বিদায় ২০২১

রাতারাতি পাল্টাবে না কিছুই

তুষার আবদুল্লাহ প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৩০, ২০২১, ০৮:৪৩ এএম

স্কুলে ফল ঘোষণার আগে মনে জোয়ার ভাটা চলতো। ফল ভালো হবে কি? যদি খারাপ হয়, কেন খারাপ হবে তার  পক্ষে অনেক যুক্তি চলে আসতো সামনে। স্পষ্ট দেখতে পেতাম-সারা বছর পড়ালেখাসহ জীবনে কোথায় কোথায় ফাঁকি দিয়েছি। তখন নিজে নিজেই শপথ নিতাম, এবার কোনভাবে  উৎরে যাই, আগামীতে ভুল সংশোধন করে নেবো। সঙ্গে বপন করেছি নতুন স্বপ্নবীজ। ফল যাই প্রকাশ হোক, অভ্যাস বা জীবন কিন্তু উল্লেখ করার মতো সংশোধন করা হয় না। ফলে বছর ঘুরে ফল প্রকাশের আগে পুরাতন হা পিত্যেস। ব্যক্তির মতো আমাদের জাতীয় জীবনও একই হা পিত্যেসের চক্রে ঘুরপাক খাচ্ছে। প্রতিবার বছর শেষে এসে নিজেদের ভুল, সংকট থেকে নতুন বছরে মুক্তি পাওয়ার শপথ নেই, স্বপ্ন দেখি। কিন্তু ফলাফল সেই একই দীর্ঘশ্বাস-আশা পূর্ণ হলো না।

ব্যক্তিকে সরিয়ে যদি আমরা বাংলাদেশকে সামনে আনি, আমরা কবে, কোন বছর রাজনৈতিক সংকটের বাইরে ছিলাম? ভোট ভালো হোক মন্দ হোক, রাজপথে আন্দোলন থাকুক কিংবা না থাকুক। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব কেবল বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে অসহিষ্ণুতা। রাজনীতি রাজনীতিবীদদের হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার যে প্রক্রিয়া, তা আরো তীব্র হচ্ছে। এই দুই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সমাজকেও প্রভাবিত করছে। জনগণের মধ্যে সংক্রমিত হবার কারণে, সামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে। দুর্নীতির ব্যাধি থেকে মুক্ত হবার নানা রকম প্রতিশেধক রাষ্ট্র আবিষ্কার বা প্রয়োগ করলেও, গোষ্ঠীগত নৈতিকতা নিম্নগামী হওয়ার কারণে, সব প্রতিশেধকই অকার্যকর বলা চলে।

রাষ্ট্রের ঘরে যখন স্বচ্ছ্বলতা আসতে শুরু করলো, তখন থেকেই রাজনৈতিক আদর্শ ও নৈতিক অবস্থান একেবারে ব্যক্তি অবধি আলগা হতে শুরু করে। বাঁধন আলগা করতে করতে আমরা লাখপতি হলাম, কোটিপতি হলাম। নিত্য বাড়ছে কোটিপতির সংখ্যা। কোটিপতি এখন মামুলি বিষয়। শত, সহস্র কোটি ছাড়া ধোপে টেকে না আজকাল। এই যে লাখ পেরিয়ে কোটির ঘরে বানের জলের মতো ঢুকে পড়ছি আমরা, তা কতোটা শুদ্ধ ভাবে, নৈতিকতা মেনে? যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশের সুষম অর্থনৈতিক পুষ্টির প্রয়োজন ছিল এবং আছে। সেই লক্ষ্যেই অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যে কৃষির ওপর একক ভরসায় না থেকে, বাংলাদেশ শিল্প এবং অধুনা প্রযুক্তি নির্ভর অর্থনীতিকে গ্রহণ করেছে। কিন্তু সেই অর্থনীতির যে প্রবৃদ্ধি তার আয় বা রোজগারের অনেকটা টাকা উড়ে যাচ্ছে ভিনদেশে। টাকা খাটানো বা রাখার জন্য  এবং জীবন যাপনের জন্যে রাজনীতিবীদ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী এবং উঠতি ধনীরা আর নিজ দেশকে নিরপাদ মনে করছেন না। বা তাদের রুচিতে টিকছে না বাংলাদেশ। কেন?

ফিরে যেতে হয় সেই পুরনো কারণ বা অজুহাতেই। ব্যক্তির কর্মজীবন থেকে শুরু গোষ্ঠীগত অনুশীলনে রাজনৈতিক আদর্শ অনুপস্থিত। দর কষাকষি, লাভ লোকসান হিসেব এখন ব্যক্তি কেন্দ্রিক। রাজনীতির পথচিত্রও তাই। তিন দশক আগেও সাংস্কৃতিক আন্দোলন, চর্চা এগিয়ে যেত রাজনৈতিক আদর্শকে অবলম্বন করেই। এখন সংস্কৃতি হয়েছে পণ্য উৎপাদক বা বিপননের মর্জি মতো প্রকাশের বিষয়। এখানে সংস্কৃতিকর্মী তৈরি হচ্ছে না। তৈরি করা হচ্ছে তারকা। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা যখন নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়লেন, তারা ভুল গন্তব্যে রওনা হলেন, তখন বাংলাদেশ, মাতৃভূমি এই বিষয়গুলো আর ব্যক্তি বা সমষ্টির ভাবনায় আবশ্যিক বিষয় থাকলো না।

আমরা যখন ২০২১ থেকে ২০২২ এ প্রবেশ করছি, তখন ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে যাওয়া মাত্রই ব্যক্তি বা জাতীয় জীবনে কোন ম্যাজিক দেখা দিবে না। যার ফলে সব ভুল, সব সংকট শুধরে নিয়ে, মেরামত করে কোন সুখনগরে আমরা  বসবাস শুরু করবো, এটা অলীক কল্পনা। দিন আমাদের গতকালের মতোই যাবে। এক রাত্রিতে বদল হবে না কিছুই। অর্থনীতি লড়াই করছে করোনাকালের বিপর্যয়ের সঙ্গে। অনেক নিম্ন ও উচ্চ মধ্যবিত্ত যেমন গরিবের খাতায় নাম লিখিয়েছে কাজ ও ব্যবসা হারিয়ে, তেমনি এই মন্দাকালেও দেশে কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। এই সংবাদ আমাদের স্পষ্ট করেই বলে দিচ্ছে রিজার্ভ, রেমিট্যান্স, মাথাপিছু আয় যতোই বাড়ুক, অসাম্যতা বাড়ছে। সম্পদের সুষ্ঠু  বন্টন নেই। 

টাকা অনেকের কাছে যাচ্ছে না, যাচ্ছে কতিপয়ের কাছে। এখন অসাম্যতার সংকট থেকে বেরিয়ে আসবো কিভাবে? আসতে তো হবেই, না হলে সমষ্টির চেতনায় বাংলাদেশকে গ্রথিত করা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, একাত্তর, ঊণসত্তর, বায়ান্ন শুধু দিবস ও ইভেন্টে পরিণত হতে থাকবে। ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি রাজনীতি বিমুখ হওয়া যাবে না। আদর্শগত রাজনীতির কাছে ফিরতে হবে। বাংলাদেশ নির্মিত হয়েছিল যে রাজনৈতিক প্রণোদণায় তার সঙ্গে ছিল সাংস্কৃতিক আন্দোলন বা চর্চার মিশেল। সেই রেসিপি বা প্রক্রিয়ায় ফিরে গিয়ে আমাদের পরিশোধিত হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই এবং অবশ্যই সেটা চলতি সময়কে স্বীকৃতি দিয়েই।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট