নারী যে ধর্ষণের শিকার হতে পারে, এ ধারণাটা এখনো সাধারণ মানুষের মধ্যে তৈরি হয়নি। যখনই কোথাও কোনো ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, তখনই অপরাধটিতে নারী নিজেও জড়িত—এটি প্রমাণ করার জন্য নানা রকম খোঁড়া যুক্তি উঠে আসতে থাকে। কখনো পোশাক, কখনো ধর্ষণের স্থান ও সময়সূচি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় ভুক্তভোগী নারীকেই আক্রমণ করে। অথচ নারীর পোশাক যেমনই হোক, কিংবা যত রাত বা যত সকালই হোক, নারী একা হোক বা সদলবলে থাকুক, ধর্ষণ করার অধিকার কারও নেই। ধর্ষণ করার পেছনে কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। ধর্ষণের কারণ কেবল ধর্ষকের বিকৃতমনা রুচি, এছাড়া আর কিছুই নয়। তবু নারীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন, শিশুরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, হয়েই যাচ্ছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে ভুক্তভোগীদের চরিত্র হনন ও অপরাধীর অপরাধ জায়েজকরণ।
এই যখন আমাদের অবস্থা, এর মধ্যে পুরুষও যে ধর্ষণের শিকার হতে পারেন, এটা কেউ ধর্তব্যের মধ্যেও আনেন না। অথচ পুরুষও ধর্ষণের শিকার হন। নারী ধর্ষণের শিকার হলে এখন অন্তত চিৎকার করে কাঁদতে পারেন, বিচার চাইতে পারেন। পুরুষ ভুক্তভোগীরা এখনো এর থেকে অনেক দূরে রয়েছেন। একে তো এটা কেউ বিশ্বাস করে না যে পুরুষ ধর্ষণের শিকার হতে পারে, তার ওপর ব্যাপারটি সবার কাছে স্রেফ একটি হাস্যকর ঘটনা বৈ কিছুই নয়। ফলে ভুক্তভোগী পুরুষের যন্ত্রণা ও বেদনা নারীর চেয়ে কখনো কখনো আরও বেশি। সাম্প্রতিক সময়ে মাদ্রাসায় অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেশিশু বলৎকারের বেশ কিছু ঘটনা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ায় কারও কারও হয়তো টনক নড়ছে। তা-ও শিশুদের শুধু ধর্ষণ নয়, একেবারে নৃশংসভাবে হত্যা পর্যন্ত করা হচ্ছে বলেই বিষয়টি নিয়ে কথা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আপনারা ভুক্তভোগীর কোন পোশাক, আর চরিত্রের দোষ ধরে টানাটানি করবেন? শুধু অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেশিশুরাই যে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, তা নয়, সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখেছি, প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন আরেক পুরুষ দ্বারা। এরই ধারাবাহিকতায় খুনখারাবির ঘটনাও ঘটছে।
অতি সম্প্রতি দুজন বৃদ্ধও ধর্ষণের শিকার হওয়ার একটি ঘটনা বেশ আলোচিত হলো। অপরাধটি তা-ও ঘটল আবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যের দ্বারা। এত নির্মম একটি অপরাধ, অথচ সাধারণ মানুষের কাছে এটি স্রেফ হাসিঠাট্টার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নারীরা তো তা-ও একটু কেঁদে হালকা হতে পারে। ওদিকে ‘পুরুষেরা কাঁদে না’ নামক একটা ভারী পাথর আমরা চাপিয়ে দিয়েছি পুরুষদের ওপর। আমাদের চারপাশে এই উদাহরণগুলো রয়েছে। আমরা দেখেও দেখি না, ওই কান্নাগুলো শোনার মতো কান আমাদের নেই। আমরা অন্ধ ও বধির।
মি-টু আন্দোলনের সুবাদে পুরুষদের যৌন নিগ্রহের ঘটনাগুলো কিছু কিছু সবার সামনে উঠে এসেছে। একটি চরম সত্যের মুখোমুখি আমাদের দাঁড় করিয়েছে এই ঘটনাগুলো। যদিও সত্যকে গ্রহণ করার মতো মানসিকতা আমাদের তেমন নেই।
পুরুষ বা বাচ্চা ছেলেদের ধর্ষিত হওয়ার ঘটনাগুলো লোকচক্ষুর আড়ালেই রয়ে গেছে। এমনকি আমাদের সাহিত্যেও এ বিষয়টি একেবারেই নেই। অথচ শিল্প ও সাহিত্য সাধারণ মানুষের জীবনের বাইরে গিয়ে তো নয়!
আমার মনে হয়, প্রথম হুমায়ূন আহমেদই তার লেখায় ও চলচ্চিত্রে এ বিষয়টিকে তুলে ধরেছেন। এবং বেশ বড় পরিসরে অত্যন্ত মানবিকভাবে এটা প্রকাশ করেছেন, এমনটি যা আর কেউ করে দেখানোর সাহস এ সমাজে করেনি। ‘ঘেঁটুপুত্র কমলা’ শুধু একটি চলচ্চিত্র হিসেবেই এটিকে আমরা দেখেছি। এর ভেতরের কান্না আর হাহাকার নিয়ে খুব বেশি কি আসলে ভেবেছি আমরা? ভাবিনি। এসব ভাবি না বলেই আজ আমাদের সমাজ এমন ধর্ষণবান্ধব! এখানে একজন নারী স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভেতরে গণধর্ষণের শিকার হয়, শিশুরা কোরানের হাফেজ হতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয়ে লাশ হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যের কাছে বৃদ্ধরা ধর্ষণের শিকার হয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়।
ধর্ষকদের সাফাই গাইতে গাইতে আর ভিকটিম ব্লেমিং করতে করতে আমরা এমন এক ধর্ষণবান্ধব সমাজ তৈরি করেছি, যেখানে নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ কেউই আজ নিরাপদ নয়। তাই বলছি, সময় থাকতে সচেতন হোন। ধর্ষকদের বিচারব্যবস্থার মধ্য দিয়ে উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করার আওয়াজ তুলুন।
লেখক : শিক্ষক ও লেখক।