মাতৃভাষা মানুষের কাছে একটি গৌরবময় জায়গা

সেলিনা হোসেন প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২২, ০২:২১ পিএম

বিশ্বের মানুষের কাছে তার মাতৃভাষা একটি গৌরবময় জায়গা। যে জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা মর্যাদার আসনে দাঁড়াতে পারে না, সে জনগোষ্ঠী অনবরত চেষ্টা করে উন্নত হতে, পারে না। বিশ্বজুড়ে এমন ঘটনা অনেক ঘটেছে, সেটা আমরা জানি। ছোট ছোট দেশগুলোতে ঔপনিবেশিক শাসনক্ষমতা বলবৎ রেখেছিল তারা সেই সব জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষাকে বিলুপ্ত করে দিয়ে, নিজের মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠিত করেছিল তাদের জীবনে।

নানা মানুষের সঙ্গে পরিচিত হলে তাকে জিজ্ঞেস করতাম, তার মাতৃভাষা কী? একবার ইউনেসকোর একটি মিটিংয়ে আমি আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে আমার পাশে একজন নারী খুব চমৎকার ফরাসি ভাষা বলছিলেন। কিন্তু তার দেশ আফ্রিকার কোনো একটি ছোট রাষ্ট্র। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার মাতৃভাষা কোনটা? তিনি বললেন, “আমার মাতৃভাষার মর্যাদা আমরা হারিয়েছি। কারণ, আমাদের দেশটি ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক দেশ হিসেবে অনেক দিন ধরে তাদের অধীনে চলে আসছে। তারা আমাদের বাধ্য করে ফরাসি ভাষা শেখার জন্য।”
আমি তখন হেসে বললাম, “বাহ্ আপনি তো চমৎকার ফরাসি ভাষা বলেন।” তিনি বললেন, “শিখতে বাধ্য করলে আমাকে তো বলতেই হবে। এখানে এসে আমি বলেছি, কিন্তু মাতৃভাষার মর্যাদার গৌরবটি আমার নেই, এটা আমি মানতে পারি না।” আমি দেখলাম তার মুখটা ম্রিয়মাণ হয়ে গেল।

আজকের দিনে আমি এই সব কিছু ভাবি। ১৯৯৯ সালে ইউনেসকো ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। তখন ইউনেসকোর মহাপরিচালক ছিলেন ইরিনারোকভা। তিনি এই ঘোষণাটা দিয়েছিলেন। আমাদের দেশের বেশ কিছু মানুষ ইউনেসকোর কাছে এই আবেদন করেছিল যে, বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদা দেওয়ার জন্য। তিনি সেই জায়গাটি স্বীকার করে নিয়ে সেই মর্যাদার জায়গা দিয়েছেন; ২১শে ফেব্রুয়ারিকে বিশ্বজোড়া মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। 

সুতরাং আমরা ২১শে ফেব্রুয়ারি নিয়ে যে গৌরবময় জায়গা ধারণ করি, সে জায়গাটি ইউনেসকোর মাধ্যমে আজকে বিশ্বের সব দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে। এই গৌরব, এই অর্জন নিয়ে আমাদের যাত্রা অব্যাহত থাকবে। আমাদের আগামী দিনের প্রজন্ম এই অব্যাহত যাত্রাকে নানাভাবে বাড়াতে পারবে। তাদের প্রতি আমি একটি কথা বলতে চাই এবং আমাদের এখন যারা আছেন, তাদের জন্য বলতে চাই যে, আমাদের সাহিত্যকে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করে বিদেশি পাঠকের কাছে পৌঁছে দিলে আমাদের আর একটি গৌরবময় অর্জন হবে। আমি মনে করি, ৪৭-পরবর্তী সময় থেকে আমরা যেভাবে একটি সাহিত্যের স্রোত নির্মাণ করেছি, বাংলা ভাষার সেই স্রোতটাকে বিশ্বের মানুষ গভীর মর্যাদার সঙ্গে দেখবে, এটা আমার একটি বড় প্রত্যাশা।

লেখক : কথাসাহিত্যিক, সম্পাদক, সংবাদ প্রকাশ