বাংলাদেশের রাজনীতি এখন লবিস্ট নিয়োগ বিতর্কে ঘুরপাক খাচ্ছে। গত এক মাসের বেশি সময় ধরে দেশের দুই প্রধান ও যুযুধান রাজনৈতিক দল- আওয়ামী লীগ ও বিএনপি- প্রতিপক্ষকে বিপদে ফেলতে যুক্তরাষ্ট্রে কোন দল কখন কয়টা এবং কত টাকা খরচ করে লবিস্ট নিয়োগ দিয়েছে, সেই হিসাব দিয়ে যাচ্ছে। আর এ নিয়ে গণমাধ্যমও সরগরম থাকছে।
লবিস্ট মানে তদবিরকারী। যুক্তরাষ্ট্রে এটি একটি বৈধ পেশা। এ ধরনের ফার্মগুলোর কাজ হলো মার্কিন সরকারের কোনো পলিসিকে তাদের ক্লায়েন্টের স্বার্থের অনুকূলে নিয়ে আসার জন্য চেষ্টা চালানো। বিনিময়ে তারা ক্লায়েন্টের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ফি পায়। ক্লায়েন্ট কোনো একজন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী হতে পারে, আবার রাষ্ট্রও হতে পারে।
বিতর্কটির সূত্রপাত ঘটে গত ডিসেম্বর মাসে। ওই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশের র্যাব এবং তার বর্তমান ও সাবেক সাত কর্মকর্তার ওপর নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেয়। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়া হয়, বাংলাদেশে ‘গুরুতর’ মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে এরা যুক্ত।
ঘটনাটা ঘটে অনেকটা আকস্মিকভাবে, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় আউট অব দ্য ব্লু। খুব স্বাভাবিকভাবেই এতে সরকার বিচলিত হয়ে পড়ে। চারদিকে গুজব ছড়িয়ে পড়ে, বিশেষত বিএনপি-সমর্থকদের তরফ থেকে তা ছড়ানো হয় যে, একই অভিযোগে ইতিমধ্যে সদ্য সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের মার্কিন ভিসা বাতিল হয়েছে, তিনি চেষ্টা করেও যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে পারেননি। আরও শোনা যায়, তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমদ পলকও ভিসা থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে পারেননি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে খুব দ্রুতই জানানো হয় যে, এগুলো সবই গুজব মাত্র; জেনারেল আজিজ বা প্রতিমন্ত্রী পলকের সঙ্গে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। তারপরও নানা মহল থেকে প্রচার করা হয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র ও ট্রেজারি বিভাগ আরও অন্তত ৫৬৩ জন বাংলাদেশি কর্মকর্তার নাম তালিকাভুক্ত করেছে, যাদের ওপর ধাপে ধাপে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে। অবশ্য ১ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী কংগ্রেসম্যান এবং বৈদেশিক কার্যক্রমবিষয়ক হাউস কমিটির সভাপতি গ্রেগরি ডব্লিউ মিকস যখন ঘোষণা করেন যে, বাংলাদেশের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পরিকল্পনা তাদের নেই, তখন এসব গুজবে একটু ভাটা পড়ে।
গুজবের রাশে টান পড়লেও সরকার কিন্তু বসে থাকেনি। র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার পেছনে অনুঘটক হিসেবে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের প্রচারণার কথা বলা হলেও আর কে কে এর জন্য কাজ করেছে, তা বের করার চেষ্টায় লিপ্ত হয় তারা। তারই ফল হিসেবে বেরিয়ে আসে বিএনপি ও তার প্রধান রাজনৈতিক মিত্র বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর লবিস্ট নিয়োগের কথা।
সরকারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ করা হয় যে, যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধসহ আরও কিছু ইস্যুতে বিএনপি-জামায়াত যুক্তরাষ্ট্রে ৮টি লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ দেয় এবং গত দশ বছরে এ জন্য প্রায় ৪০ কোটি টাকা খরচ করে। বিএনপি নেতারা এসব অভিযোগ অস্বীকার করলেও এটা বলেন যে, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার এখন আর কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, এগুলো এখন ‘আন্তর্জাতিক’ ইস্যু। অতএব আন্তর্জাতিক মহলকে এসব বিষয়ে ‘অবহিত’ করা এবং তাদেরকে ‘এঙ্গেজ’ করার চেষ্টা করার মধ্যে কোনো দোষ নেই। সাংবাদিকদের খোঁচাখুঁচিতে সাম্প্রতিক এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর তো মুখ ফসকে বলেই ফেলেন, ‘বিএনপি লবিস্ট নিয়োগ করেছে গণতন্ত্রকে রক্ষার জন্য, মানবাধিকার রক্ষা করার জন্য।’
বিএনপি নেতৃবৃন্দ অবশ্য এখানেই থেমে থাকেননি। তাঁরা পাল্টা অভিযোগ করেন যে, সরকার বরং ‘জনগণের করের টাকায়’ তার ‘অপকর্ম’ আড়াল করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করেছে। সরকার জবাবে বলছে, তারা বিএনপি-জামায়াতের ‘অপপ্রচার’ ও ‘রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ধ্বংসের’ চেষ্টার মুখে ‘সঠিক’ বিষয়টি তুলে ধরার জন্য মার্কিন একটি পিআর ফার্মকে নিয়োগ দিয়েছে।
বিএনপির পক্ষ থেকে এটাও বলা হয় যে, আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকার সময়েও যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ দিয়েছিল। এবং সেটা তারা করেছিল তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সরকারকে জঙ্গিবাদের ‘পৃষ্ঠপোষক’ বলে পরিচিত করানোর জন্য, যদিও আওয়ামী লীগের তরফ থেকে এমন অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।
উভয় পক্ষের এ কথা চালাচালির মধ্যে অন্তত এটা স্পষ্ট যে, আমাদের সরকার ও তার বিরোধী পক্ষ- এবার যে দলই সরকার বা বিরোধী দলে থাকুক, বরাবরই তাদের ক্ষমতায় থাকা বা ক্ষমতায় যাওয়ার লক্ষ্য অর্জনে আমাদের দেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবকে কাজে লাগাতে চেয়েছে। এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বহির্বিশ্বের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব কিছুটা দুর্বল হলেও আমাদের নেতাদের সে ধরনের প্রয়াস থেমে নেই।
দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো রাষ্ট্রকে জড়িত করার এ প্রয়াসকে খুব সহজেই দলগুলোর জনবিচ্ছিন্নতার প্রকাশ হিসেবে দেখা যায়। কেউ কেউ হয়তো আরেকটু বেড়ে এটাকে দলগুলোর রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বও বলতে পারেন। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেটা তা হলো এমন প্রয়াস খাল কেটে কুমির আনার সমতুল্য। একটা কথা দশকের পর দশক ধরে গোটা দুনিয়ায় প্রচলিত আছে যে, যুক্তরাষ্ট্র যার বন্ধু তার আর শত্রুর দরকার নেই। কথাটার মর্ম ইতিমধ্যে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে ইরাক, সিরিয়ার মতো দেশ। ভিয়েতনাম ও হাল আমলে আফগানিস্তানেও ওরা গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলেই গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত দুটো দেশের জনগণকেই মরণপণ যুদ্ধের মাধ্যমে নিজের মতো করে চলার স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়েছে। বিশ্বে একটা দেশও দেখানো যাবে না, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র তার পছন্দের সরকার বসিয়ে জনগণের গণতান্ত্রিক ও মানবিক অধিকার নিশ্চিত করেনি।
সরকারবিরোধী মহলের কেউ কেউ যুক্তি দিচ্ছেন যে, তারা এত বছর ধরে চিৎকার করেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ করাতে পারেননি, যা র্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর থেকে ‘বন্ধ’ রয়েছে। আমাদের সুশীল সমাজের নেতৃস্থানীয় কোনো কোনো ব্যক্তিও একই সুরে কথা বলছেন। তাঁদের এমন সব বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। এখানকার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্যও তা এক অশনিসংকেত বটে।
কারণ যাঁদের হাতে আমাদের রাজনীতি ও সমাজের নেতৃত্ব পড়েছে, তাঁদের এটুকু বোধ নেই যে, আমার গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের লড়াই আমাকেই করতে হবে, কস্মিনকালেও তা অন্যে করে দেবে না। তাছাড়া যেকোনো রাষ্ট্রে, তা ধনতান্ত্রিক বা সমাজতান্ত্রিক যা-ই হোক না কেন, শাসকের স্বাভাবিক প্রবণতা হলো সুযোগ পেলেই জবরদস্তির মাধ্যমে তার সিদ্ধান্তসমূহ জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া। যে দেশের জনগণ যতটুকু রাষ্ট্রের এ প্রবণতা সম্পর্কে সচেতন এবং নিজেদের গণতান্ত্রিক ও মানবিক অধিকার নিয়ে সোচ্চার, সে দেশের সরকার ততটুকু গণতান্ত্রিক হয়। তাই ক্ষমতাপ্রত্যাশী যে রাজনৈতিক দল জনগণকে সরকারের ভুল- বা তাদের ভাষায় গণবিরোধী- নীতির বিরুদ্ধে সংগঠিত না করে শর্টকাট পন্থায় বিশ্বের স্বঘোষিত মোড়লদের সহায়তায় কার্যসিদ্ধ করতে চায়, তারা নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গের আয়োজনে লিপ্ত আছেন এমনটাই হলফ করে বলা যায়।
লেখক: সাংবাদিক