‘‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের সূত্রে পরিচয় হয় (নাম)...র সঙ্গে নাঈমের। কিছুদিন আগে মেয়েটি ফেসবুকে একটি ছবি পোস্ট করলে নাঈম এতে হা-হা রিঅ্যাক্ট দেয়। এ নিয়ে ফেসবুক ও ইমোতে তাদের নানা উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। এরপর মেয়েটির ছবি ব্যবহার করে নাঈম ‘টিকটক ভিডিও’ বানিয়ে তার কাছে পাঠিয়ে দেয়। এ নিয়ে তাদের মাঝে চলে চরম উত্তেজনা। এ ঘটনায় মেয়েটি ও তার স্বামী ক্ষুব্ধ হয়ে নাঈমকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিলে সে তার অবস্থান জানান দিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। পরে দলবল নিয়ে মেয়েটি ও তার স্বামী গত শনিবার রাত ১১টার দিকে কাপাসিয়ার আড়ালবাজারের পূর্ব পাশে দক্ষিণগাঁও চরপাড়া গ্রামে এসে হামলা চালায়। এতে নাঈমসহ তিনজন নিহত হন। এ সময় আরও ছয়জন আহত হন।’’
যৌক্তিক কারণে মেয়েটির নাম গোপন করা ছাড়া সংবাদের এই অংশটুকু দৈনিক সমকালের। এর বাইরে একাধিক গণমাধ্যম ‘ফেসবুকে মন্তব্যের জেরে’ এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে সংবাদ প্রকাশ করেছে। ফারুক হোসেন (২৬), নাঈম হোসেন (১৮) ও রবিন (২৪)—এরা এ ঘটনায় নিহত হয়েছেন। আহতদের বয়সও কাছাকাছি। বয়সের হিসাবে তারা অনতি তরুণ। যে মেয়েটির ছবিতে ‘মন্তব্য’ অথবা ‘হা-হা রিঅ্যাক্ট’ পড়ার কারণে এত বড় ঘটনা তার বয়সও কম, মাত্র ২২। এ ঘটনায় মেয়েটির স্বামী নিশ্চয়ই কাছাকাছি বয়সের!
ছবিতে ‘হা-হা রিঅ্যাক্ট’ হোক আর মন্তব্য হোক, ঘটনার পরিণতি তিন-তিনটা প্রাণের চিরবিদায়! ভাবা যায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সামান্য রিঅ্যাক্ট অথবা মন্তব্য একাধিক প্রাণহানি কারণ হতে পারে? কতটা অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছি আমরা! ফেসবুকে সামান্য পোস্ট থেকে এত হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটতে পারে, ভাবাই যাচ্ছে না। এ ঘটনা আমাদের স্তব্ধ করে দিয়েছে। মানুষ কেন দিনদিন এত অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে? পরমত সহ্য করার ক্ষমতা কেন হারাচ্ছে দিনদিন?
গাজীপুরের এ ঘটনা আমাদের আহত করলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দিনদিন অসহিষ্ণু, বিভেদের মাধ্যম ও হেইট স্পিচের অভয়ারণ্য হয়ে ওঠার বিষয়টি নতুন নয়। রাজনৈতিক বিরোধ, আদর্শিক বিরোধকে কেন্দ্র করে একে অন্যের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। স্বনির্ধারিত শত্রু-শত্রু খেলায় একদল আরেক দলের বিরুদ্ধে লড়ছে। তুচ্ছ ও সাদামাটা কোনো কিছুকে কেন্দ্র করে দলাদলি থেকে সহিংসতার ঘটনাও ঘটছে। এসব ক্ষেত্রে সামাজিক মূল্যবোধকে জলাঞ্জলি দিয়ে স্রেফ প্রতিহিংসার চর্চা চলছে। এর প্রভাব পড়ছে সমাজের সর্বত্র।
ফেসবুকে ছবি এডিট করে অস্থিরতা সৃষ্টি, গুজব প্রচারের মাধ্যমে সহিংসতার ঘটনা নতুন নয়। রামু, নাসিরনগর, কুমিল্লা, শাল্লাসহ এমন অনেক ঘটনার উদাহরণ টানা যায়, যেখানে সহিংসতার জন্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করা হয়েছে। ঘটনাগুলোর একেকটার প্রভাব ব্যাপক হলেও ওসব থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া হয়নি। এত এত ঘটনা, তবু ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার ইতিহাস আমাদের নেই। একই সঙ্গে নেই জোর প্রশাসনিক পদক্ষেপ, সামাজিক সচেতনতা। ফলে সমস্যার ব্যাপক বিস্তৃতি ও ধারাবাহিকতায় বাদ সাধা হয়নি।
একটা ছবিতে হা-হা রিঅ্যাক্ট কিংবা মন্তব্যের জের ধরে যে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা, এটাও অন্য সব ঘটনার মতো আমাদের নাড়া দিয়েছে। কিন্তু এই নাড়া দেওয়াটা স্রেফ কিছুদিনের জন্যই। হয়তো কিছুদিন আলোচনা হবে এ নিয়ে। আলোচনা হলেও অন্য কোনো বিষয় সামনে এলে এটাও ভুলে যাওয়া হবে আমাদের। এভাবেই চলছে! অথচ এখানে সমস্যার স্থায়ী সমাধানের পথ খোঁজার দরকার ছিল। কিন্তু ‘প্রতিপক্ষকে হেনস্তা করা ছাড়া যেহেতু আমাদের আর কোনো কর্মসূচি নেই’, তাই এটাও ‘গুরুত্ব দিয়ে’ আমরা এড়িয়ে যাব!
গাজীপুরের নিহত তিন তরুণের কেউ সত্যি কোনো অপরাধ করে থাকলেও এটা তাদের প্রাণ হরণের মতো অপরাধ নিশ্চয় নয়। কারও ছবিতে-পোস্টে কেউ আপত্তিকর মন্তব্য কিংবা রিঅ্যাক্ট করলে এর জন্য যথোপযুক্ত আইনের আশ্রয় নেওয়া যেত। অথচ সেটা হয়নি। হামলা ও পরিকল্পনা করে খুন করা হয়েছে। খুনের আগে দলাদলি হয়েছে, একে অন্যকে চ্যালেঞ্জ করেছে। সামাজিক শৃঙ্খলা বিনষ্টের পাশাপাশি আইন-আদালতকে পাত্তা না দেওয়ার ধৃষ্টতা দেখানো হয়েছে। খুনের আগের ঘটনা ছোট-বড় যা-ই হোক না কেন, এটা হামলার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, হামলার মতো ঘটনা দেশে আইনের শাসনের, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের প্রমাণ বহন করে না। এটা সংশ্লিষ্টদের পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষার অভাবের সঙ্গে সঙ্গে রুচি, সংস্কৃতি, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ও শিষ্টাচারের দুর্ভিক্ষের স্মারকবিশেষ।
আশঙ্কা, অন্য অনেক ঘটনার মতো এটাও একদিন আলোচনার প্রাসঙ্গিকতা হারাবে। এভাবে কত—জবাব দেবেন কেউ? সামাজিক মূল্যবোধ কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে—ভাবছেন কি কোনো দায়িত্বশীল? এই প্রবণতা বিপজ্জনক। এজন্য পরিবারকে দায়িত্ব নিতে হবে, সমাজকে দায়িত্ব নিতে হবে; দায়িত্ব নিতে হবে রাষ্ট্রকেও।
ক্রমক্ষয়িষ্ণু ভঙ্গুর অবক্ষয়গ্রস্ত, অসভ্য, নিষ্ঠুর ও অমানবিকতার ঘেরাটোপে বন্দি আমাদের সমাজব্যবস্থা। মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের একপাক্ষিক দাবি পরাজিত এই অসভ্যতায়। অবক্ষয়ের তলানির দিকে ক্রমধাবমান সমাজ, সমাজব্যবস্থা। এই হিংসা, সহিংসতার স্থায়ী সমাধান জরুরি। তা না হলে আমাদের রক্ষা নেই।
লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক