পরিবহন খাতে দ্রুত শৃঙ্খলা ফেরাতেই হবে

সাইফুর রহমান তপন প্রকাশিত: নভেম্বর ২৮, ২০২১, ০২:২০ পিএম

সড়ক পরিবহনে মালিক ও তথাকথিত শ্রমিক নেতাদের দৌরাত্ম্য কতটা প্রবল, তা আবারও ফুটে উঠল শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়া বা ‘হাফ পাস’ ইস্যুতে। সহপাঠীর মৃত্যুর প্রতিবাদ জানাতে, নিরাপদ সড়ক ও অর্ধেক ভাড়ার দাবিতে একদিকে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় আন্দোলন করছে, আরেক দিকে সরকার শিক্ষার্থীদের জন্য বিআরটিসি বাসের ভাড়া অর্ধেক করে দিয়েছে, কিন্তু বেসরকারি নগর পরিবহন মালিকেরা এ ইস্যুতে তাদের অনড় অবস্থান ধরে রেখেছেন। এমনকি সরকারের সঙ্গে দুই দফা বৈঠকের পরও তারা বলছেন, এ সমস্যা সমাধানের ‘যৌক্তিক’ উপায় বের করতে আরও বৈঠক করতে হবে।

সম্প্রতি ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির পর পরিবহন মালিকেরা একদিকে যেমন হুট করে বেআইনিভাবে সব পরিবহন বন্ধ করে যাত্রীদের চরম ভোগান্তিতে ফেলেন, তেমনি আরেক দিকে কোনো আলাপ-আলোচনা ছাড়াই বহু দশক ধরে নগর পরিবহনে প্রচলিত শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার সুযোগটি বন্ধ করে দেন। স্বাভাবিকভাবেই এতে শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় নামে। রাজধানীর কোথাও কোথাও কিছু বাসও ভাঙচুর হয় বাস অপারেটর ও শিক্ষার্থীদের মধ্যকার বচসার জের ধরে। কিন্তু তাতেও বাসমালিকদের টনক নড়েনি। তারা তাদের হাফ-ভাড়াবিরোধী ভাঙা ঢোল বাজিয়েই চলেছেন।

পরিবহন মালিকদের সঙ্গে শ্রমিক নেতাদের কথা বলতে গিয়ে শুরুতে ‘তথাকথিত’ শব্দটি ব্যবহার করা হলো এ কারণে যে, সড়ক পরিবহনে শ্রমিক নেতাদের বেশির ভাগ বাসমালিকও বটেন। তাদের মালিকানাধীন বাস অন্যের নামে যেমন চলছে, তেমনি তাদের নিজেদের নামেও চলে। এ ব্যাপারে কোনো রাখঢাক নেই। এ কারণেই, সম্ভবত, পরিবহনসংক্রান্ত যেকোনো ইস্যুতে মালিক ও শ্রমিক নেতাদের বক্তব্য হুবহু এক হতে দেখা যায়, যদিও উভয়ের স্বার্থ মালিক ও শ্রমিকের চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বিপরীতমুখী হওয়ার কথা।

যাহোক, বাসভাড়া নির্ধারণে যেমনটা দেখা গেছে তেমনি হাফ ভাড়া ইস্যুতেও সরকার বাসমালিকদের ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা পাকিস্তান আমল থেকেই পরিবহনে হাফ ভাড়া দিয়ে আসছে এবং খোদ সড়ক পরিবহন মন্ত্রী নিজেও ছাত্রাবস্থায় এই সুবিধা ভোগ করেছেন, অথচ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক বলে চলেছেন যে, হাফ ভাড়ার বিধান কখনোই ছিল না।

বাস মালিক সমিতির এই নেতা অসত্য কথা বলার পাশাপাশি মনগড়া কিছু কথাও বলছেন। যেমন তিনি বলেছেন, ঢাকা শহরের ৮০ শতাংশ বাসমালিক ‘গরিব’। কেবল একটি বাসের আয় দিয়েই নাকি তাদের সংসার চলে। এটি কি কোনো বিশ্বাসযোগ্য কথা? তাহলে তিনি তার সহযোগীদের নিয়ে এই মালিকদের কাছ থেকে প্রতি মাসে কয়েক কোটি টাকা চাঁদা তোলেন কীভাবে?

এর আগে বাসভাড়া নির্ধারণের সময় এই নেতা বলেছিলেন, ঢাকা শহরের ৯০ শতাংশের বেশি বাস ডিজেলে চলে, যদিও কিছুদিন আগেও বরং এর উল্টোটাই শোনা যেত।

বাসমালিক সমিতির নেতা তার সদস্যদের স্বার্থ রক্ষার জন্য যেকোনো কথা বলতেই পারেন, কিন্তু কোনোরকম যাচাই-বাছাই ছাড়া সে কথার ভিত্তিতে কোটি কোটি যাত্রীর স্বার্থসংবলিত একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় কীভাবে? আমাদের উদ্বেগটা ওখানেই।

আমাদের উদ্বেগের পরিপ্রেক্ষিতেই সরকার ও মালিক সমিতি—উভয় পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যে ডিজেল ও সিএনজিচালিত বাসগুলোকে আলাদা করা হবে। এটা জরুরি ছিল, কারণ ভাড়া বেড়েছে ডিজেলচালিত বাসের, সিএনজিচালিত বাসের নয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত সে প্রতিশ্রুত কাজটি করা হয়নি। ফলে ঢাকা শহরের বেশির ভাগ বাস এই প্রতারণামূলক স্টিকার লাগিয়ে চলছে যে, এটি ডিজেলচালিত।

এখন ঢাকা শহরের ৮০ ভাগ বাসমালিক গরিব, মালিক সমিতির নেতার এ বক্তব্য ধরে যদি শিক্ষাথীদের হাফ ভাড়ার সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়, তা খুবই অন্যায় হবে। শুধু তা-ই নয়, এ অযাচাইকৃত তথ্যের ভিত্তিতে, শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়া চালুর বিনিময়ে, যদি বাসমালিকদের কোনো বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়, তা-ও অন্যায় হবে। কারণ, ওই সুবিধাটুকু দেওয়া হবে রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে, যার দায় শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষকেই বহন করতে হবে।

আমাদের বক্তব্য হলো, শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার পক্ষে দেশে কোনো আইন না থাকলেও এটি একটি প্রথা, যা অন্তত পাঁচ দশক ধরে চলে আসছে। আমাদের প্রতিবেশী ভারত-নেপাল-ভুটানসহ পৃথিবীর বহু রাষ্ট্রেও এমন বিধান চালু আছে। অতএব বাসমালিকদের কথায় তা খর্ব হতে পারে না, বরং আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এ প্রথাটি জোরালোভাবে কার্যকর করা হোক।

কিন্তু সরকার কতটুকু তা করতে পারবে, তা নিয়ে সন্দেহ পোষণের সুযোগ আছে, বিশেষ করে সড়ক নিরাপত্তার জন্য জরুরি বলে বিবেচিত সড়ক নিরাপত্তা আইনটি বাস্তবায়নের হাল দেখে।

এ আইনটি জাতীয় সংসদে পাস হয়েছিল ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে গড়ে ওঠা স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে। কিন্তু ২০১৯ সালে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের বাধার মুখে এর বাস্তবায়ন স্থগিত হয়ে যায়। এখনো আইনটি ওই অবস্থায় আছে। এ নিয়ে কোনো পক্ষ থেকেই ইতিবাচক কোনো কথা শোনা যাচ্ছে না।

২০১৮ সালে আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল শাহজালাল বিমানবন্দরের কাছে শহীদ রমিজউদ্দিন কলেজের দুজন শিক্ষার্থী বেপরোয়া গতির বাসচাপায় নিহত হওয়ার পর। ওই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল ৯ দফা। তখন আন্দোলনের তুঙ্গ মুহূর্তে নিহত শিক্ষার্থীদের পরিবারকে কিছু ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছিল। ওই হত্যাকাণ্ডের দায়ে সংশ্লিষ্ট বাস দুটোর চালক ও হেলাপারকে দ্রুত বিচারের মাধ্যমে যাবজ্জীবন সাজাও দেওয়া হয়েছিল। তবে ওই সাজা কতটুকু কার্যকর হয়েছে, তা আর জানা যায়নি।

এসব তিক্ত অভিজ্ঞতার ফলেই চলমান আন্দোলনেও শিক্ষার্থীরা আবার সে প্রসঙ্গটি তুলেছেন। তারা বলেছেন, শুধু এবারের ৯ দফা নয়, ২০১৮ সালের ৯ দফাও বাস্তবায়ন করতে হবে।

এদিকে এবার আন্দোলন শুরু হয়েছিল সম্প্রতি ডিজেলে মূল্যবৃদ্ধির পর পরিবহনে যে ভাড়া-নৈরাজ্য শুরু হয়, তার প্রতিবাদে, শিক্ষার্থীদের জন্য নগর পরিবহনে হাফ ভাড়া নিশ্চিত করার দাবিতে। তবে হাফ ভাড়ার আন্দোলন চলাকালেই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী একটা ট্রাকের ধাক্কায় মতিঝিলের কাছে নটর ডেম কলেজের এক শিক্ষার্থী মারা যায়। এ ঘটনার ঠিক পরদিন উত্তর সিটি করপোরেশনের আরেকটি ময়লাবাহী ট্রাকের ধাক্কায় পান্থপথে এক সাবেক সংবাদকর্মী মারা যান। ফলে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে নিরাপদ সড়কের পুরোনো দাবিটিও জোরালো হয়ে উঠেছে।

আন্দোলনটি ইতিমধ্যে ঢাকার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। তা অচিরেই দেশব্যাপী ছড়াবে না, এমন কথা কেউ বলতে পারবে না। আর ২০১৮ সালের মতো আবারও যদি একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়, তা যে বিশেষ মহলের জন্য আলু পুড়ে খাওয়ার সুযোগ তৈরি করবে না, তার নিশ্চয়তাই-বা কে দিতে পারে?

তাই সরকারের উচিত এখনই সক্রিয় হওয়া এবং পরিবহন সেক্টরের নিয়ন্ত্রণ মালিকদের হাতে ছেড়ে না দিয়ে, নিজের হাতে নেওয়া। শুধু তা-ই নয়, শিক্ষার্থীদের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনে সে অনুসারে পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা তৈরির লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

 

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট