বুদ্ধিজীবী দিবসে কিছু জিজ্ঞাসা

আলী মো. আবু নাঈম প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৪, ২০২১, ১০:৩৭ এএম

‘বিংশ শতাব্দীতে মানুষের শোকের আয়ু বড়জোর এক বছর।’ এমন কথাই বলেছেন দূর তুরস্কের লড়াকু কবি নাজিম হিকমত। আর এখন তো আমরা একবিংশ শতাব্দীতে চলে এসেছি। ১৯৭১ থেকে পেরিয়ে এসেছি পাক্কা ৫০টি বছর। বাংলাদেশ পালন করছে তার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। ৫০ বছরের দীর্ঘ দূরত্বে শোক না থাক, স্মৃতি আছে, দায় আছে।

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকারীদের বিচার একটা বড় দায়। এই দায় মেটাবার জন্য শহীদ জননী জাহানার ইমামের নেতৃত্বে একটা আন্দোলন হয়েছিল, ১৯৯২-৯৪ সময় পর্বে। গণ-আদালত গঠন করা হয়েছিল, গণ-আদালত গঠনকারীদের রাষ্ট্রদ্রোহী তকমা পেতে হয়েছিল। ওই আন্দোলনের ফলাফল কারা কীভাবে নিজেদের ঝুলিতে ভরেছে, সেসব রাজনৈতিক বিশ্লেষণের ব্যাপার। কিন্তু আন্দোলন আবারও করতে হয়েছে যুদ্ধাপরাধী চক্রের বিচারের দাবিতে, ২০১৩ সালে। ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ বা ‘শাহবাগ’ নামের ওই আন্দোলনের সফলতা-দুর্বলতা-ব্যর্থতা নিয়েও বহু বিশ্লেষণ হয়েছে, হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও রাষ্ট্রীয়ভাবে শুরু হয়েছে। বেশ কিছু রায় হয়েছে, কিছু রায় কার্যকরও হয়েছে। কিন্তু আমাদের দায়মুক্তি কি ঘটেছে?

আমরা যখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছি, তখন বাংলাদেশের কিশোর-তরুণ এবং ছাত্ররা রাজপথে নামছে নিরাপদ সড়কের দাবিতে। প্রথম দফায় এই আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল ২০১৮ সালে। দুজন শিক্ষার্থীর মৃত্যুকে ২৯ জুলাই শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে আসে। শিক্ষার্থীদের সেই শান্তিপূর্ণ এবং অভাবনীয় আন্দোলনের পাশে সাধারণ মানুষকেও সমর্থন জানাতে দেখা গেছে। কিন্তু সরকার ওই আন্দোলনকে ইতিবাচকভাবে নেয়নি। সড়ক নিরাপদ করার লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার পরিবর্তে আন্দোলন দমাতেই সরকারের মনোযোগ ও তৎপরতা ছিল বেশি।

এরপর করোনা মহামারির বিস্তার আমাদের স্বাভাবিক জীবনকে নানা দিক থেকে বিপর্যস্ত করেছে। সম্প্রতি এ আন্দোলন আবার নতুন করে শুরু হয়েছে। অর্থাৎ নিরাপদ সড়কের দাবি এখনো সুদূর পরাহত। ১৬ ডিসেম্বর, বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী একেবারে নাকের ডগায়। তার ঠিক আগে আগে ১৪ ডিসেম্বরও হাজির। এমন মুহূর্তে শুধু নিরাপদ সড়ক নয়, আরও অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের সামনে প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা হিসেবে এখনো খাড়া রয়েছে।

এ বছরই একটা তুচ্ছ ও বানোয়াট ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটল। এই সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা কিছুদিন পরপরই ঘটছে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের মাধ্যমে আমরা জানতে পারছি যে এসব ঘটনায় সরকারদলীয় নেতা-কর্মীরাও যুক্ত। মানুষ উদ্বিগ্ন নারীর নিরাপত্তা নিয়ে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও অধিকার নিয়ে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বা সরকারের সমালোচনাকারীকে গুম বা বিনা বিচারে আটকের অভিযোগ বেশ জোরালো। আছে ক্রসফায়ার নামের বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড। ফোনালাপ ফাঁসের মতো ঘটনায় মানুষ ব্যক্তিগত তথ্যের এবং জীবনের সুরক্ষার অধিকার নিয়ে উদ্বিগ্ন। আর এই উদ্বেগ আরও বেড়ে যাচ্ছে যখন আমরা শুনতে পাচ্ছি যে রাষ্ট্র বহু অর্থ ব্যয় করে আমাদের টেলিফোনে আড়িপাতার জন্য যন্ত্রপাতি কিনছে। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সমস্যা— দ্রব্যমূল্য, বেকারত্ব, শিক্ষাব্যবস্থার ভঙ্গুর দশা, বেহাল স্বাস্থ্যব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে বলতে গেলে তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকবে।

সমস্যার কথা লিখে শেষ করা যাবে না। আবার কেউ চাইলে আমাদের অগ্রগতি এবং উন্নতিরও এক বিরাট ফিরিস্তি হাজির করতে পারবেন। কিন্তু সমস্যার কথা, জনগণের দাবির কথার বিপরীতে উন্নয়নের ফিরিস্তি কোনো প্রত্যুত্তর নয়। জনগণের জীবনমান উন্নয়ন, দেশের উন্নয়ন সরকারের দায়িত্ব। সে কাজ করাই সরকারের জন্য স্বাভাবিক। সমস্যা জিইয়ে থাকাটাই অস্বাভাবিক, এটা দায়িত্বে ব্যর্থতার নমুনা।

আমরা কথায় কথায় বলি, বিশেষত স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে তো এ কথা হরহামেশাই শোনা যাবে যে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত কি এ মাটি থেকে সাম্প্রদায়িকতা ধুয়ে মুছে নিয়ে যেতে পেরেছে? শুধু কিছু বিশেষ রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে কি পার পাওয়া যাবে? রাষ্ট্রধর্ম বিল পাস করিয়েছে এরশাদের মতো নিকৃষ্ট স্বৈরশাসক, তার শাসন নিষ্কণ্টক করার স্বার্থে। কিন্তু বাকিরাও তো তার সুবিধাটুকু নিয়েছে। এবং শাসকদের সম্মিলিত অধ্যবসায়ের ফলেই মানুষের মন থেকে সাম্প্রদায়িকতা দূর করা যায়নি।

অথচ সেই পাকিস্তান আমলে, যখন পাকিস্তানি শাসকরা ইসলাম ধর্মের দোহাইকে অত্যন্ত নিকৃষ্টভাবে ব্যবহার করেছে তার ভেতরে বসেই শহীদ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী লিখেছিলেন : “রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা রাখাই সংগত। ধর্মকে রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত করলে বা রাষ্ট্রের ভিত্তিকে ধর্মীয় করতে চাইলে অনেক অসুবিধাই দেখা দিতে পারে। ধর্মের পবিত্রতা রক্ষা করার জন্যও এটা কর্তব্য।...কোনো ধর্মই আমাদের বলে দেয় না—কী করে প্লেন চালাতে হবে বা গাড়ি চালাতে হবে, কী করে আণবিক শক্তি কেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে অথবা চাঁদে যাওয়া যাবে ইত্যাদি। ধর্ম কেবল আমাদের আচার-আচরণের মূলনীতিগুলো নির্দিষ্ট করে দেয় এবং অধিকার সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। এই অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করতে গেলেই সে-ই অকারণ বিপদ ডেকে আনবে। ... রাষ্ট্র যদি গণতান্ত্রিক হয়, তবে তার কাছে কে হিন্দু কে মুসলমান, এ প্রশ্ন উঠতে পারে না। অর্থাৎ ইসলামিক রাষ্ট্র হলে সেটা গণতন্ত্র হবে না; আর গণতন্ত্র হলে ইসলামী রাষ্ট্র বলার কোনো মানে হয় না। ... নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য যারা ইসলাম তথা ধর্মের দোহাই দেয়, তাদের কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত। কারণ এটা ... crime এবং অধর্ম দুই-ই।” আর তাই তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পেরেছিলেন, “আমরা আধুনিক যুগের, বিংশ শতাব্দীর নাগরিক। আমরা আমাদের রাষ্ট্রকে দেখতে চাই আধুনিক রাষ্ট্র রূপে। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভাঁওতা দিয়ে আমাদের কেউ আধুনিক রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত করবে—এ আমরা সহ্য করব কেন?”

পাকিস্তানি শাসকদের ওই ভণ্ডামির মুখোশ খুলে দিয়ে শহীদ আনোয়ার পাশা লিখেছিলেন : “পাকিস্তান একটা অছিলা। যে কোনো প্রকারে এখানকার বুর্জোয়া শ্রেণি চাচ্ছে এখানকার প্রলেটারিয়েট হিন্দু-মুসলমানদের মিলিত শক্তিকে দ্বিধাবিভক্ত করে রাখতে।”

সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতাকে টিকিয়ে রাখা এবং এগুলোকে শাসকদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার বিষয়টি তুলে ধরে শহীদ মোহাম্মদ মোর্তজা লিখেছিলেন : “আমার বলবার বিষয় এই যে, আমাদের দেশে এই যে তিন ধরনের বিদ্যালয় (সাধারণ, ইংলিশ মিডিয়াম ও মাদ্রাসা) প্রতিষ্ঠিত আছে, তাদের মধ্যকার পার্থক্য কেবল পদ্ধতি ও ভাষাগত নয়, অনেকাংশে বিষয়গতও বটে। সে জন্যই সর্বশেষ পরিণতিতে তারা সাধারণভাবে পৃথক ধরনের ব্যক্তিতে পরিণত হয়। আমাদের অনুধাবন করতে হবে এই পার্থক্যের কতটুকু বাঞ্ছনীয় এবং এসবের পিছনে যে শক্তি ও সম্পদ ব্যয়িত হচ্ছে, পরিণতির পরিপ্রেক্ষিতে তা যুক্তিযুক্ত কি না, জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গিতেই বা আমাদের কিভাবে তার মোকাবিলা করা উচিত।” তিনি আরও বলেছিলেন : “...আমাদের দেশে মাদ্রাসা শিক্ষাপ্রণালী বিচ্ছিন্ন, বৃহত্তর পৃথিবীর গতিশীলতার সঙ্গে যোগাযোগবিহীন একটা প্রণালী, এতে শিক্ষার্থীদের কূপমণ্ডূক করে তোলে। যে কোনো মানুষের চরিত্রে এহেন কূপমণ্ডূকতার পরিণতি মারাত্মক হতে বাধ্য। সেই জন্য ইংরাজ ঔপনিবেশিক শক্তি এই প্রণালীকে জিইয়ে রেখেছিল।”

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পেছনে তখনকার নেতারা দুটো বিষয়কে বেশ জোরালোভাবে তুলে ধরেছিল। এক, হিন্দু মুসলমান আলাদা জাতি, তাই তাদের দেশ হবে আলাদা। আর মুসলমানদের বিকাশ ও উন্নয়নের জন্যে পাকিস্তান কাজ করবে। কিন্তু পাকিস্তান হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই বোঝা যাচ্ছিল যে ইসলামের নাম করে মানুষকে বোকা বানানো হয়েছে। উন্নয়ন যা হওয়ার তা হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানীদের, বিশেষত ২২ পরিবারের। সাধারণ মানুষের জীবন যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই থেকে গেছে। তাই সেদিন শহীদুল্লা কায়সার অত্যন্ত আক্ষেপের সাথে লিখেছিলেন : “বেচারা ক্ষুদিরাম, বেচারা আশফাকউল্লাহ, বেচারা সূর্য সেন, স্বাধীনতার জন্য তোমরা ফাঁসী গেছিলে। কোনো রকমে পরপার থেকে একবার এদেশে বেড়াতে এসে স্বাধীন দেশের এই চেহারা দেখলে তোমরা কি করতে? আত্মাহুতির বদলে আত্মহত্যা করতে?”

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে, শহীদুল্লা কায়সারসহ অন্য শহীদ বুদ্ধিজীবী এবং শহীদদের কাছে আমাদেরও এই একই জিজ্ঞাসা রাখতে হচ্ছে।

 

লেখক: সভাপতি, শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি পাঠাগার