২৫ মার্চ ১৯৭১। ঢাকায় আর্মি নামার খবর ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মুখে মুখে। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী একটি ডিফেন্স গড়ে তোলেন টাঙ্গাইলে। তিনি তখন পড়তেন করটিয়া কলেজে। টাঙ্গাইলে আর্মি আসে ২৭ মার্চ। প্রতিদিন তারা শহর থেকে এক-একটি গ্রামে ঢুকে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। তাদের পথ চিনিয়ে নেওয়া ও মুক্তিকামী বাঙালিদের বাড়ি চিনিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করে রাজাকার ও শান্তি কমিটির লোকেরা।
একাত্তরের জুন মাস। টাঙ্গাইল থেকে পাকিস্তানি সেনারা হানা দেয় আমাদের নাগা গ্রামটিতে। যুবকদের পেলেই তারা ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। জ্বালিয়ে দিচ্ছে হিন্দুদের বাড়িগুলো। পাকিস্তানি সেনারা এলেই আমরা জীবন বাঁচাতে পাটক্ষেতে লুকিয়ে থাকতাম। কিন্তু এভাবে আর কত দিন? বন্ধু খন্দকার জীবন করিম, আবদুস সালাম মন্ডল, মিনহাজসহ পরিকল্পনা করি মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার। সংগ্রহ করি মাত্র দশ টাকা।
একদিন সন্ধ্যায় কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে পড়ি দেশের টানে। কাদের সিদ্দিকী গ্রুপের এক কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন ওয়াহেদ সাহেব। ওই সময় তিনি ছিলেন আনসার কমান্ডার। তার নেতৃত্বে বাসাইলে তিনি গড়ে তোলেন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল। প্রথমে তার দলে যোগ দিই। শিখে নিই থ্রি নট থ্রি রাইফেল চালানো।
দলে আমরা বিশজনের মতো। কিন্তু হাতিয়ার ছিল মাত্র পাঁচটি। গোপনে আমরা বাসাইলের ময়তা, বাথুলি, ঝনজনিয়া প্রভৃতি গ্রামের যুবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতাম। মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে তাদের নানাভাবে উৎসাহিত করতাম। রাতের অন্ধকারে মাঝে মাঝে পাকিস্তানি অনুসারীদের বাড়িতে আক্রমণ করেই সরে পড়তাম। গেরিলা বেশে খোঁজ রাখতাম রাজাকারদের গতিবিধির দিকে। ওয়াহেদ সাহেবের দলে আমরা ছিলাম অক্টোবরের আগ পর্যন্ত। পরে তিনিই আমাদের উৎসাহিত করে হায়ার ট্রেনিংয়ের জন্য। আমি, মজিবুর রহমান, খন্দকার জীবন করিম ও মিনহাজ রাজি হতেই পাঠিয়ে দেন ট্রেনিংয়ে।
নেত্রকোনার বাউসি সীমান্ত দিয়ে আমার আসি ভারতের রংলা এলাকায়। ওখান থেকে ট্রাকে চড়ে চলে যাই তুরাতে। সেখানে ট্রেনিং ক্যাম্পটির দায়িত্বে ছিল ভারতের সিক্স বিহার রেজিমেন্ট। ক্যাম্প ইনচার্জ ছিলেন কর্নেল জানজোয়া। কিন্তু আমাদের ট্রেনিং দিতেন একজন বাঙালি হাবিলদার। নাম লিয়াকত আলী। আটাশ দিনের টেনিংয়ে শেখানো হয় রাইফেল, এসএমজি, এলএমজি চালানো, মাইন ও গ্রেনেড বিস্ফোরণসহ নানা বিষয়।
ট্রেনিং শেষে আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় ডালু ফেরেংগা বাজার বেস ক্যাম্পে। এটি ছিল এগারো সেক্টরের অধীন। সেক্টর কমান্ডার প্রথমে ছিলেন কর্নেল তাহের। পরে তিনি আহত হলে দায়িত্ব নেন উইং কমান্ডার হামিদুল্লাহ। আমাদের কমান্ড করতেন কোম্পানি কমান্ডার দেলবর আনসারি।’
একাত্তরের কথা এভাবেই তুলে ধরেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আনোয়ার হোসেন খান।
তার পিতা আবদুল মজিদ খান ছিলেন একজন কৃষক। মা রোকেয়া বেগম সাধারণ গৃহিণী। একাত্তরে তিনি ছিলেন ক্লাস টেইনের ছাত্র।
দেশের সে সময়কার অবস্থার কথা শুনি এই মুক্তিযোদ্ধার মুখে। তার ভাষায়, ‘আমরা ছিলাম গ্রামের লোক। ভয়ে তখন টাঙ্গাইল শহর পর্যন্তও যেতাম না। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা দাবির কথা শুনেছি নেতাদের মুখে। আমাদের ওখানকার নেতা ছিলেন আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। ’৬৯-এ করটিয়া কলেজের ভিপি ছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ভাষণ দেন রেসকোর্স ময়দানে। ইয়াকুব নামে গ্রামের একজন চাকরি করতেন পুলিশে। তার বাড়িতে ছিল রেডিও। তার ওখানে গিয়েই আমরা শুনি ভাষণটি। বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠে মানুষ পাগল হয়ে যেত। তার কোনো ডরভয় ছিল না। এখনো কানে বাজে সে ভাষণ। গায়ের লোম এখনো দাঁড়িয়ে যায়, যখন বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে শুনি, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল…। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম…।’
মুক্তিযুদ্ধের সময় এক সম্মুখযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের একটি গুলি এসে লাগে মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেনের ডান পায়ে। ফলে ওই পায়ের হাঁটুর নিচের অংশে মারাত্মকভাবে জখম হয়।
রক্তাক্ত সেই দিনটির কথা জানতে চাই আমরা। তিনি বলেন, ঘটনার আদ্যোপান্ত। তার ভাষায়, ‘ওপর থেকে নির্দেশ আসে হালুয়াঘাট আক্রমণের। আমাদের সঙ্গে যোগ দেয় ইন্ডিয়ান আর্মিরাও। ডালু ফেরেংগা বাজার বেস ক্যাম্প থেকে আমরা হালুয়াঘাট ঢুকে পড়ি গাছ্ছুমারা সীমান্ত দিয়ে। এটি হালুয়াঘাটের উত্তর-পূর্ব পাশে।
৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। রাতে আমরা ডিফেন্স গাড়ি হালুয়াঘাটে। কমান্ডে দেলবর আনসারি। অ্যাডভান্স হয়ে আমরা হালুয়াঘাট দখলে নিব। পাকিস্তানি সেনারাও তখন আমাদের ঠেকাতে প্রস্তুত। ভোরের আলো ফুরতেই শুরু হয় গোলাগুলি। আর্টিলারির হামলা পেরিয়ে আমরা গোলাগুলি করে ওদের এক কিলোমিটার ভেতরে চলে আসি। হঠাৎ গুলি লাগে সহযোদ্ধা ও বন্ধু খন্দকার জীবন করিমের গায়ে। আমার পাশেই ছিল সে। ক্রলিং করে তার কাছে এগোই। এ সময় আরেকটি গুলি এসে লাগে আরেক সহযোদ্ধা আবু সাঈদের বুকে। শরীরটা ঝাঁকি দিয়ে নিথর হয়ে আসে তার দেহটি। সহযোদ্ধার মৃত্যু দেখে আমি ঠিক থাকতে পারি না। আমার সারা শরীর কাঁপছিল। পেছন থেকে কমান্ডার নির্দেশ করতেই তাদের ফেলে আমি সামনের দিকে এগোতে থাকি। চারপাশে একইভাবে অগ্রসর হয় অন্য মুক্তিযোদ্ধারাও। এ সময় ভারতীয় বিমান পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানের ওপর প্রবল বোমা নিক্ষেপ করে। ফলে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। রাতভর থেমে থেমে চলে গোলাগুলি। আমরা যে যার অবস্থানে থাকি।
৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। সকাল প্রায় ৭টা। মূল রাস্তার সাইড দিয়ে সামনে এগোচ্ছি। মাঝে মাঝে গুলির শব্দ পাচ্ছিলাম। কিছু দূর যেতেই হঠাৎ ডান দিকে কাত হয়ে পড়ে গেলাম। প্রথম কিছু বুঝিনি। ভেবেছি ডান পায়ে হয়তো সাপে কেটেছে। হাঁটুর নিচে চোখ পড়তেই দেখলাম পিনপিন করে রক্ত বেরোচ্ছে। গুলিটি মাংস ভেদ করে হাড়ে লেগেছিল। খানিক পরেই পা-টা আর নাড়াতে পারলাম না। সহযোদ্ধারা আমাকে ধরে পেছনে নিয়ে গেল। প্রথমে ক্যাম্পে এবং পরে চিকিৎসার জন্য আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তুরাতে। সেখানকার হাসপাতালেই অপারেশন করে বের করে আনা হয় পায়ের গুলিটি।
১০ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ স্বাধীন হলে তুরা থেকে আমাদেরও নিয়ে আসা হয় ময়মনসিংহ হাসপাতালে। সেখানেই পাই দেশ স্বাধীনের খবরটি। কী যে আনন্দ লেগেছিল সেদিন। মুক্তিযোদ্ধারা তখন আকাশের দিকে গুলি ছুড়ে উল্লাস করতে থাকল।’
মুক্তিযুদ্ধে রাজাকারদের ভূমিকার প্রসঙ্গ উঠতেই কান্না জড়ানো কণ্ঠে আনোয়ার হোসেন জানালেন নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার কথা।
‘আমার কোনো হদিস নাই। তাই মা-বাবা ভেবেছে অন্যদের মতো পাকিস্তানিরা আমাকে মেরে ফেলেছে। বড় ভাই আক্তারুজ্জামানও চলে যান মুক্তিযুদ্ধে। তিনি ছিলেন বাতেন গ্রুপে। আমরা মুক্তিযুদ্ধে চলে যাওয়ার পর বাড়ির দিকে চোখ পরে রাজাকারদের। আমাদের পাশের বাড়ির একজন ছিল রাজাকার বাহিনীতে। নাম ইয়াকুব আলী চৌধুরী। দুই ভাইয়ের মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার খবর সে পৌঁছে দেয় পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে। এক রাতে আর্মিরা হানা দেয় বাড়িতে। সেদিন বাবা বাড়ি ছিলেন না। মায়ের সঙ্গে ছিলেন শুধু আমার আদরের ছোট দুই ভাই চান্নু ও পান্নু। তখন তাদের বয়স মাত্র ৫ ও ৭ বছর। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার অপরাধে পাকিস্তানিরা আমার দুই ভাইকে বুটের লাথিতে হত্যা করে। স্বাধীনের পর ফিরে এসে দেখি ওই রাজাকার বেঁচে আছে। প্রভাবশালী হওয়ায় আমরা তার কিছুই করতে পারিনি।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘আমার ছোট ভাইকে যাদের সহযোগিতায় মারা হয়েছিল, তাদের বিচার তো আরও আগেই করা উচিত ছিল। দেরিতে হলেও শত প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে সরকার যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের বিচার করছে এখনো তা চলমান, এটাই আশার কথা। এটা ভেবেই শান্তি পাই।’
যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন তা পেয়েছেন কি?
উত্তরে তিনি বলেন, ‘স্বপ্নের বাংলাদেশে তো বিশৃঙ্খল থাকার কথা নয়। স্বপ্নের বাংলাদেশ তখনই হবে যখন দেশের স্বার্থে আমরা সবাই এক হব। এখনো তো আমরা মুক্তিযোদ্ধারাই বিভিন্ন দলে বিভক্ত।’
মুক্তিযুদ্ধের সময় আপামর জনসাধারণের যে স্লোগান ছিল স্বাধীনের পর তা হয়ে যায় একটি রাজনৈতিক দলের স্লোগান। এ প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার অকপটে বলেন ‘জয় বাংলা স্লোগান মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান’। এটা উচ্চারণ করলেই কেউ আওয়ামী লীগের হয়ে যায় না। এটা তো জিন্দাবাদের দেশ না। জিন্দাবাদের বিরুদ্ধেই তো আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় জিয়াউর রহমান নিজেও ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়েছিলেন। তাই এটি বাঙালির স্লোগান।
লেখক: মুক্তিযুদ্ধ গবেষক