খালেদা জিয়ার চিকিৎসা-বিতর্ক

সাইফুর রহমান তপন প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৫, ২০২১, ০১:৫৫ পিএম

অনেক দিন ধরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া অসুস্থ। কিন্তু তাঁর এ অসুস্থতা কতটা গুরুতর, সেটা এখনো ধোঁয়াশায় পূর্ণ। খালেদা জিয়ার চিকিৎসার দায়িত্বে আছে যে মেডিকেল বোর্ড, তার কয়েকজন সদস্য গত ২৮ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, তাঁরা মনে করেন খালেদা জিয়ার ‘সিরোসিস অব লিভার’ হয়েছে। এমনটা মনে করার পেছনের কারণগুলোও তাঁরা ওই সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরেছেন। তাঁরা বলেছেন, খালেদা জিয়ার পরিপাকতন্ত্রেও বিভিন্ন অংশে বেশ কয়েকবার রক্তক্ষরণ হয়েছে এবং লিভারের সমস্যার কারণেই এ অবস্থার উদ্ভব হয়েছে। তাঁদের মতে, এ রোগের চিকিৎসা কেবল যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির তিনটি হাসপাতালেই আছে; খালেদা জিয়াকে বাঁচাতে হলে অবিলম্বে তাঁকে ওই হাসপাতালগুলোর যেকোনোটিতে পাঠাতে হবে।

কিন্তু খালেদা জিয়ার চিকিৎসকদের এ সংবাদ সম্মেলন শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সরকারি দলের কয়েকজন নেতা এবং সরকারের মন্ত্রীদের অনেকে প্রশ্ন তুললেন যে, খালেদা জিয়া রাজধানীর যে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি আছেন, সেখানকার কোনো ডাক্তার কি এমনটা বলেছেন? তাঁদের অভিমত, যারা বলছেন খালেদা জিয়াকে সময় নষ্ট না করে বিদেশে পাঠাতে হবে, তাঁরা বিএনপির চিকিৎসক সংগঠনের নেতা, এভারকেয়ার হাসপাতালের কেউ নন; সে হিসেবে তাঁরা যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা বিএনপি নেতাদের ‘শেখানো বুলি’ মাত্র।

এটা ঠিক যে ওই সংবাদ সম্মেলনের মুখ্য বক্তা ডা. এফ এম সিদ্দিকীসহ সেখানে যে কজন ডাক্তার উপস্থিত ছিলেন তাঁদের প্রায় সবাই বিএনপির চিকিৎসক সংগঠন-ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা ড্যাবের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত আছেন। তাঁদের কেউই এভারকেয়ার হাসপাতালের চিকিৎসক নন। তাছাড়া মেডিকেল বোর্ডটিও গঠিত হয়েছে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের জ্ঞান, দক্ষতা বা রোগীর প্রতি কমিটমেন্টের চেয়েও বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে তাঁদের সংশ্লিষ্টতার ভিত্তিতে। আবার এটাও ঠিক যে, এ চিকিৎসকদের সবাই স্বনামধন্য এবং কেউ কেউ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অনেক অভিজ্ঞ। বিএনপির রাজনীতির অনুসারী হলেও খালেদা জিয়ার রোগের ধরন নির্ণয় এবং এর চিকিৎসার ব্যাপারে কথা বলার যোগ্যতা তাঁদের আছে।

কিন্তু যে বিষয়টি সাধারণ মানুষকে ধন্দে ফেলেছে তা হলো, উক্ত সংবাদ সম্মেলনের দুদিন আগেও কোনো কোনো মিডিয়ায় যখন লেখা বা বলা হলো যে, খালেদা জিয়ার লিভার সিরোসিস হয়েছে, তখন বিএনপি নেতারা তা নাকচ করে দিয়েছিলেন। লিভার সিরোসিসের মতো রোগ কি মাত্র দুদিনে বা তিন দিনে প্রাণঘাতী পর্যায়ে চলে যেতে পারে?

লিভার সিরোসিস আমাদের দেশে অজানা কোনো রোগ নয়। এটাও মানুষ জানে যে, খালেদা জিয়ার চিকিৎসকেরা তাঁর লিভার সিরোসিস বর্তমানে যে পর্যায়ে রয়েছে বলে বলছেন, সে পর্যায়ে আসতে এ রোগটি সাধারণত অনেক সময় নেয়। খালেদা জিয়া দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত হওয়ার পর যে কদিন কারান্তরীণ ছিলেন, তার বেশির ভাগ সময়ই তিনি কাটিয়েছেন বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের ভিআইপি কেবিনে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য। এছাড়া গত বছরের মার্চ মাস থেকে, করোনা মহামারি ছড়িয়ে পড়ার পর, তিনি তাঁর গুলশানেরর বাসাতেই ছিলেন। সেখান থেকে বেশ কয়েকবার এই এভারকেয়ার হাসপাতালেই চিকিৎসা নিয়েছেন। এ দীর্ঘ সময়ে এত যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে তিনি গেলেন তাতে কি ওই মারণব্যাধি ধরা পড়েনি?

এ কথাও উঠেছে যে, খালেদা জিয়া ২০১৮ সালে জেলে যাওয়ার পর থেকেই বিএনপি নেতারা তাঁর ‘জটিল’ রোগে ভোগার কথা বলে আসছেন। তাঁরা তখন থেকেই তাঁকে বিদেশে পাঠানোর দাবি জানাচ্ছেন। অথচ খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসকেরা এখন তাঁকে বিদেশে পাঠানো প্রয়োজন বলে মনে করছেন। এটা কি এমন একটা বিষয় যে, বিএনপি দল হিসেবে যখন খালেদা জিয়াকে ‘মুক্ত’ করতে ব্যর্থ হয়েছে, তখনই একই লক্ষ্য অর্জনে একপ্রকার ‘ব্ল্যাকমেল’ হিসেবে তাঁর লিভার সিরোসিসের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসা হয়েছে?

বলে রাখা দরকার, এমন প্রশ্ন আমরা তুলিনি। অন্তত সরকারি দলের নেতাদের কথা শুনে আমাদের এমনটা মনে হয়েছে। আর জনগণের একটা অংশের মধ্যেও যে এমন প্রশ্ন জাগেনি তা-ও নয়।

খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার কথা বলতে গিয়ে ব্ল্যাকমেলের কথা তোলায় অনেকে ক্ষুব্ধ হতে পারেন। বলতে পারেন, এটি একটি মানবিক বিষয়, এতে এমন নেতিবাচক কথা আসবে কেন? কিন্তু তারা নিশ্চয় স্বীকার করবেন যে, নিকট অতীতে বহু রাজনৈতিক নেতার ক্ষেত্রে- শুধু দেশে নয়, বিদেশেও- দেখা গেছে, তাঁরা যখনই কোনো দুর্নীতি বা অন্য কোনো অপরাধে আদালত কর্তৃক শাস্তি পেয়েছেন তখনই ‘গুরুতর’ নানা রোগে ভুগতে শুরু করেন। একপর্যায়ে চিকিৎসার জন্য বাইরে গিয়েই সুস্থ হয়ে যান এবং রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করে দেন।

এ প্রসঙ্গে খালেদা জিয়ার বড় ছেলে, যিনি বর্তমানে বিএনপিরও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের কথা বলা যেতে পারে। ২০০৮ সালে তিনি তৎকালীন সরকারের কাছে ‘আর কখনো রাজনীতিতে জড়াবেন না’- এমন মুচলেকা দিয়ে চিকিৎসার জন্য লন্ডন গিয়েছিলেন, কিন্তু চিকিৎসা শেষে দেশে না ফিরে সেখানে থেকে এখন সরকারবিরোধী নানা তৎপরতা চালাচ্ছেন। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফও দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত হয়ে অসুস্থতার কথা বলে জামিন নিয়ে লন্ডনে যান। এর পর থেকে সেখানে বসেই তিনি পাকিস্তানের ইমরান খানের সরকারের বিরুদ্ধে  কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন। এক-এগারোর সময় অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকেও দেখা গেছে, কারাগারে ‘মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে,’ কিন্তু জামিন পাওয়ার পর খুব অল্প সময়েই সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক রাজনৈতিক তৎপরতায় ফিরে যেতে।

বলা হতে পারে, তারেক রহমান বা নওয়াজ শরিফ, উভয়েই রাজনৈতিক ‘প্রতিহিংসার শিকার’ হয়েছেন। কিন্তু এটা তো সত্য, তাঁরা চিকিৎসার কথা বলে লন্ডনে গিয়েছেন। সরকার বা আদালতও তাঁদেরকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে চিকিৎসা শেষে দেশের ফিরে আসার শর্তে এবং সেসব শর্ত তাঁরা ভেঙেছেন। খালেদা জিয়ার বেলায়ও এমনটা ঘটবে না, তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? খালেদাকে বিদেশ যেতে না দেওয়ার পেছনে এমন আশঙ্কা যে সরকারের মনে কাজ করছে না, তা বলা যায় না। ইতিমধ্যে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীসহ বিএনপির একাধিক নেতা এ বিষয়ে কথাও বলেছেন।

খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার ইচ্ছার মধ্যে মেডিকেল রিজনের চেয়ে রাজনৈতিক কারণটা বেশি বলে মনে করছে সরকার, এটা এখন স্পষ্ট। বিএনপি নেতারাও প্রায় একই কারণেই তাঁদের নেতাকে বিদেশে পাঠাতে চাচ্ছেন, এমন ধারণাও বাতুলতা নয়। খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসা নিতে দেওয়ার যুক্তিটা যদি স্রেফ মানবিকতা হতো, তাহলে তাঁর পক্ষ থেকে প্রচলিত আইন মেনে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করলেই সব ল্যাঠা চুকে যেত। কিন্তু তার ধারেকাছেও বিএনপি নেতারা যেতে রাজি নন। তাঁরা বরং খালেদা জিয়াকে বিদেশে যেতে না দিলে ‘অবিলম্বে’ সরকার পতনের আন্দোলন শুরু করার মুহুর্মুহু ঘোষণা দিয়ে চলছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় তো এমনও বলেছেন যে, তাঁদের কাছে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নয় ‘শেখ হাসিনার পতনটাই’ বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

আমাদের প্রশ্ন হলো, এমন পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষে বিএনপি নেত্রীর প্রতি ‘মানবিক’ হওয়ার সুযোগ কতটুকু থাকে? বিএনপি নেতারা যদি মনে করেন, তাঁদের নেত্রীর জীবন আসলেই সংকটাপন্ন এবং তাঁকে বাঁচানোই এখন তাঁদের অগ্রাধিকার, তাহলে রাজনীতির খেলা ছেড়ে তাঁদের উচিত অন্তত এ ইস্যুতে সরকারের সাথে কোনো দরাদরিতে না যাওয়া। সরকারেরও উচিত হবে খালেদা জিয়ার মতো একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিকের জীবন বাঁচাতে যা প্রয়োজন তা করা।

 

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট