বড়দিন উদযাপনের কিছু রীতিনীতির ইতিকথা

ফাদার কমল কোড়াইয়া প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৪, ২০২১, ০৯:৪০ পিএম

খ্রীষ্টধমের্র প্রবর্তক যীশু খ্রীষ্টের জন্মদিনকেই বড়দিন বলে আখ্যায়িত করা হয়। খ্রীষ্ট বিশ্বাসীরা সারা বিশ্বে  ডিসেম্বর মাসের ২৫ তারিখে দিনটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদযাপন করে থাকেন। সময়ের নিরিখে নয়, গুরুত্বের দিক দিয়েই দিনটি বড়। পৃথিবীর বিভ্ন্নি দেশে নানা রীতি-নীতিতে, আনন্দ-উৎসবে, হরেক রকমের খাবার-দাবার, সাজ-পোশাকের মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করা হয়। দেশে দেশে খাবার-দাবার ও উৎসবের ভিন্নতা থাকলেও কিছু কিছু ধর্মীয় রীতি-নীতি, প্রচলিত প্রথা প্রায় সব দেশেই এক ধরনের। এমনই বহুল প্রচলিত ও ব্যবহৃত কিছু রীতি-নীতি এখানে তুলে ধরছি।

গোয়াল ঘর

সৃষ্টিকর্তা যীশু খ্রীষ্ট এ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন নিতান্তই দরিদ্র বেশে। তাঁর গর্ভধারিণী মা কুমারী মারীয়া ও সাধু যোসেফ যীশুর জন্মের সময়ে ছিলেন জেরুসালেম নগরে। যীশুর জন্মের ক্ষণ উপস্থিত হলে তারা কোথাও এতটুকু জায়গা পেলেন না যেখানে যীশুর জন্ম হতে পারে। প্রচণ্ড শীতের রাতে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ব্যর্থ হয়ে অসহায় অবস্থায় তারা একটা গোয়াল ঘরে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এখানেই যীশুর জন্ম হয়। কথিত আছে শীতের হাত থেকে রক্ষা করার মত গরম জামা-কাপড় তখন তাদের কাছে ছিল না।

কনকনে শীতের রাতে গোয়াল ঘরে থাকা গরু গাধা ও ভেড়ার গরম শ্বাস-প্রশ্বাসই নবজাত শিশু যীশুকে শীতের হাত থেকে রক্ষা করেছিল। যীশুর জন্মকাহিনী স্মরণার্থে ১২২৩ খ্রীষ্টাব্দে ইতালির আসিসি নগরের সাধু ফ্রান্সিস বড়দিনে গোয়াল ঘরের প্রচলন শুরু করেন। পরে ধীরে ধীরে তা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এখনও গির্জাঘর ছাড়াও বাড়িতে বাড়িতে বড়দিন এলেই গোয়াল ঘর সাজিয়ে যীশুর জন্ম ঘটনা উদযাপন করা হয়।

বাংলাদেশেও বড়দিনে গোয়াল ঘর ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। গীর্জা ঘরে এ গোয়াল ঘর স্থাপন করা হয়। বাড়িতেও ছোট আকারে গোয়াল ঘর তৈরি করা হয়। এ ঘরে স্থাপন করা হয় শিশু যীশুর প্রতিমূর্তিসহ কুমারী মারীয়া ও সাধু যোসেফের প্রতিমূর্তি। স্বর্গদূত ও তিন জন বয়স্ক ব্যক্তির (তিন পণ্ডিত) মূর্তিও পাশ্বে রাখা হয়, সাথে থাকে গরু, গাধা, ভেড়ার প্রতিমূর্তি। এর মধ্য দিয়ে যীশুর জন্মের ঘটনা ফুটিয়ে তোলা হয়।

ক্রিস্টমাস ক্রিব

শীতের রাতে গোয়াল ঘরে জন্মের পর শিশু যীশুকে যে জাবপাত্রে  রাখা হয়েছিল তা-ই হল ক্রিস্টমাস ক্রিব। পোপ লিবেরিউস ৩৫২ খ্রীষ্টাব্দে গোয়াল ঘরে জাবপাত্রে জড়ানো শিশু যীশুর প্রতিমূর্তি সর্বপ্রথম স্থাপন করেছিলেন বলে ইতিহাসে জানা যায়। তারপর এ রীতির প্রচলন ক্রমান্বয়ে হ্রাস পায়। আসিসির সাধু ফ্রান্সিস ১২২৩ খ্রীষ্টাব্দে পুনরায় এর প্রচলন শুরু করেন। ষোড়শ শতাব্দিতে এ প্রচলন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে সারা পৃথিবীতেই বড়দিনে ক্রিস্টমাস ক্রিবের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। রোমে অবস্থিত কাথলিক খ্রীষ্টানদের প্রধান উপাসনালয় সাধু পিতরের গির্জা চত্তরে পোপ দ্বিতীয় জনপল ১৯৮২ খ্রীষ্টাব্দে ক্রিস্টমাস ক্রিব স্থাপন করেছেন। প্রতি বছর বড়দিনে পোপ এ ক্রিবে বিশেষ প্রার্থনা-আশীর্বাদ করে থাকেন। বাংলাদেশেও প্রতি গির্জা ঘরে ও বাড়িতে বাড়িতে বড়দিনে গোয়াল ঘর ও ক্রিস্টমাস ক্রিব সাজানো হয়ে থাকে। বিশেষ প্রার্থনা অনুষ্ঠান করে যাজক শিশু যীশুর প্রতিমূর্তি ক্রিস্টমাস ক্রিবে স্থাপন করার পর ভক্ত-উপাসনাকারীগণ এতে প্রণাম-ভক্তি জানিয়ে থাকেন। 

ক্রিস্টমাস ট্রি

ইতিহাস থেকে জানা যায় ক্রিস্টমাস ট্রির প্রথম ব্যবহার শুরু হয় জার্মানিতে। সাধু বনিফাস প্রথমে এর ব্যবহার প্রচলন করেন। ৬৭২-৭৫৪ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে ক্রিস্টমাস ট্রির প্রচলন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে চিরহরিৎ বর্ণের (Evergreen) যে গাছ ক্রিস্টমাস ট্রি হিসেবে ব্যবহার  হয়ে আসছে তার প্রচলনও শুরু হয় জার্মানিতে ষোড়শ শতাব্দিতে। চির হরিৎ গাছটি (ক্রিস্টমাস ট্রি) হল জীবনের প্রতীক। এ  হরিৎ গাছ দিয়ে যীশু খ্রীষ্টকে চিরজীবী বোঝানো হয়। বড়দিনের পূর্বেই স্বর্গদূত, তারকা, জ্বলন্ত প্রদীপ, নানা রংবেরংয়ের কাগজ-ঝালর-ফুল দিয়ে ক্রিস্টমাস ট্রি সাজানো হয়। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে,  ক্রিস্টমাস ট্রির উপরে একটি তারা রয়েছে। এ তারটিই যীশুর জন্মের শুভ বারতা প্রকাশ করছে। কথিত আছে পূর্ব দেশের তিন পণ্ডিত আকাশে তারা দেখেই যীশুর জন্ম স্থান নির্ধারণ করেছিলেন। কোন কোন স্থানে দূত দিয়েও ক্রিস্টমাস ট্রি সাজানো হয়। দূত হল পবিত্রতা, শান্তি ও ঈশ্বরের উপস্থিতির প্রতীক।  বাংলাদেশে স্থান ভেদে উপরোক্ত উপকরণগুলো দিয়েই ক্রিস্টমাস ট্রি সাজানোর রীতি প্রচলিত আছে। তবে ক্রিস্টমাস ট্রির ব্যবহার শহর অঞ্চলে থাকলেও গ্রাম অঞ্চলে খুব একটা দেখা যায় না। বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জে কলা গাছ দিয়েই ক্রিস্টমাস ট্রির কাজ চালানো হয়। স্থানীয় ফুল, পাতা-লতা ও দেশীয় নানা উপকরণ দিয়ে তা সাজানো হয়।

ক্রিস্টমাস বেল

বড়দিনে ব্যবহৃত ছোট ছোট ঘন্টাকে ইংরেজীতে ক্রিস্টমাস বেল বলা হয়। যীশু খ্রীষ্টের জন্ম বারতা ঘোষণা করতেই তা ব্যবহার করা হয়। পর্বীয় শান্তি-আনন্দ প্রকাশকও ক্রিস্টমাস বেল। ক্রিস্টমাস ট্রি, গোশালা ঘর, বাড়ীর আঙ্গিনা সাজানো জন্যেও ক্রিস্টমাস বেলের ব্যবহার দেখা যায়। বড়দিনে সুপরিচিত মুখ সান্তাক্লসের হাতেও ক্রিস্টমাস বেল দেখা যায়। স্নেহ-ভালবাসা ও উপহার প্রদানের সময় নির্মল আনন্দের চিন্হ বহন করে এই ক্রিস্টমাস বেল। বর্তমানে বাংলাদেশে মাটির তৈরী সুন্দর সুন্দর ঘন্টা ক্রিস্টমাস বেল হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে।

সান্তাক্লস

সাধু নিকোলাস সান্তাক্লসের প্রচলনকারী বলে অনেকেই দাবি করে থাকেন। সাধু নিকোলাস ছিলেন হাসিখুশী আমুদে একজন ধর্মযাজক। বড়দিন এলেই শিশুরা গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় থাকে বড় বড় সাদা পাকা দাড়ি-গোফ, সাদা বর্ডার যুক্ত লাল ঢোলা পোশাক ও  শিশুদের জন্যে উপহার সামগ্রির ব্যাগওয়ালা একজন ব্যক্তির জন্যে। তিনিই হলেন সান্তাক্লস। সাধু নিকোলাস শিশুদের নানা ধরনের উপহার দিতে পছন্দ করতেন। তিনি গরীবদেরও অনেক সাহায্য করতেন। প্রচলিত আছে সাধু নিকোলাস একবার শুনতে পেলেন যে, এক দরিদ্র পরিবারের তিন বোন যৌতুক দিতে পারছে না বলে বিয়েও হতে পারছে না। এ পরিস্থিতিতে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তার এক কন্যাকে তিনি বিক্রি করে অন্য দুই মেয়েকে বিয়ে দেবেন। এ দুঃসংবাদ শুনে সাধু নিকোলাস আর স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি গভীর রাতে চুপিসারে ঐ বাড়ীতে গিয়ে তিন ব্যাগ স্বর্ণ রেখে আসেন।  তাঁর এ উপকার কাহিনী চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবেই গড়ে উঠে সান্তাক্লসের প্রচলন। আজও তা দেশে দেশে বড়দিনে আনন্দের একটা প্রধান উৎস হয়ে আছে।

বাংলাদেশে শহর অঞ্চলে সান্তাক্লস দেখা গেলেও গ্রাম অঞ্চলে এখনও এর প্রচলন খুব একটা দেখা যায় না।

বড়দিনের কীর্তন

যীশু খ্রীষ্টের জম্মকাহিনী নিয়ে রচিত বিশেষ ভঙ্গিতে নেচে-গেয়ে গান করাকেই সাধারণত বড়দিনের কীর্তন বলা হয়। কীর্তনের ইংরেজী শব্দ Carol এসেছে গ্রীক শব্দ Choros  থেকে, যার অর্থ গোল হয়ে গান করা। কীর্তনের প্রাচীন ফ্রান্স শব্দ হল, ঈধৎড়ষব যার অর্থ হল, নেচে-গেয়ে গান করা। ১৩৫০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৫৫০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত ইউরোপে কীর্তন দারুণভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করে। ষোড়শ শতাব্দিতে কীর্তনের জনপ্রিয়তা অনেকটা হ্রাস পেলেও অষ্টাদশ শতাব্দিতে তা আবার জনপ্রিয়তা ফিরে পায়। বিশ্ববিখ্যাত কীর্তন Silent Night রচিত হয়েছিল ১৮১৮ খ্রীষ্টাব্দে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খ্রীষ্টানদের মধ্যে বড়দিনের কীর্তন ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়। বাংলা ভাষায় রচিত হয়েছে অনেক কীর্তন। গির্জার উপাসনায়, বাড়িতে প্রার্থনা সভায়, সভা-সমিতির নানা অনুষ্ঠানে কীর্তনের ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়। বড়দিনের সময় বিভিন্ন অঞ্চলে কীর্তন প্রতিযোগিতারও আয়োজন করা হয়। এ সময় বাড়ি বাড়ি ঘুরে যুবক-বৃদ্ধ সকলে মিলে কীর্তন করেন।

বড়দিনের কার্ড

ইতিহাস থেকে যতটুকু জানা যায় বড়দিনের কার্ডের ব্যাপক প্রচলন শরু করেন স্যার হেনরী ১৮৪৩ খ্রীষ্টাব্দে লন্ডনে। প্রথমে অবশ্য কার্ডের মধ্যে এখনকার মত যীশুর জন্মের ছবি ছিল না। ফুল ও নানা রকম আকর্ষণীয় ছবি কার্ডের মধ্যে থাকতো। ১৮৭৫ খ্রীষ্টাব্দে আমেরিকায় বড়দিনের কার্ডের প্রচলন শুরু হয়। ১৯২০ খ্রীষ্টাব্দে বড়দিনের কার্ড খামে করে পাঠানো শুরু  হয়। বিংশ শতাব্দিতে সারা পৃথিবীতে বড়দিনের কার্ড ব্যবহার বেড়ে যায়। শুধু মাত্র আমেরিকায় ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে বড়দিনে ১.৯ বিলিয়ন বড়দিনের কার্ড ব্যবহার করা হয়েছে বলে এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে।

বাংলাদেশেও বড়দিনের কার্ড ব্যবহারের রীতি বেশ জনপ্রিয়। প্রচলিত কার্ড ছাড়াও বাংলাদেশে দেশীয় রীতি-নীতির উপর ভিত্তি করে বড়দিনের কার্ড তৈরী করা হচ্ছে। হস্তশিল্পীরা নিজেদের মনের মাধুরী মিশিয়ে এখন বড়দিনে কার্ড তৈরী করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও তা রপ্তানী করছে। বাংলাদেশী কার্ড বিদেশেও বেশ জনপ্রিয়।

আরও অনেক রীতি-নীতি রয়েছে যা এত অল্প পরিসরে তুলে ধরা সম্ভব নয়। তবে বড়দিন বাংলাদেশেও জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। ২৫ ডিসেম্বর বড়দিন, জাতীয় ছুটির দিন।জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলে মিলে আনন্দ উৎসবের মধ্য দিয়ে দিনটি পালন করা হয়। ধর্মীয় উপাসনা শেষ করেই শুরু হয় বাড়ি বাড়ি ঘুরে শুভেচ্ছা বিনিময়ের পালা।  ছোটরা বড়দের হাত চুম্বন করে, পা স্পর্শ করে বা মাথা নত করে বড়দের কাছ থেকে আশীর্বাদ গ্রহণ করে। চলে উপহার আদান-প্রদানও। ঘরে ঘরে আয়োজন করা হয় নানা সুস্বাদু খাবার। এর মধ্যে থাকে হরেক রকম পিঠা, কেক, পোলাও, বিভিন্ন মাংসের রান্না। এ সময় অতিথি আপ্যায়নও করা হয়। এ আনন্দ চলে প্রায় সপ্তাহ ধরে।

লেখক: কাথলিক ধর্মযাজক, কার্যনির্বাহী পরিচালক, সেন্ট জন ভিয়ানী হাসপাতাল