পাকিস্তান সমর্থন

এ তোমার পাপ, এ আমার পাপ

প্রভাষ আমিন প্রকাশিত: নভেম্বর ২৩, ২০২১, ০৭:১০ পিএম

বাংলাদেশের বিপক্ষে খেলায় পাকিস্তানের জয়ে উল্লসিত বাংলাদেশের ‘কুলাঙ্গার’দের বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় বইছে সারাদেশে। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের জার্সি গায়ে, পাকিস্তানের পতাকা নিয়ে জয়ধ্বনির ঔদ্ধত্যে বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ সবাই। এটাকে স্পোর্টিংলি নেওয়া বা হালকাভাবে উড়িয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটা স্পষ্টতই রাষ্ট্রদ্রোহ। যারা এই অপকর্ম করেছে বিভিন্ন টেলিভিশন বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে ছবি সংগ্রহ করে তাদের চিহ্নিত করা সম্ভব। তাদের সবার বিরুদ্ধে অবশ্যই রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করতে হবে। আশার কথা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বিষয়টি তদন্ত করে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু বিষয়টি নিছক আশ্বাসের নয়। আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে দাবি জানাচ্ছি, অবিলম্বে যেন তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। তবে নিন্দা, প্রতিবাদ, ঘৃণা বা চিহ্নিত কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেই এই সমস্যার সমাধান হবে না। যত কষ্টই হোক, যত সময়ই লাগুক, দেশদ্রোহিতার এই শেকড় উপড়ে ফেলতে হবে চিরদিনের জন্য।

তবে তার আগে আমাদের কিছু আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মসমালোচনা করতে হবে। কেন, কীভাবে দেশবিরোধীরা এত সাহস পেল, প্রকাশ্যে দেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারলো? এদের শক্তির উৎস কোথায়, কারা এদের মদদ দিচ্ছে, কারা এদের মাথায় সাম্প্রদায়িকতা আর দেশদ্রোহিতার বীজ বপন করছে, তাদের আগে চিহ্নিত করতে হবে। পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা নিয়ে উল্লাস করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া তরুণদের দেখে আমার ঘৃণা যেমন হয়েছে, করুণাও হয়েছে। যারা বাংলাদেশের বিপক্ষের ম্যাচে পাকিস্তানের হয়ে গলা ফাটিয়েছে, তাদের সবার বয়স ১৮ থেকে ২৫। আমি বিস্ময়ের সঙ্গে ভাবি, একাত্তর সালে এই বয়সের তরুণেরা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে পায়ে দলে, নিজের জীবনের মায়া না করে দেশের জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিশোর, তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক সাহসিকতার গল্প এখনও আমাদের অনুপ্রাণিত করে। ক্র্যাক প্লাটুনের তরুণদের ভয়ঙ্কর সব যুদ্ধের কাহিনি যতবার শুনি, ততবার শিহরিত হই।

কিশোর মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হক, যিনি পরে বীর প্রতীক খেতাব পেয়েছিলেন, নিজেকে যুদ্ধ করার যোগ্য প্রমাণ করতে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানকে তার বাসার ড্রয়িং রুমে ঢুকে গুলি করে মেরেছিলেন। এইসব সাহসিকতার গল্প কি এই প্রজন্মের কিশোরদের, তরুণদের অনুপ্রাণিত করতে পারছে না, নাকি তারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটা জানেই না? ১৮—২৫ এই বয়সটাই অন্যরকম। অন্যায় দেখলেই রক্ত টগবগ করে। এই তরুণদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করার কথা। দেশকে আরো এগিয়ে নিতে, পূর্বসুরীদের স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে কাজ করার কথা। সেই তারাই প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে দেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে। শুধু মাঠে গিয়েই যে তারা গলা ফাটাচ্ছে, তাই নয়। সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায়ও মাঠে বেশি ছিল এই ১৮—২৫ বছর বয়সীরা। কারা তাদের হৃদয়ে দেশপ্রেমের বদলে দেশদ্রোহিতা, ধর্মনিরপেক্ষতার বদলে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ঢেলে দিল?

এই বীজ নতুন নয়। ৭০-এর নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অনেকে ভোট দিয়েছিল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও এ দেশের স্বাধীনতাবিরোধীরা পাকিস্তানি হানাদারদের সহযোগী হিসেবে হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের মতো যুদ্ধাপরাধ করেছিল। স্বাধীনতার পরও একাত্তরের ঘাতক-দালালদের নির্মূল করা যায়নি। চার দশক পর বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছেন। কিন্তু তারা ঝারে-বংশে এতদিনে অনেক বেড়ে গেছে। সর্বনাশের বীজটা রোপিত হয়েছে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট। সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছর পরই উল্টোপথে হাঁটতে শুরু করে বাংলাদেশ। ভেতরে ভেতরে চলে পাকিস্তানিকরণের কাজ।

৭৫-এর পর ২১ বছর চলেছে ইতিহাস বিকৃতি, আর ইতিহাসের ভুল পাঠ। কিন্তু গত এক যুগ তো ক্ষমতায় আছে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ। আর যে প্রজন্ম এখন সাম্প্রদায়িক হামলায় নেতৃত্ব দিচ্ছে বা পাকিস্তানের হয়ে দেশের বিরুদ্ধে গলা ফাটাচ্ছে, তারা তো বর্তমান সরকারের আমলেই বেড়ে উঠেছে। তাহলে আমরা কেন তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানাতে পারলাম না, কেন বাংলাদেশের মৌলিক চেতনা তারা ধারণ করতে পারল না, কেন দেশপ্রেম তাদের উদ্বেলিত করে না? সময় যখন বিরূপ ছিল, তখনও স্বাধীনতাবিরোধীরা ঘাপটি মেরেই থাকত। সরাসরি দেশের বিরুদ্ধে বলার মতো সাহস তাদের ছিল না। কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় যখন মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে স্লোগান ওঠে, তরুণ যখন ‘আমি রাজাকারের সন্তান’ লিখে রাজপথে দাঁড়ায়, দ্রোহী তারুণ্য যখন সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালায়, পাকিস্তানের পক্ষে স্লোগান দেয়, আত্মঘাতী বোমা হামলায় অংশ নেয়, আমি বিস্মিত হই, বেদনার্ত হই, ক্ষুব্ধ হই। পাশাপাশি শঙ্কিতও হই। তাহলে কি আমাদের পূর্বসুরীরা যে দেশ স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন, সেই দেশটি আমরা ঠিকমতো গড়তে পারলাম না? কোথাও কি বড় রকমের ভুল হয়ে গেল!

জীবনে কোটিবার জাতীয় সংগীত শুনেছি। এই মধ্য বয়সেও যতবার শুনি, ততবার চোখ ভিজে আসে। আর এই বাংলায় দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবিও শুনতে হয়। এখনও বাংলাদেশের যেকোনো সাফল্য, যেকোনো বিজয় আমাকে গর্বিত করে। সেই তরুণটিকে করে না কেন?

মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ একযুগ ধরে ক্ষমতায় আছে। কিন্তু ৭০-এর আওয়ামী লীগ আর এখনকার আওয়ামী লীগ এক নয়। আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক সাফল্য যেমন আছে, অনেক সমালোচনাও আছে। সরকার অন্যায় করলে তার প্রতিবাদ করা যাবে। কিন্তু আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে গিয়ে যেন কেউ বাংলাদেশকে অস্বীকার না করি। মা গরীব হলেও মাকে ছাড়া যায় না। যারা ছাড়ে তারা অবশ্যই ‘কুলাঙ্গার’।

আওয়ামী লীগ এক যুগ ক্ষমতায় থাকলেও এই ক্ষমতায় থাকার জন্যই তারা অনেক আপোস করেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করলেও সাম্প্রদায়িক শক্তিকেও অনেক ছাড় দিয়েছে। আশির দশকে এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করলে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, এমনকি জামায়াতও প্রতিবাদ করেছিল। কিন্তু আজ এই বাংলায় রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে প্রশ্ন তোলার পরিবেশ নেই। গ্রামে ওয়াজের নামে নিয়মিত সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানো হয়। কিন্তু যাত্রাপালা নেই, বাউলরা নির্বিঘ্নে গাইতে পারে না। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডও নেই বললে চলে। যারা পাকিস্তানের পতাকা নিয়ে স্টেডিয়ামে গেছে, তাদের অবশ্যই চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করতে হবে। কিন্তু এই কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করলেই সমস্যার সমাধান হবে না। তরুণ প্রজন্মের বুকে বাংলাদেশের প্রতি ভালোবাসা জাগাতে হবে, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সেজন্য চাই বড় রকমের সাংস্কৃতিক জাগরণ। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে আমরা যেন নতুন করে দেশকে ভালোবাসার শপথ নিই : আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।

লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক