সম্প্রতি তারকা সমৃদ্ধ একটি কৃষ্ণ-প্রহসনমূলক ছবি মুক্তি পেয়েছে— ‘ডোন্ট লুক আপ’, ছবিতে দেখা যায় পৃথিবীর দিকে পর্বতপ্রমাণ এক ধূমকেতু ধেয়ে আসছে, মাস ছয়েকের ভেতর পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। দুজন মার্কিন গবেষক সেটি দেখতে পেয়ে সরকারের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে দৌঁড়ে যায়, সহযোগিতা চায়। কিন্তু দেখা গেল মার্কিন সরকার দুনিয়া ধ্বংস নিয়ে চিন্তিত নয়, তারা নির্বাচন, ভাবমূর্তি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের দিকেই বেশি মনোযোগী। কিন্তু গবেষকরা বলছেন, এসকল কিছুই অর্থহীন যদি পৃথিবী না থাকে। কেউ তাদের কথা পাত্তা দেয় না। না রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, না গণমাধ্যম, না জনগণ। মার্কিন প্রশাসন পুরো বিষয়টিকে নিজেদের স্বার্থের সাথে সংশ্লিষ্ট করে ভাবতে শুরু করে, আর তার সাথে যুক্ত হয় দুনিয়ার তিন নম্বর এক ধনী, সে প্রযুক্তি বিক্রি করলেও নিজেকে ব্যবসায়ী ভাবতে নারাজ। তো পরিকল্পনা হয় ধূমকেতু থেকে আহৃত খনিজ পদার্থ বিক্রি করে তারা আরো ধনী হবে। কাজেই ধূমকেতুকে তারা সময় থাকতে আর ধ্বংস করে না। ওদিকে আমজনতা তো আর এই পরিকল্পনার কথা জানে না, তাদের প্রশ্ন, কেন সরকার কিছু করছে না! এক পর্যায়ে তরুণ গবেষক কেইট ডেবিয়াস্কি (জেনিফার লরেন্স) এই প্রশ্নের জবাব দেয়, সে বলে— “আপনারা কি জানতে চান আসলেই কী হচ্ছে? ওরা ওই ধূমকেতুর ভেতর বিশাল হীরা-জহরত আর বিরল বিষ্ঠা পেয়েছে। কাজেই ওরা সেটাকে পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়তে দিতে চায়, যেন কিছু ধনী লোক আরো জঘন্যরকম ধনী হতে পারে।”
লোভের পরিণামে যা হওয়ার, তাই হয়। ধ্বংস হয় পৃথিবী। সকলেরই প্রাণ যায়, আগে আর পরে। আসলে পৃথিবী তো ধ্বংস হয় না, নিশ্চিহ্ন হয় মানুষসহ প্রাণীকূল, মানুষ না থাকলে আসলে পৃথিবীও থাকে না। কারণ প্রাণীকূলের ভেতর মানুষই একমাত্র, যারা পৃথিবীর ইতিহাসকে লিপিবদ্ধ করতে পারে। প্রতিদিন যে খবর আমাদের সামনে আসে সেগুলোও ইতিহাস তৈরির উপাদান বটে। এবং সেই উপাদানে উল্লিখিত ছবিটির মতোই আমরা দেখি লোভ, মুনাফা, আর মৃত্যু। আর দেখি সত্যকে না দেখার ভান। ‘ডোন্ট লুক আপ’ ছবিটির বক্তব্য হলো: যা বাস্তবতা, সেটার দিকে তাকাবেন না। বাস্তবতা থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখুন, মরলে মরবেন, তাতে কি এসে যায়, পয়সা বানানোই আসল ব্যাপার!
২৪ ডিসেম্বর সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডে ৪১জনের মৃত্যু ও অর্ধশতাধিক মানুষ নিখোঁজ হওয়ার পর খবরে জানা যায়, ৫৫০ অর্শ্বশক্তির দুটি ইঞ্জিন পাল্টে বসানো হয় ৭২০ অর্শ্বশক্তির দুটো ইঞ্জিন। শুধু তাই নয়, ইঞ্জিন পাল্টানোর পর ‘ট্রায়াল ট্রিপে’ই নেওয়া হয় ঘোষণাকৃত ৩১০ জনেরও চেয়েও বেশি যাত্রী। (প্রথম আলো, ২৬ ডিসেম্বর ২০২১) পরীক্ষামূলক যাতায়াতে কি এত যাত্রী বহন করা যায়, তাও অতিরিক্ত যাত্রী? সেটা দেখার কি কেউ নেই? লঞ্চে যে ব্যাপক পরিবর্তন করা হলো অনুমোদন ছাড়া, কর্তৃপক্ষের চোখ ফাঁকি দিয়ে সেটা কিভাবে সম্ভব হলো? অনুমোদন নিয়ে, নতুন ইঞ্জিন বসিয়ে, পরীক্ষামূলক যাত্রায় যাত্রী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গেলে যাত্রী হারানোর শঙ্কা আছে, মুনাফায় টান পড়বে তাতে, তাই যাত্রীদের জীবনকে বাজি রেখেই তারা ‘সেবা’ চালু করে দেয়। আসল কারণ মুনাফা, ওই ‘ধনী’ হওয়ার বাসনা, সেটা যেভাবেই হোক।
দুঃখজনক হলো সরকারের দায়িত্বশীল পদ থেকে এই দুর্ঘটনা ‘নাশকতা’ কি না তা তলিয়ে দেখার কথা বলা হচ্ছে। ২৫ ডিসেম্বর তথ্যমন্ত্রী বলেন, “এটি দুর্ঘটনা না নাশকতা, সেটি তদন্তে বেরিয়ে আসবে। এরপর কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” (ঐ)
অথচ এই লঞ্চ মালিকরা, নিজেরাই যে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে যান, ইচ্ছেমতো জলযানগুলোতে পরিবর্তন আনেন, সে ব্যাপারে দায়িত্বশীল কারো কোনো বক্তব্য চোখে পড়েনি। ব্যবসায়ীদের চোখ সর্বদা মুনাফার দিকেই থাকবে, কিন্তু সেটা কি জীবনের মূল্যের বিনিময়ে? মানুষের মৃত্যুর সাথে সওদা করে? লঞ্চটিতে বয়া ও অগ্নিনির্বাপণযন্ত্র কেন সঠিক সময়ে কাজে লাগানো যায়নি, বা আদৌ সেগুলো কার্যকর ছিল কি না, সেটা নিয়েও সব পক্ষ নিরব। মানুষের জীবন জলে ভেসে যাক, কিন্তু যেভাবেই হোক যাত্রী নিয়ে ছুটতে হবে, তাতে মুনাফা আছে।
স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে অব্যবস্থাপনা আর অবহেলার কারণেই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। ইঞ্জিনকক্ষে ত্রুটির কারণে আগুন ধরেছে, তদন্ত কমিটির বরাত দিয়ে এমনটাই বলা হচ্ছে পত্রিকায়। বলা হচ্ছে, আগুন লাগার পর লঞ্চকর্মীরা এগিয়ে আসেনি যাত্রীদের রক্ষায়। (সমকাল, পৃষ্ঠা-২, ২৬ ডিসেম্বর ২০২১) এমন নৌযান দুর্ঘটনা কিন্তু এবারই প্রথম নয়। ঈদের সময় প্রায়ই দেখা যায় অতিরিক্ত যাত্রীর কারণে মাঝ নদীতে নৌকাডুবি। জীবনরক্ষাকারী সরঞ্জাম অপ্রতুল থাকায় জীবন বাঁচাতে না পারা। কর্তৃপক্ষের সঠিক তদারিকর অভাবে ফিটনেসহীন যান চলাচল। কাগজপত্র ছাড়াই নৌযানে চালকের আসনে বসে যাওয়া। এমন আরো কত কত অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনার ভেতর দিয়ে যে আমাদের যোগাযোগ ও যাতায়াত চলছে! অথচ কোথাও কোন হেলদোল নেই। যেন দুর্ঘটনায় অপমৃত্যুই সাধারণ মানুষের নিয়তি! আর তার উপর ভর করে পয়সা কামানোই কিছু মানুষের একমাত্র লক্ষ্য!
এই যে শুধু অর্থ লাভ করা দুনিয়ার মানুষদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠেছে, ধনীদের আরো বিভৎস্যরকম ধনী হওয়ার জন্য খোদ শাসকগোষ্ঠী সহায়ক ভূমিকায় থাকছে, এর থেকে বাঁচার উপায় কী? গোটা পৃথিবীই আজ এই মুনাফা-রোগে আক্রান্ত। তবে উন্নত বিশ্বে কিছু কিছু জায়গায় আপোসহীন থাকা হয়—খাদ্য, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা, যোগাযোগ—এসব জায়গায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েই নিয়মনিষ্ঠা বজায় রাখা হয়। বাংলাদেশে এগুলো অবহেলিত। সেই অবহেলার মূল্য আমরা প্রতিনিয়তই দিচ্ছি প্রাণ দিয়ে। আমরা যেন বাস্তবতা থেকে চোখ ফিরিয়ে শুধু ধনী হওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছি। বাস্তবতার ভেতর যে সত্য আছে, সে সত্যের মুখোমুখি হতে আমরা অনিচ্ছুক, তাতে মুষ্টিমেয় মানুষের ক্ষতি! ‘জীবনের নিরাপত্তা আগে’, এই আপ্তবাক্য আমরা শুধু সাইনবোর্ডেই লিখে রাখি, কিন্তু চোখ ফিরিয়ে রাখি আরেকদিকে।
লেখক: প্রধান নির্বাহী, সংবাদ প্রকাশ