কী বলা যায় নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের এই টেস্ট জয়কে? অবিস্মরণীয়-অকল্পনীয়-অসাধারণ! নাকি বলবেন ঐতিহাসিক? হ্যাঁ, ঐতিহাসিক তো বটেই। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে প্রথম টেস্ট জয়। সেটা কোন নিউজিল্যান্ড? যাদের মাথায় টেস্ট ক্রিকেটে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের মুকুট। তাদের মাটিতে তাদের হারানো কঠিন। অ-নে-ক কঠিন কাজ। সেই কাজটাই কিনা কত সহজে করল বাংলাদশ! বিস্ময় জাগানো আর একটা তথ্য ফুটনোট হিসেবে যোগ করতেই হচ্ছে: গত এগারো বছরে এই উপমহাদেশের কোনো দল নিউজিল্যান্ডের মাটিতে তাদের হারাতে পারেনি। তাই এই জয়ের মধ্য দিয়ে ক্রিকেট বিশ্বে বড় একটা বারতাও দিল বাংলাদেশ। অনেক বিপন্নতাকে পেছনে ফেলে, অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও বাংলাদেশ জিততে পারে। জিততে শিখেছে।
তাহলে কি ধুলো জমে থাকা, দীর্ঘশ্বাসে ভরা, পুরোনো রূপকথার শেষ পাতা পড়া হয়ে গেল! বাংলাদেশ ক্রিকেটের নতুন ক্রিকেট রূপকথা বইয়ের প্রথম পাতা লেখা হলো? নতুন বছরে সবার আগে নতুন সূর্যকে বরণ করে নিয়েছিল যারা, সেই নিউজিল্যান্ডেই কিনা বাংলাদেশ ক্রিকেটের নতুন সূর্য উদয় হলো। বিশ্ব ক্রিকেট মিডিয়াও স্বীকার করছে, টেস্ট ক্রিকেটে নতুন রূপকথার এক দেশ হলো বাংলাদেশ।
বলবে না কেন! এই সিরিজ শুরুর আগে রাস্তাঘাটে ক্রিকেট-সংক্রান্ত যেকোনো আলোচনা শুনুন, কোনো তর্কটর্ক নেই। সবাই একমত। বাংলাদেশের এই দলের পক্ষে নিউজিল্যান্ডে কিছু করার সম্ভব নয়। গণমাধ্যম থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিষয়টাকে প্রায় রান্নাঘর পর্যন্ত ঢুকিয়ে দিয়েছিল—তামিম, সাকিব, মুস্তাফিজ, মাহমুদউল্ল্যাহ নেই। এই দল নিউজিল্যান্ডের সামনে দাঁড়াতেই পারবে না। কিন্তু তারাই কিনা পাঁচ দিনের কোনো একটা সেশনেও স্বাগতিকদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দিল না!
টস জিতে নিউজিল্যান্ডকে ব্যাট করতে পাঠানো থেকে রূপকথার মতো শেষ করল টেস্টটা বাংলাদেশ। যে দল এই কাজটা করল, সেখানে বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের কোনো বড় তারকা নেই। আছেন একদল পেশাদার। যারা প্রত্যেকেই একসঙ্গে জিততে চেয়েছেন। লড়াই করেছেন। এবং জিতেছেন। এই জয়ের মধ্য দিয়ে একটা জিনিস প্রমাণ করেছে বাংলাদেশ, তারাও টেস্ট ক্রিকেট খেলতে পারে। জিততে পারে। টেলিভিশনের পর্দায় জয়ের মুহূর্তে এ দেশের খুব কম মানুষ চোখের পানি ধরে রাখতে পেরেছেন। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে কোনো জয় নেই। অবশেষে এই দীর্ঘশ্বাস স্তব্ধ হলো। তারপর দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের চোখ আবেগাশ্রুতে ভিজবে না কেন! নিউজিল্যান্ডের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার স্যার রিচার্ড হ্যাডলি তাদের এই দলটা নিয়ে বলেছিলেন, ‘নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসের সেরা দল। গত কয়েক বছরে তারা নিজেদের অন্যতম শক্তিশালী দলে পরিণত করেছে।’ সেই দলটার বিপক্ষে তাদের মাটিতে পাওয়া জয়টা বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ের খুব কাছাকাছি থাকবে অনেক দিন।
শুধু একটা টেস্ট জয় নয়। সঙ্গে একটা গ্যারান্টি কার্ডও পেয়েছে মুমিনুল হকের দল। দুই ম্যাচের এই টেস্ট সিরিজও তারা হারবে না। তারুণ্যে ভরপুর একঝাঁক ক্রিকেটারদের কাছে এ দেশের মানুষের প্রত্যাশা বেড়ে যাবে। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, আপনি সব ম্যাচ জিততে পারবেন না। অন্য দলও জিততে চাইবে। লড়াই করবে। তবে বিদেশের মাটিতে যে লড়াইটা বাংলাদেশ করল, তাতে আইসিসিরও টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের পয়েন্ট পদ্ধতি নিয়ে নতুন করে চিন্তা করা উচিত। বিদেশে টেস্ট জিতলে বাড়তি পয়েন্ট পাওয়া উচিত। হোক সেটা বাংলাদশে কিংবা অন্য যেকোনো দল।
বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী দেশে, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নত দেশের সরণিতে পা রাখল যখন, সেই সময় দেশের জন্য সবচেয়ে বড় সাফল্যের খবরটা এলো ক্রিকেট মাঠ থেকে। সেই সাফল্যকে ঐতিহাসিক কিংবা রূপকথা লেখার পরও মনে হচ্ছে, রূপকথা এক জিনিস, ইতিহাস অন্য জিনিস। ইতিহাস নিছকই দৈনন্দিন বিচারকে স্বীকৃতি দেয় না। ইতিহাস একটা দীর্ঘ সময়কে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে সেখান থেকে যুক্তির ছাল ছাড়ায়। বেঁধে দেয় কার কোথায় জায়গা। আবেগে প্রভাবিত হওয়ার উপায় নেই তার। বাংলাদেশের বড় বড় তারকারা দলে না থাকার পরও ছোটখাটো শান্ত মেজাজের অধিনায়ক মুমিনুল একঝাঁক নতুন তরুণ ক্রিকেটার নিয়ে বাংলাদেশকে যে সাফল্য এনে দিলেন, তার মাপকাঠিটা কী হবে? করপোরেট জগৎ, মিডিয়ার কাছে তার ‘ব্র্যান্ডভ্যালুটা তৈরি হলো না কেন! এই জায়গায় নিউজিল্যান্ড আর মুমিনুল একই জায়গায় দাঁড়িয়ে। নিউজিল্যান্ড এত ভালো টিম, কিন্তু তাদের বাজারদর নেই। মুমিনুল টেস্ট ক্রিকেটে যাত্রা শুরু করার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে রান করেই যাচ্ছেন, কিন্তু বোর্ড সভাপতির চোখেও তিনি কখনো কোনো সেরা ক্রিকেটারের মধ্যে নেই! এবার যদি তার সম্পর্কে বোর্ড ধারণা পাল্টায়। দুটো ম্যাচ বাঁচানো ইনিংস। দুটো ম্যাচ জেতানো ওয়ানডে ইনিংস। ভালো একটা স্পেল এটা বাংলাদেশ দলের অনেকেই করেছেন। কিন্তু কঠিন পরিস্থিতিতে, কঠিন জায়গা থেকে দলকে বের করে আনার কৃতিত্ব কে কয়বার করে দেখিয়েছেন, সেটাও বিবেচনার জন্য ইতিহাসের পাতাটা উল্টে দিলেন, মুমিনুলের এই দলটা। এখন সেটা পড়ে দেখার দায়িত্ব আমাদের। টি-টোয়েন্টি, ওয়ানডে ক্রিকেট আপনাকে অনেক বেশি এন্ডোর্সমেন্ট দেবে। রোজগার দেবে। অনেককে দিচ্ছে। কিন্তু বিশুদ্ধবাদীদের কাছে ক্রিকেট যুদ্ধের সবচেয়ে বড় কুরুক্ষেত্র—‘টেস্ট’। ইতিহাস সেখানেই খুঁজে বেড়ায় ক্রিকেট ‘পাণ্ডবদের’। টেস্ট ক্রিকেটের মাঝেই জীবনের চুম্বন খোঁজেন সত্যিকারের শুদ্ধ ক্রিকেটপ্রেমীরা।
ওমিক্রনের চোখ রাঙানির মাঝে নিউজিল্যান্ড থেকে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল গত পাঁচ দিন ধরে দারুণ এক বার্তা দিল। আমরা যা-ই করব উৎকর্ষ অর্জনের চেষ্টা করব। মনোভাবে ধারাবাহিক থাকব। আক্রমণাত্মক থাকব। তবে অযথা আক্রমণাত্মক হব না। বিপক্ষকে বাড়তি সম্মান দেখানোরও কোনো প্রয়োজন মনে করব না। তা না হলে, টেস্ট ক্রিকেটের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের এভাবে বিপন্ন করে, বে ওভালে কি টেস্ট জেতা সম্ভব হতো?
টেলিভিশনের পর্দায় বাংলাদেশের টেস্ট জয়টা দেখতে দেখতে বারবার বরিঠাকুরের কথাই মনে হচ্ছিল। যদিও বরীন্দ্র গবেষকরাও এখন এমন কোনো দাবি করেননি রবিঠাকুর ক্রিকেট নিয়ে তেমন কিছু লিখেছেন! কিন্তু এই টেস্টে বাংলাদেশকে দেখার পর মনে হলো, এই দলটার জয় মন্ত্র তো রবিঠাকুরই লিখে গেছেন: “চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির।”
ভয়শূন্য ক্রিকেটের ম্যানুয়েল ফলো করেই এই টেস্ট জিতল বাংলাদেশ।
লেখক: সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক