আগামী ফেব্রুয়ারিতে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের (ইসি) মেয়াদ শেষ হচ্ছে। নতুন ইসি গঠনে সার্চ কমিটি গঠনের লক্ষ্যে সংলাপ শুরু করেছেন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আবদুল হামিদ। গত ২০ ডিসেম্বর থেকে আমন্ত্রিত নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে শুরু হয়েছে রাষ্ট্রপতির সংলাপ। প্রথম দিনেই সংলাপে গেছে জাতীয় পার্টি। দ্বিতীয় দিন সংলাপ করে এসেছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। এরই মধ্যে আরও কিছু রাজনৈতিক দল সংলাপে অংশ নিয়েছে। সূচিতে রয়েছে আরও অনেকগুলো দল। তারাও যাবে, তাদের বক্তব্য শুনবেন রাষ্ট্রপতি, প্রস্তাবও হাতে নেবেন। সার্চ কমিটি ও নির্বাচন কমিশনে কাদের রাখা যায়, এমন নামও যাচ্ছে রাষ্ট্রপতির কাছে। এই নামগুলো প্রকাশ্য হয় না সাধারণত, জরুরিও নয় সম্ভবত। তবে যেখানে ‘রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তার’ কিছু থাকে না, সেখানে কেন এমন গোপনীয়তা?
ইতিহাস বলে গত দুই নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটির জন্যে রাষ্ট্রপতির সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দুইবার যথাক্রমে কাজী রকিব উদ্দীন আহমেদ ও কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছিল। এই দুই ইসি কীরকম নির্বাচন জাতিকে উপহার দিয়েছিল সেটা সবাই জানে। গত দুই জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা আছে। ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়া, দিনের ভোটের কিছু অংশ রাতে হয়ে যাওয়ার যে অভিযোগ আছে, সেগুলো আর যাই হোক সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কমিশনের সাফল্যের পরিচয় বহন করেনি। সার্চ কমিটির মাধ্যমে যে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছিল সে কমিশনগুলো যে নির্বাচন উপযোগী কোনো ব্যবস্থা নয়, সেটা ইতোমধ্যেই প্রমাণিত। তবু এবারও সেই একই পথে হেঁটেছে সরকার। এবারও সার্চ কমিটির মাধ্যমে ইসি গঠনের তোড়জোড় চলছে। যার শুরুটা রাষ্ট্রপতির সংলাপ দিয়েই। যদিও নির্দিষ্ট আইন না থাকা দেশে সার্চ কমিটির মাধ্যমে ইসি গঠন সংবিধানসম্মত পন্থা নয়, তবু একই পদ্ধতি এবারও।
প্রশ্ন—তবে কি নির্বাচন কমিশন গঠন হবে না? হবে, হতে হবে। এবং এটা অবশ্যই সাংবিধানিক উপায়ে। কারণ আমাদের সংবিধান ‘নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠা’ অংশের ১১৮(১) অনুচ্ছেদে বলছে—‘প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া এবং রাষ্ট্রপতি সময়ে সময়ে যেরূপ নির্দেশ করিবেন, সেইরূপ সংখ্যক অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোন আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ করিবেন।’ নির্বাচন কমিশন গঠনে আইনের বিধানাবলি প্রতিপালনের কথা সংবিধানে উল্লেখ থাকলেও দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে, পঞ্চাশ বছরের বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্যে কোনো আইন নেই। কোনো সরকারই এই আইন প্রণয়ন করেনি, বর্তমান সরকার টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও এই আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা প্রবলভাবে অনুভব করেনি। পূর্বের অভিজ্ঞতায় বলা যায়, ফলপ্রসূ না হওয়া একটা পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে এবারও। অথচ সংসদে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সদস্য থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের জন্যে এ বিষয়ে আইন প্রণয়নে খুব বেশি বেগ পাওয়ার কথা ছিল না!
সংবিধান বলছে নির্বাচন কমিশনবিষয়ক আইনের বিধানাবলি-সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন। রাষ্ট্রপতির দায়িত্বের একটা অংশ সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ বলা আছে—‘এই সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাঁহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন : তবে শর্ত থাকে যে, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে আদৌ কোন পরামর্শদান করিয়াছেন কি না এবং করিয়া থাকিলে কি পরামর্শ দান করিয়াছেন, কোন আদালত সেই সম্পর্কে কোন প্রশ্নের তদন্ত করিতে পারিবেন না।’
তাহলে দুই কাজ ছাড়া অন্য নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে যেখানে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শমত কাজ করতে হয় সেখানে নির্বাচন কমিশনের জন্যে সার্চ কমিটি গঠনে রাষ্ট্রপতির যে সংলাপ, সেটা আসলে কার সার্চ কমিটি? প্রশ্ন করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। এখানে যদি আইন থাকত তবে এ প্রশ্নের সুযোগ থাকত না।
সাবেক প্রধান বিচারপতি ও বিলুপ্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার সাবেক প্রধান উপদেষ্টা শাহাবুদ্দিন আহমেদ একবার আক্ষেপ করে বলেছিলেন—‘জানাজা পড়া আর কিছু রুটিন দায়িত্ব পালন করা ছাড়া রাষ্ট্রপতির কোনো ভূমিকা নেই।’ শাহাবুদ্দিন আহমেদ আওয়ামী লীগের মনোনয়নে রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। তিনি নিশ্চয়ই খুব বেশি বাড়িয়ে কিছু বলেননি। এছাড়াও আমরা দেখেছি বিএনপির মনোনয়নে রাষ্ট্রপতি হওয়া ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর পরিণতি। মাত্র সাত মাস সাত দিনের মাথায় বিএনপির চাপে তাকে তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিতে হয়েছিল। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে তার সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন না করা, বাণীতে জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে উল্লেখ না করা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের অনুমোদিত একটা ফাইলে স্বাক্ষর না করাসহ আরও অনেক দলীয় অভিযোগে তাকে কী পরিমাণ হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে সেটা সকলেই জানে। আওয়ামী লীগ সরকার হয়ত এমন কিছু কোনো রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রে করেনি। তবে বদরুদ্দোজা চৌধুরীর পরিণতি ও বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদের মন্তব্য নিশ্চয়ই অনেক প্রশ্ন ও অনেক কিছুর ইঙ্গিত দেয়!
নির্বাচন কমিশন গঠনবিষয়ক আইন নেই, তাই সার্চ কমিটি গঠনে রাষ্ট্রপতি সংলাপ—তৃতীয়বারের মতো এমন ঘটনা ঘটে চলেছে। আইন প্রণয়নের তেমন উদ্যোগও দৃশ্যমান নয়। এমনটা কি চলতেই থাকবে? সংলাপ, সার্চ কমিটি, রাজনৈতিক দলগুলোর নাম প্রস্তাবের যে ধারা এবং এরপর ইসি গঠন, বিতর্ক, চলমান এসবের মাধ্যমে কি সংবিধানকেই পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে না? যদিও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক কিছুদিন আগে বলেছিলেন, আগামী দুই অধিবেশনের মধ্যে ইসি গঠনবিষয়ক আইন সংসদে তোলা হবে। বর্তমান কমিশনের মেয়াদের আগে এই আইন প্রণয়ন সম্ভব হবে না বলে আগের দুইবারের মতো এবারও সার্চ কমিটির মাধ্যমে কমিশন গঠনের কথা জানিয়েছেন মন্ত্রী।
রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে ইসিতে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বঙ্গভবনে যাচ্ছেন, কথা বলছেন, নিজেদের প্রস্তাব দিচ্ছেন, নাম প্রস্তাব করছেন, ফিরে এসে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলছেন—এমনই চলছে। আসছে দিনগুলোতে এমনই হবে। এরপর সার্চ কমিটির পথ ধরে নিয়োগ দেওয়া হবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অপরাপর কমিশনাররা—এটাই ভবিতব্য। এর আগেও এমনটা ঘটেছিল। নির্বাচন কমিশন নিয়ে যতটা আলোচনার দরকার ছিল দেশে, তেমনটা নেই। এতে করে সার্চ কমিটির বিষয়টি অনুশীলনের পর্যায়ে চলে গেছে। অথচ এমনটা হওয়া উচিত ছিল না।
নির্বাচন কমিশন ও কমিশনাররা সাংবিধানিক পদ-প্রতিষ্ঠান। সার্চ কমিটি গঠনে যে সংলাপ সেখানে নামের প্রস্তাবদাতারা রাজনৈতিক নেতাই। এই রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের বলয়ের লোকদের, এমনকি দলীয় নেতাদের আত্মীয়স্বজনের নামও প্রস্তাব করে আসছেন বলে গণমাধ্যমে প্রকাশ হচ্ছে। এসবের মাধ্যমে কি প্রকৃত নির্দলীয়-নিরপেক্ষ শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন সম্ভব? এসবের মাধ্যমে কি ‘প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ’ অনুযায়ী নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন সম্ভব?
সংবিধানে উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ইসি গঠনে আইন নেই দেশে। গত দুইবার ইসি গঠিত হয়েছিল সার্চ কমিটির মাধ্যমে। এবারও একই পদ্ধতি। এগুলো সংবিধান নির্দেশিত পন্থা বলে বিশ্বাস করা লোকের অভাব আছে দেশে। তাই সরকারের উচিত হবে দ্রুততার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আইন প্রণয়ন করে নেওয়া। আইন হয়ে গেলেই যে একটা শক্তিশালী ইসি গঠিত হয়ে যাবে এমনটা এখনই বলা না গেলেও এর মাধ্যমে নিশ্চয়ই কিছু পদ্ধতি, বিধিনিষেধ এবং সত্যিকার যোগ্য লোকের সন্ধানের পথ তো খুলবে, যা নিয়মতান্ত্রিক। নির্বাচন কমিশনের প্রতি মানুষের আস্থা ফেরানোর পথ দেখাতে পারে একটা আইন। ক্রম-হতাশায় ডুবতে থাকা নাগরিকের না হয় ওটাই হোক আপাত আস্থা ফেরানোর পথ!
লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক