মার্চ আমাদের ইতিহাসে এক অগ্নিঝরা মাস। আমাদের বয়সী যারা তখন ঢাকা শহরে অবস্থান করেছিলেন, তাদের সবারই কোনো না কোনো স্মৃতি ভর করে আছে। ২৫শে মার্চের ভয়াবহতা যারা অবলোকন করেছেন, তাদের মধ্যে কেউ কেউ কী করে পাকিস্তানপন্থী রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের সাথে হাত মেলালেন, সেটি চিন্তা করলে জটিল এক সমীকরণের মতো মনে হয়। ভাবি এ রকমই বোধ হয় আমাদের বাঙালিদের চরিত্র। আমরা বোধ হয় এ রকমই স্ববিরোধী।
তখন নবম শ্রেণিতে পড়ি। রাজনীতির অনেক কিছুই তেমন গভীরভাবে বিশ্লেষণ করতে শিখিনি। তবে বর্বর পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালিরা যে এবার একটি শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলবে, সেটা বুঝতে পেরেছিলাম। প্রায়ই আমাদের জিন্দাবাহারের বাড়ির ছাদে উঠে দেখতাম যে কোথায় বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। আমাদের ছাদ থেকে আহমেদ বাওয়ানী একাডেমি, আরমানিটোলা হাইস্কুলের ছাদ দেখা যেত। ওই স্কুলগুলোতে মার্চের ৩ তারিখ থেকেই লাল সবুজের পতাকা উড়ত। লক্ষ করতাম সেগুলো আবার কেউ নামিয়ে ফেলে কি না। অনুপ্রাণিত হতাম, বিদ্রোহী হতাম। চিন্তা করলাম আমিও একটি পতাকা বানিয়ে ফেলি।
একদিন সত্যি সত্যি, তারিখ মনে নেই, পাকিস্তানি পতাকার চাঁদ তারা গোল করে কাঁচি দিয়ে কেটে ফেললাম। আপাদের কাছ থেকে লাল কাপড় জোগাড় করলাম। গোল করে কাটলাম। সুই সুতা জোগাড় করলাম। এবং সেলাই করে ফেললাম। মনে পড়ে প্রতিটি মুহূর্ত ছিল রোমাঞ্চকর। কাজটি করেছিলাম খুব গোপনে। একদিন সকালবেলা ছাদের ফ্লাগ স্টান্ডে ঠিকই উড়িয়ে দিলাম। বাতাসে পতাকা উড়ছিল, ভাবছিলাম আমিও আন্দোলনের একজন সৈনিক। রাস্তা থেকে এ রকম পতাকা দেখে অনেকেই আমার বাবার নিকট বিষয়টি জানান। আমি তখন ছাদ থেকে নিচে নেমে আমার মায়ের ঘরে অবস্থান করছিলাম। হঠাৎ দেখি আমার বাবা সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে এলেন এবং আমাকে বকাঝকা করলেন। আমার বড় বোনেরাও আমাকে বেশ বকা দিলেন। বাবা বললেন ‘‘তুই করেছিস কী?” এটা আমার মনে পড়ে।
তারপর এই পতাকা আমাকে এক ঘণ্টার মধ্যেই নামিয়ে ফেলতে হয়েছিল। অনেকটা মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজটি করেছিলাম। অনুতপ্ত হইনি মোটেও। অপেক্ষায় ছিলাম কবে কখন আবার এই লাল সবুজের পতাকা উড়বে। সেই শুভক্ষণ এসেছিল ২৩ মার্চ তৎকালীন পাকিস্তান দিবসে। আমার মনে পড়ে পুরনো ঢাকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই সেদিন বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত লাল সবুজ পতাকা উড়েছিল। সঙ্গে কালোপতাকাও উড়ানো হয়েছিল। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। পতাকা না উড়ানোটাই ছিল অপরাধের সামিল, আবেগ, অনুভূতি, বিদ্রোহ সব ওই পতাকায় মিশে গিয়েছিল, সঙ্গে ছিল কালো রঙের শোকের পতাকা। ভুট্টোর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলোচনা চলছে। পাশাপাশি প্রতিদিন ঢাকার রাস্তায় আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ চলছে। গভীরভাবে বিশ্লেষণ করার সেই জ্ঞান তখন ছিল না।
পঁচিশে মার্চের কালরাতে বিকট শব্দে চারিদিক কেঁপে কেঁপে উঠছিল। সকালে দেখলাম প্রতিবেশীরা ছাদে উঠে কী যেন বলাবলি করছে। ছাদে উঠে দেখলাম শহরের বেশ কয়েকটি স্থানে আগুনের কুণ্ডলী ও ধোঁয়া। সেই সময় প্রতি রাতেই কারফিউ থাকত। ২৬ মার্চ আব্বা জিন্দাবাহারের তাঁর কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে কারফিউবিহীন সকালবেলা কী হয়েছে দেখার জন্য ইসলামপুর রোডে বের হলেন, আমাকেও নিয়ে গেলেন। হেঁটে আমরা প্রথমে শাঁখারীবাজার মোড়ে বাবুবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে প্রবেশ করলাম। আমাদের মতো অনেকে অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য বাসা থেকে বের হয়েছিলেন। আমি ফাঁড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে পারিনি। শুনতে পেলাম বেশ কয়েকজন পুলিশ বাহিনীর সদস্যকে পাকিস্তানি বাহিনী গুলি করে হত্যা করেছে। সেই দৃশ্য দেখার আর ইচ্ছে হয়নি।
তারপর আব্বা শাঁখারীবাজারে প্রবেশ করলেন। সরু প্রবেশদ্বার দিয়ে বিভিন্ন গৃহে ঢুকে সেদিন যে দৃশ্য দেখেছিলাম তা আজও ভাবলে গা শিহরিত হয়ে ওঠে। চৌকির নিচে সারিসারি লাশ। ছড়ানো ছিটানো, এমনকি ছোট শিশুরাও রেহাই পায়নি। বেয়োনেট দিয়ে খোঁচানো মৃত শিশুকেও দেখেছিলাম। একরাশ আতঙ্ক, ভয়, ঘৃণা মনকে আচ্ছন্ন করেছিল।
শাঁখারীবাজারের পুরো এলাকা আর ঘুরে দেখার সাহস করিনি। একা হেঁটে বাসায় চলে এলাম। ২৬ মার্চ রাতটি ছিল আগুনের মহোৎসব। একদিকে জল্লাদ ইয়াহিয়ার ভাষণ অন্যদিকে ইংলিশ রোডের কাঠের দোকানগুলোতে অগ্নিকাণ্ড। পাকিস্তানি সৈন্যরা সুপরিকল্পিতভাবে এক ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টির জন্য একধরনের পাউডার ছিটিয়ে পুরো ইংলিশ রোডের দোকানপাটে আগুন ধরিয়ে দেয়। মনে হচ্ছিল সেই আগুন আমাদের পাশের বাড়িতে লেগেছে। সেই আগুনের ভয়বহতা এতটা ব্যাপক ছিল যে ওই অঞ্চলের বসবাসকারী অনেক সাধারণ মানুষ বাড়িঘর ত্যাগ করে।
পরদিন ২৭ মার্চ বহু মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে ঢাকা ত্যাগ করতে থাকে। এই ত্যাগে ছিল অনেক ক্ষোভ, অনেক ক্রোধ, অনেক বারুদ। কোথায় যাবে ছিল না তার কোনো নিশানা। স্রোতের মতো রিকশায় করে, হেঁটে সোয়ারিঘাট। সেখান থেকে নৌকায় বুড়িগঙ্গা পার হয়ে জিঞ্জিরা। সেই কাহিনি আরেকবার লিখব। লিখতে হবে। কারণ এগুলো বলার মতো লোক একসময় থাকবে না। এত হত্যা, এত বীভৎসতা, এত কান্না, এত আগুন তারপরও কী করে ওই মার্চের শ্লোগান “জয় বাংলা”; “তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা, মেঘনা, যমুনা”, “জেলের তালা ভাঙব শেখ মুজিবকে আনব", “ বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর” হয়ে যায় “বাংলাদেশ জিন্দাবাদ” (যেমনটি পাকিস্তান জিন্দাবাদ) তা অনুসন্ধান করার অনুসন্ধিৎসু মনকে জাগিয়ে তুলতে হবে এ প্রজন্মের মধ্যে। দেশপ্রেম জাগ্রত হবে সেখান থেকেই, জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখক: অধ্যাপক ও ট্রেজারার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়