শিক্ষা খাত সংস্কারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিন

ড. মো. আইনুল ইসলাম প্রকাশিত: নভেম্বর ১০, ২০২৪, ১২:১১ পিএম

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে বিপুল সমর্থন নিয়ে শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের নীতিনির্ধারকের ক্ষমতায় এসেছে। এরপর থেকে সংবিধান, জাতীয় সংগীতসহ রাষ্ট্রের খোলনলচে বদলে ফেলের একের পর এক দাবি থেকে বোঝা যায়, এ সরকারে কাছে মানুষের প্রত্যাশা আকাশচুম্বী। স্বভাবতই ৫৩ বছর ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষার গিনিপিগে পরিণত হওয়া শিক্ষার ক্ষেত্রেও সংস্কার ও পরিবর্তনের প্রত্যাশা বিস্তর ও বহুমাত্রিক। কিন্তু অটোপাসের পরও ফেল করাদের পাস করিয়ে দেওয়ার দাবিতে জেরবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শিক্ষা খাত নিয়ে কতটুকু কী করতে পারবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তাই হয়তো নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন ও সংবিধান সংস্কারে কমিশন গঠিত হলেও অতিজরুরি শিক্ষার সংস্কারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার লক্ষ্যযোগ্য কোনো পদেক্ষপ নেয়নি। রাস্তায় রাস্তায় রাজনীতির শাস্ত্র চর্চা করে কোনোমতে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষা নেওয়া আমাদের রাজনীতিবিদরা বাংলাদেশের ঘুণে ধরা, পচে যাওয়া শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারে যে গুরুত্ব দেবেন না, তা সহজেই অনুমেয়। কারণ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সময়ের কেরানি তৈরির শিক্ষাব্যবস্থার উত্তরাধিকার এই দেশের মানুষ প্রকৃত শিক্ষিত হলে রাজনীতিবিদদের রাষ্ট্র নিয়ে জাল-জালিয়াতি সহজেই ধরে ফেলবে। এ অবস্থায় বহু প্রত্যাশার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আর কিছু করতে না পারুক, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কারে অন্তত একটি রূপরেখা নির্ধারণ করে দেওয়া এখন সময়ের দাবি।

গ্রস ন্যাশনাল ইনডেক্স (জিএনআই), হিউম্যান অ্যাসেটস ইনডেক্স (এইহচএআই), ইকোনমিক ভালনারেবিলিটি ইনডেক্সসহ (ইভিআই) প্রভৃতি চলক বিশ্লেষণ করে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে অনুন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা দিয়েছে বেশ আগেই। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর ইশারায় চলা জাতিসংঘের দেওয়া এই মর্যাদায় ভর করে অনেক দিন ধরেই জনগণকে স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে, ২০২৭ সালে বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে উন্নয়নশীল, ২০৩১ সালে মধ্যম আয়, আর ২০৪১ সালে উন্নত দেশের কাতারে শামিল হবে। ভুলভাল তথ্যকে গড় দিয়ে ভাগ করে পরিসংখ্যানের যুক্ত দিয়ে আরও বলা হচ্ছে, এ দেশে মাথাপিছু আয় বেড়েছে কয়েক শ গুণ, জীবনের আয়ুক্ষমতা ও মানও বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। ফলে শিক্ষার হারের সাথে বেড়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও। ১৯৭১ সালে উচ্চশিক্ষার জন্যে ৪টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও ১টি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও ৭টি মেডিকেল কলেজ নিয়ে যাত্রা করা এই দেশ ৫৩ বছর পরে এসে ৬১টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও ১১৬টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, ৫টি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ৫টি সরকারি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৩৭টি সরকারি ও ৭২টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজসহ ব্যাঙের ছাতার মতো পেয়েছে অসংখ্য পলিটেকনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আছে ৩টি সরকারি আলিয়া মাদ্রাসাসহ ১৯ হাজার ১৯৯টি কওমি মাদ্রাসা। জনসংখ্যা অনুপাতে এত এত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাজনীতিবিদদের সফলতা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, মুনাফাখোরি মনোবৃত্তি নিয়ে গড়ে ওঠা এ দেশের সিংহভাগ মূলধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই ফি বছর লাখ লাখ ‘জি জি হুজুর’ মোসাহেব ও দাস মানসিকতার জ্ঞানখাটো মানুষ উৎপাদন করছে আর বিশেষায়িত মেডিকেল ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ উৎপাদন করছে যথাক্রমে রক্তমাংসের ‘প্যাথলজি টেস্ট মেশিন’ আর সব পাঠ্যবই ইংরেজিতে হলেও শুদ্ধ করে একপাতা ইংরেজি না লিখতে পারা ‘তুকতাক প্রকোশলী’। এসব দেখে সংগত কারণেই স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে এসে চারিদিকে রাষ্ট্রের সবকিছু আবার শূন্য থেকে শুরু তাগিদ উঠেছে, যার ভিড়ে আসল কাজ শিক্ষাটাই শুধু চাপা পড়েছে।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারে রাজনীতিবিদরা যে চরম অনাগ্রহী, তার উৎকৃষ্ট অনেক প্রমাণ আছে। প্রথম প্রমাণ হচ্ছে, ২০১০ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত দেশের ২৪টি রাজনৈতিক দলের নেতাদের ছেলেমেয়ের ওপর চালানো প্রোবের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামীসহ নামসর্বস্ব রাজনৈতিক দলের ৭৪ শতাংশ নেতার ছেলেমেয়েই বিদেশে পড়াশোনা করছে। এদের মধ্যে ছিলেন আওয়ামী লীগের ৩৪ নেতা, বিএনপির ৩২, জাতীয় পার্টি (এরশাদ) ৫, জামায়াতে ইসলামী ৬, জেপি ২, জেএসডি (ইনু) ৩, ওয়ার্কার্স পার্টি ২, সিপিবি ৩, গণফোরামের ২, এলডিপি ২ এবং অন্যান্য দলের ১৪ নেতা। এই নেতাদের বেশির ভাগই মহা-উৎসাহ ও গর্বে তাদের ছেলেমেয়েরা কোথায় ও কী অর্জন করেছে, তার বর্ণনা দিয়েছেন। তবে সতর্ক কেউ বিরক্তি নিয়ে এ বিষেয়ে কোনো কথাই বলেননি। কেউ আবার জনগণের কল্যাণকাজে মহাব্যস্ততা দেখিয়ে সটকে পড়েছেন। ২০২৪ সালের নেতাদের সন্তানদের বিদেশে পড়াশোনা যে ৯৯ শতাংশই ছাড়িয়ে গেছে, তা গবেষণা না করেই বলা যায়। কেননা দেশের মানুষের অর্থ লুটপাট করে বিদেশি শিক্ষায় শিক্ষিত ২০১০ সালের সন্তানেরা অধিকাংশই হয় বিদেশে আবাস গেড়েছেন, নয়তো দেশে ফিরে বাবার ফেঁদে বসা মুনাফাখোরী ব্যবসা অথবা জনগণের পয়সায় রাজনীতির ব্যবসায় জড়িত হয়ে পড়েছেন। ক্ষমতায় থাকুন আর না-ই থাকুন রাজনীতিবিদরা সবসময়ই জাতির উন্নয়ন, জনগণের কল্যাণ ও শিক্ষিত জাতি দর্শনের কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের প্রশ্ন এলে জাতিকে লবডঙ্কা ও বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়েছেন, দেশব্যাপী বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসের অরাজকতা-সহিংসতায় উসকানি-পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন। রাজনীতিবিদদের সন্তানদের বিদেশে পড়াশোনার আধিক্যকে হালকা করে দিতে ২০২৩ সালের মে মাসে নতুন মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণার পর প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাসহ সচিব পদমর্যাদার ৮৬ জনের সন্তান কে কোথায় রয়েছে এবং কী করছে, তা নিয়ে অনুসন্ধান করে রাজনৈতিক সরকারই বলেছে, অতিগুরুত্বপূর্ণ ৮৬ সচিবের ২৯ জনের সন্তান ও পরিবার বিদেশে বসবাস করছে, যার মধ্যে ১৮ জন সচিবের ২৫ সন্তান-পরিবার আছে যুক্তরাষ্ট্রে। সচিবরা তাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে দেশের উচ্চশিক্ষার প্রশংসা করে বক্তব্য দেন। অথচ তাদের সন্তানদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তো দূরের কথা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়ান না। পড়ালেও তার হার খুবই কম। সরকারি আমলাদের কত শতাংশ সন্তান বিদেশে পড়ছে, সে নিয়ে তথ্য-উপাত্ত পাওয়া না গেলেও তা যে রাজনীতিবিদদের চেয়ে খুব একটা কম না, সে নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ নেই। কারণ, রাজনীতিবিদরা আমলাদের কথাতেই পরিচালিত হন। দ্বিতীয় প্রমাণ হচ্ছে, শিক্ষায় সরকারের বরাদ্দ। ২০০৯-১০ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট প্রথম বাজেট পেশ করার পর থেকে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ থেকেছে। ১৬ বছরের মধ্যে শুধু ২০১৬-১৭ অর্থবছরে শিক্ষাখাতে জিডিপির সর্বোচ্চ ২ দশমিক ৪৯ শতাংশ বরাদ্দ দিয়েছে। এর পরের ৮ বছরে বরাদ্দ কেবলই কমিয়েছে, যা ২০২৩-২৫ অর্থবছরের একেবারে তলানিতে ঠেকেছে (মোট বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ)। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই বরাদ্দ ছিল ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সার্বিকভাবে বাজেটের ৬৪ শতাংশ ছিল পরিচালন ব্যয়, বাকি ৩৬ শতাংশ উন্নয়ন ব্যয়। পরিচালন ব্যয়ের ১৫ দশমিক ৮ শতাংশই ব্যয়ই গেছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতায়, যার সিংহভাগই শুধু উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার। প্রতিবছর বহুমাত্রিক সুযোগ-সুবিধা ও বেতনভাতা বৃদ্ধির জন্য চাপ দেওয়া রাজনীতিবিদ ও আমলারা কখনো বলেন না যে, ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৩৫টি স্বল্পোন্নত দেশ গড়ে তাদের জিডিপির ২ শতাংশ বা তার বেশি শিক্ষাখাতে ব্যয় করেছে। আর একই সময়ে বাংলাদেশের গড় শিক্ষা ব্যয় ছিল জিডিপির মাত্র ১ দশমিক ৮ শতাংশ। দুর্ভিক্ষ, গৃহযুদ্ধ ও সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর খনিজ লুটপাটের শিকার শুধু সোমালিয়া, হাইতি, দক্ষিণ সুদান ও মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র বাংলাদেশের পরে আছে।

শিক্ষায় দেউলিয়াত্বে জনসংখ্যা, বেকারত্ব ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আক্ষরিক অর্থেই মহাবিপজ্জনক সমস্যার মুখে দাঁড়িয়ে আছে, যা দেশে সর্বোচ্চ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী যাদের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছর, তাদের এক-তৃতীয়াংশের (সংখ্যায় প্রায় ৭৪ লাখ, ১৭ শতাংশ পুরুষ ও ৮৩ শতাংশ নারী) কোনো কাজ, শিক্ষা বা প্রশিক্ষণে না থাকায় (অর্থাৎ সুস্থ-সবল-সচল হাত-পায়ের মনুষ্য জড়বস্তু) তথ্য স্পষ্টভাবে প্রমাণ করছে। কিন্তু এখনো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা চলছে দিশাহীনভাবে। এক্ষেত্রে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাতের গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রণিধানযোগ্য। বাংলাদেশের শিক্ষার সংস্কার প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “‘শিক্ষা’ বিষয়টি জটিল ও বহুমাত্রিক। শিক্ষাকে কোনো খাতভুক্ত করাও সম্ভব নয়। ‘শিক্ষা’ বিষয়টি জটিল শুধু এ জন্যই নয় যে শিক্ষার সাথে সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বহু ধরনের-বহু রূপের—সংশ্লিষ্ট পরিচালন প্রতিষ্ঠান (সরকারি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়-অধিদপ্তর-বোর্ড-কারিকুলাম বোর্ড-শিক্ষা বোর্ড থেকে শুরু করে বেসরকারি বিভিন্ন ধরন) থেকে শুরু করে একই শিক্ষাস্তরে বহুধারার, যেমন প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে ১৫টি ধারা; জটিল এ জন্যও যে শিক্ষা নিয়ে কে যে কী করে এবং কেন করে, তা আসলে কেউই জানে না। ‘শিক্ষা-ব্যবস্থা’ সিস্টেমটা এতই গলদমার্কা যে কারো ওসব জানার প্রয়োজন পড়ে না, কেউ এসব নিয়ে মাথা ঘামালে হয় তার মাথায় গন্ডগোল হয়ে যাবে, নয় তো প্রশাসন-এস্টাবলিশমেন্ট তাকে রীতিমতো মাথা খারাপ প্রমাণ করে ছাড়বে। ‘শিক্ষা’ বিষয়টির সবচেয়ে জটিল ও মারাত্মক বিপর্যয়কর দিক হলো ‘শিক্ষার জ্ঞানতত্ত্বের’ সাথে শিক্ষাবাস্তবতার ক্রমবর্ধমান ফারাক।”

জটিল-কঠিন-প্যাঁচালো এই শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের খুব একটা যে কিছু করার নেই, সেটি সহজেই বোধগম্য। কিন্তু রাজনীতিবিদরা তো শুধু জনগণকে শিক্ষিত জাতি উপহার দেয়ার মিছে স্বপ্ন দেখান। আর নিজের ছেলেমেয়েদের বিদেশে পাঠিয়ে স্থানীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় চরম আস্থাহীনতার প্রমাণ দেন। জনগণ যখন দেখে, রাজনীতিবিদরা নিজ সন্তান-পরিবারকে শিক্ষা ও স্থায়ী হতে বিদেশে পাঠিয়ে দেন, তখন বৈষম্যনির্ভর অসামঞ্জস্যপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থার পুনরুদ্ধারে তাদের যেকোনো উদ্যোগ নিয়ে স্বভাবতই সন্দেহ জাগে। তাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে সবার প্রত্যাশা।

ব্রিটিশ ও পাকিস্তানিদের প্রায় আড়াই শ বছরের শাসন-শোষণ আর স্বাধীন রাষ্ট্রের সামরিক জান্তা-রাজনীতিবিদ-আমলাদের অপশাসন-লুটপাটে দেশের জনগণের বিশ্ববীক্ষার সুযোগ অনেক আগেই ধুলিস্যাৎ হয়ে গেছে। ফলে দেশে প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে ১৫টি ধারা, এসএসসি পর্যন্ত ১৭টি। এর মধ্যে আবার ১৯৭৭ সালে প্রথম শিক্ষাক্রম প্রণয়নের পর ১৯৮৬ সালে পাঠ্যবইয়ে পরিমার্জন করা হয়, ১৯৯২ সালে প্রাথমিক স্তরে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমে রূপান্তর হয়, ১৯৯৫ সালে মাধ্যমিক স্তরে উদ্দেশ্যভিত্তিক শিক্ষাক্রমে হয়, ২০০২ সালে প্রাথমিক শিক্ষাক্রমের কিছু পাঠ্যবইয়ের পরিমার্জন হয়, ২০১২ সালে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হয়। এর পরের একদশকে আরও কয়েকবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ২০২৪ সালে সম্পূর্ণ নতুন শিক্ষাক্রম শুরু হয় সবধরনের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা বাদ দিয়ে, যার মূল উপজীব্য হচ্ছে শিশুশিক্ষার্থীদের ডিম ভাজা, আলু ভর্তা ও বাজার করা শেখানো; যাতে করে রাজনীতিবিদ-আমলাদের সন্তান ও পোষ্যরা ভবিষ্যতে উচ্চশিক্ষিত গৃহপরিচারক-পরিচারিকা পায়। এরপর আবার বছরের ঠিক মাঝে এসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অত্যন্ত যৌক্তিক কারণেই বার্ষিক পরীক্ষা যোগ করে মাঝামাঝি এক অবস্থান নিয়েছে। এ কথা বলতে দ্বিধা নেই, শিক্ষাখাতে নীতিনির্ধারকেরা ৫৩ বছরে বাংলাদেশে আইয়ামে জাহেলিয়া বা অন্ধকার যুগ কায়েম করেছেন, যার জ্বলন্ত প্রমাণ হচ্ছে ‘লার্নিং টু রিয়ালাইজ এডুকেশনস প্রমিজ’ শীর্ষক বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশসংক্রান্ত প্রতিবেদনে; প্রাথমিকের মোট ছাত্রছাত্রীর অর্ধেকের বেশি ১০ বছর বয়সী স্কুলের পড়ায় ন্যূনতম দক্ষ নয়, ১৫-২৪ বয়সীদের এক-চতুর্থাংশের বেশি কোনো শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নেই, প্রাথমিকের ১১ বছর বয়সী শিশুরা এখানে যা শেখে, তা অন্য দেশের শিশুরা শেখে সাড়ে ৬ বছরে। অর্থাৎ জীবনের শুরুতেই এ দেশের শিশুরা বহির্বিশ্বের শিশুদের চেয়ে সাড়ে ৪ বছর পিছিয়ে থাকছে। এ দেশে তৃতীয় শ্রেণির শিশুর ৬৫ শতাংশই ইংরেজি তো আকাশ-কুসুম বাংলাই পড়তে পারে না, পঞ্চম শ্রেণি পাস ৭৫ শতাংশই গণিতের মৌলিক সমস্যার সমাধান করতে পারে না।

জ্ঞানেতত্ত্বর গুরু মহাজ্ঞানী প্লেটো (খ্রিষ্টপূর্ব ৪২৭-খ্রিষ্টপূর্ব ৩৪৭) তার ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে মানুষের শিক্ষা, শিক্ষক ও সংঘবদ্ধ জনগোষ্ঠীর (জাতি-রাষ্ট্র) জন্য শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে অনেক উক্তি করে গেছেন, যুগোপযোগিতার কারণে তার সেসব উক্তি জ্ঞানসমাজে এখনো বেদবাক্য। বাংলাদেশের শিক্ষা যাত্রার চলমান প্রবণতায় মহাজ্ঞানী প্লেটোর তিনটি উক্তির গ্রহণযোগ্যতা খুঁজে দেখা যায়। শিক্ষা নিয়ে তিনি বলেছিলেন, “সবচেয়ে কার্যকর ধরনের শিক্ষা হলো তা, যা একটি শিশুকে সুন্দর জীবন নিশ্চিত করার পথে নিয়ে যায়।” শিক্ষক সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, “একটি শিশুকে শাসন ও তাচ্ছিল্য করে শেখার প্রশিক্ষণ দেবেন না; তাদের মনকে যা আনন্দ দেয়, তার মাধ্যমে নির্দেশনা দিন, যাতে করে আপনি সঠিক ও কার্যকরতার সাথে প্রত্যেকের প্রতিভার অদ্ভুত বাঁককে আরও ভালোভাবে আবিষ্কার করতে সক্ষম হন।” আর জাতি-রাষ্ট্রের করণীয় সম্পর্কে বলেছিলেন, “শিক্ষা যে দিশায় শুরু হয়, তা দিয়ে ভবিষ্যৎ বিনির্মিত হয়।” এসব উক্তির ধারেকাছেও বাংলাদেশ নেই। ২৪০০ বছর আগে একজন শিক্ষক হিসেবে প্লেটো পাশ্চাত্যের মানুষের উন্নত ও সুন্দর ভবিষ্যৎ রচনার জন্য কী কী করণীয়, তা প্রচার করেন। তার ছাত্র ছিলেন এথেন্সের অ্যারিস্টোনিমাস, এরিস্টটল, এথেনিয়াস, চিয়ন, করিসকাস, যাঁরা পরে শিক্ষক হয়ে প্লেটোর জ্ঞানের আলো চারিদিকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। এর পরের কয়েক শত বছর ধরে পাশ্চাত্যের সমাজে দর্শন, সমাজ, রাষ্ট্র, সাহিত্য, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, চিকিৎসা, গণিত, সমর ও প্রকৌশলসহ নানা বিদ্যায় অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটতে থাকে। সমাজে বসবাসকারী মানুষজনের এই বিকাশ যে বাধাহীনভাবে চলেছে, তা নয়। শাসক শ্রেণির লোভ-লালসা আর মানুষজনকে দাস বানিয়ে রাখার প্রবণতা সমাজ ও রাষ্ট্রের বিকাশ থমকে দিয়েছে। তবু জ্ঞানের আলো পাওয়া পাশ্চাত্যের বিকাশধারা কখনোই বন্ধ হয়ে যায়নি। এই বিকাশ দিয়েই পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রগুলো বাকি বিশ্বের ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য চালিয়ে যাচ্ছে। পাশ্চাত্যের শিক্ষাকে প্রগতির বাহন করার সুফল উপলব্ধি করে এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকার কিছু দেশ শাসকগোষ্ঠীর শোষণপ্রক্রিয়া বন্ধ করার সুযোগ পেয়েই সবার আগে কার্যকর শিক্ষা অর্জনকে মনেপ্রাণে ধারণ করেছে। আমাদের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তো শোষক শ্রেণির প্রতিনিধি নয়। তাদের কাছ থেকে তাই শিক্ষায় এ দেশের মানুষকে একটা দিশা দেখানোর আশা করাই যায়।

লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশে অর্থনীতি সমিতি