ইসি : শূন্য থেকে শুরু!

কবির য়াহমদ প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২২, ০১:৪৪ পিএম

ভাবমূর্তি সঙ্কটকে সঙ্গী করে দায়িত্ব গ্রহণ করেছে নতুন নির্বাচন কমিশন। আগামী পাঁচ বছরের জন্যে গুরুভার গিয়ে পড়েছে সাবেক সিনিয়র সচিব কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশনের। কে এম নুরুল হুদা যেখানে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে রেখে গেছেন, নির্বাচন কমিশনের প্রতি মানুষের আস্থার জায়গাকে শূন্যের কোটায় নামিয়ে এনেছেন, সেখানে নতুন নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব যথার্থই চ্যালেঞ্জের। নতুন কমিশন এই চ্যালেঞ্জ কীভাবে মোকাবেলা সেটাই দেখার বিষয়। এজন্যে তাদের সময়ের দরকার, সহযোগিতার দরকার। আশা করি, সংশ্লিষ্টরা সেটা করবেন। এই নির্বাচন কমিশন যদি আস্থার সঙ্কটের জায়গা থেকে বেরুতে না পারে তবে এটা হবে জাতির জন্যে দুর্ভাগ্যের।

নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে সার্চ কমিটির নাম প্রস্তাব থেকে। আগের সার্চ কমিটিগুলোর চাইতে এবারের সার্চ কমিটি ছিল ভিন্ন, এবারের কমিটির সঙ্গে আইনি সংযোগ ছিল। এবারই প্রথম সাংবিধানিক নির্দেশনায় আইন করেছে সরকার। এই সার্চ কমিটি রাষ্ট্রপতির কাছে যাদের নাম সুপারিশ করেছে তাদের নাম আগে থেকেই জানা ছিল দেশবাসীর। যদিও সবশেষ প্রস্তাবিত নাম জানা ছিল না কারও। তবে প্রাথমিক অবস্থায় তারা ৩২২ জনের নাম প্রকাশ করেছিল, যারা কোনো না কোনো পক্ষ, এমনকি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। যদি সার্চ কমিটি বা অনুসন্ধান কমিটি নিজ থেকে কাউকে অনুসন্ধান করেনি, করেছে কেবল বিভিন্ন মহল থেকে প্রাপ্ত সুপারিশের ৩২২ নাম থেকে। এটাকে কি সার্চ কিংবা অনুসন্ধান বলা যায়? হয়ত যায় না। তারা আদতে বাছাই করেছে, এবং তাদের পরিধিও সীমিত ছিল নির্দিষ্ট কিছু মানুষের মধ্যেই।

নতুন নির্বাচন কমিশন যাদের নিয়ে গঠিত হয়েছে তারা হচ্ছেন—সাবেক জেলা ও দায়রা জজ বেগম রাশিদা সুলতানা, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান হাবীব খান, সাবেক সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর ও সাবেক সিনিয়র সচিব মো. আনিছুর রহমান। এই কমিশনে আমলা আধিক্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পাঁচজনের নির্বাচন কমিশনের তিনজনই সাবেক আমলা। পেশাগত জীবনে তারা সাফল্যের সঙ্গেই তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন বলেই প্রথমে নামের প্রস্তাব, এরপর সার্চ কমিটির সুপারিশ শেষে চূড়ান্তভাবে রাষ্ট্রপতি তাদের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব দিয়েছেন। চলতি দায়িত্বে থাকা আপিল বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে যে সার্চ কমিটি ছিল তাদের বাছাইপর্যায় শেষে সুপারিশে আস্থা রাখতে চাই। এখনই তাদের নিয়ে বিরূপ মন্তব্য কারও সমীচীন হবে না বলেও মনে করি।

তবে আমরা যতখানি সরলভাবে দেখি না কেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সেভাবে দেখে না, দেখছেও না। সরকারের ঘনিষ্ঠ মিত্র জাতীয় পার্টি নতুন নির্বাচন কমিশনকে ‘আমলানির্ভর আওয়ামী লীগ-সমর্থিত’ বলেছে। জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক বলেছেন, “বিএনপি ও আওয়ামী লীগ কেউই নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে পারেনি। আওয়ামী লীগ জিতলে বিএনপি বলে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি আবার বিএনপি জিতলে আওয়ামী লীগ বলে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি।” তিনি বলেছেন, “জাতীয় পার্টি সব সময় বলে আসছে বাংলাদেশে কেয়ারটেকার সরকারের অধীনেও নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না” বিএনপি বরাবরের মতো এই নির্বাচন কমিশনকে প্রত্যাখ্যান করেছে। নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়ার পুরো বিষয়টিকে ‘নাটক’ উল্লেখ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, “ইসি নিয়ে আমরা আগ্রহী নই; এই ইসি গঠন একটি নাটক।” তার ভাষ্য, “নির্বাচন কমিশনে ভালো ও সৎ মানুষ বসালেই ভোট সুষ্ঠু হবে এটা তারা মনে করেন না। বিএনপি নেতাদের নির্বাচন কমিশনে আনা হলেও দলীয় সরকারের অধীনে ভোট সুষ্ঠু হবে না।” এদিকে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলছেন, “আমাদের প্রস্তাবিত নাম বাদ পড়লেও সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গঠিত হওয়ায় আমরা সন্তুষ্ট। গঠিত নির্বাচন কমিশনের প্রতি আমাদের আস্থা রয়েছে।” এছাড়াও বিভিন্ন দল নানাভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, যার অধিকাংশই একপেশে এবং সরকারের সঙ্গে সম্পর্ককে কেন্দ্র করেই পক্ষে অথবা বিপক্ষে।

রাজনৈতিক দলগুলোর এই প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক বলেই ধরে নিচ্ছি। সরকার-দল আর সরকারবিরোধী দলগুলোর এই প্রতিক্রিয়া জানাশোনা আমাদের। নামগুলো কেবল বদল হয়, যে দল সরকারে থাকে তাদের প্রতিক্রিয়া আর যারা সরকারের বাইরে থাকে তাদের প্রতিক্রিয়া এমনই হয়ে আসছে, এটা ধারাবাহিকতা কেবল। এখানে অবশ্য নাগরিক প্রতিক্রিয়া সামনে আসছে না, আসার সুযোগও সীমিত। যদিও কিছু প্রতিক্রিয়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং নানা মাধ্যম সূত্রে আসছে। তবে এটা এখনও পূর্ণাঙ্গ নয়। আস্থাহীনতার চলমান চোখ রাঙানি আছে নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি। এর জন্যে দায়ী যে কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বের নির্বাচন কমিশন, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। গত পাঁচ বছরে নুরুল হুদার নেতৃত্বে বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে একেবারে শেষ করে দেওয়া হয়েছে! অবশ্য আগে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন হতো এমনও না। আগের প্রত্যেক কমিশনের প্রতি কিছু না কিছু অভিযোগ ছিল। তবে সকল কিছু ছাপিয়ে গেছে গত কমিশন।

একাদশ সংসদ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে যে বিতর্ক, অভিযোগ, ইভিএম, নির্বাচন বিষয়ক বক্তৃতা দিয়ে সম্মানী গ্রহণ নিয়ে পুরো পাঁচ বছর বিতর্কের মধ্যে ছিল আগের কমিশন। ‘রাতের ভোট’, প্রশাসনের পক্ষপাতিত্বসহ নানা অভিযোগ আছে। কিন্তু ওই অভিযোগগুলোর একটাও খণ্ডাতে পারেনি সেই কমিশন। এতে করে নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি মানুষ আস্থা হারিয়েছে দিনের পর দিন। সিইসি আস্থা ফেরাতে পারেননি, বরং বলা যায় সে চেষ্টাও করেননি। এখন নতুন যে কমিশন গঠিত হয়েছে তাদের কাঁধে চেপেছে পুরনো সেই আস্থাহীনতা। তারা কীভাবে এই সঙ্কট কাটিয়ে ওঠে সেটাই দেখার বিষয়!

নবগঠিত নির্বাচন কমিশন শপথ গ্রহণ করেছে। রোববার শপথ নিয়ে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, “প্রতিটা নির্বাচনই একটা চ্যালেঞ্জ। মানুষের জীবনটাও একটা চ্যালেঞ্জ। নির্বাচনও একটা চ্যালেঞ্জ। কোনো চ্যালেঞ্জকে ভয় পেলে হবে না। চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করতে হবে।” নির্বাচনে সবার সহযোগিতা প্রত্যাশা করে তিনি বলেছেন, “নির্বাচন একটা বিশাল কর্মযজ্ঞ। এর সঙ্গে অনেকেই জড়িত। সবাই যদি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়, আমরা আশাবাদী; আমি যে সহকর্মী পেয়েছি, সবাই মিলে আমরা সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব।” সিইসি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন, বলেছেন শপথ অনুযায়ী কাজ করার। এজন্যে এখনই তার ওপর থেকে আস্থা না সরিয়ে তাকেসহ তার কমিশনকে সময় দেওয়া উচিত সকলের।

নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে গঠিত সার্চ কমিটির বৈঠকে যায়নি বিএনপি, কোনো নামও প্রস্তাব করেনি তারা। তবে তারা ঠিকই নবগঠিত নির্বাচন কমিশনকে প্রত্যাখ্যান করেছে। ইসিকে প্রত্যাখ্যান করতে গিয়ে ভয়ঙ্কর যে কথাটি বলেছে তা হচ্ছে—“ইসি নিয়ে আমরা আগ্রহী নই; এই ইসি গঠন একটি নাটক।” ইসি গঠনকে ‘নাটক’ বলে আখ্যা দেওয়া দলটির সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে অস্বীকারের পর্যায়ে পড়ে। স্রেফ রাজনৈতিক বক্তব্য বলে এটাকে উড়িয়ে দেওয়া হলেও সংবিধানকে অগ্রাহ্য করা উচিত হয়নি বিএনপির। সরকার ও সরকার দল আওয়ামী লীগের রাজনীতি ও ভূমিকা নিয়ে তাদের প্রশ্ন ও বিরোধ থাকতে পারে কিন্তু সংবিধানকে অগ্রাহ্য করার অধিকার তারা নিশ্চয়ই রাখে না। সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গঠনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে রাষ্ট্রপতির। এর ব্যত্যয় হওয়ার সুযোগ নেই। এর ব্যত্যয় মানে সাংবিধানিক সঙ্কট। ইসি গঠনকে ‘নাটক’ বলা তাই সংবিধানকে অবমাননা। বিএনপির কাছে শব্দচয়নে দায়িত্বশীলতা প্রত্যাশা করি।

নতুন নির্বাচন কমিশন বিএনপিকে ক্ষমতায় এনে দিলে তবেই প্রমাণ হবে তারা নিরপেক্ষ—এমনও ভাবনা অনেকের। এভাবে যারা ভাবছেন তারা ভাবুক। তবে এটা নিরপেক্ষতার সূচক নয়। কে এম নুরুল হুদা আর কাজী হাবিবুল আউয়াল এক নয় বলেই বিশ্বাস করতে চাই। কে এম নুরুল হুদা যে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে নির্বাচন কমিশনকে ফেলে গেছেন সেখান থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশনকে। ‘আস্থাহীনতার স্মারক’ হয়ে পড়া নির্বাচন কমিশনের প্রতি মানুষের আস্থা ফেরানো হবে নতুন গঠিত কমিশনের প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ। কাজটা কঠিন। তবে কঠিন হলেও সম্ভব বলেই বিশ্বাস করতে চাই।

লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক