেশ এডিবল অয়েল ৮৮ লাখ লিটার, টিকে গ্রুপ ৮৭ লাখ লিটার ও সেনাকল্যাণ এডিবল অয়েল ৫৪ লাখ লিটার সয়াবিন তেল বাজারজাত করেছে। এই হিসাবে মোট ৮ কোটি ১৮ লাখ লিটার বা ৮১ হাজার ৮০০ টন তেল বাজারে থাকার কথা। কিন্তু বাজার থেকে তেল উধাও! 

কিন্তু কারওয়ান বাজারে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা অভিযানে নেমে দেখেছেন তেল আছে। তবে দোকানে নয়, পরিবেশকের গুদামে। ঈদের আগে তেল এসেছিল। ক্রেতাদের দেখা দিয়ে আবার উধাও। দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তের পর বাজারে ফিরবে তেল আবার। বিশ্ববাজারে কত দাম বেড়েছে, তার প্রভাব দেশের বাজারে কতখানি পড়বে, তা নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। সিদ্ধান্ত হয়েছে দাম বাড়ানোর। সর্বংসহা জনগণ মেনে নিন, কোনো প্রতিবাদ বা ঝামেলা করবেন না। বিভিন্ন অজুহাতে তেলের দাম বাড়ছে, জনগণের কষ্ট বাড়ছে, মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ব্যবসায়ীদের মুনাফা বাড়তে থাকবে। এই দাম ও কষ্ট বৃদ্ধির চক্কর থেকে জনগণের কি মুক্তি নেই? 

 

লেখক: রাজনীতিবিদ ও শ্রমিক নেতা