ইরান ইসরায়েলে দুই দফা বড় রকমের হামলা চালানোর পরও এখন পর্যন্ত কোনো জবাব দেয়নি তেল আবিব। সর্বশেষ গত ১ অক্টোবর ইরান ইসরায়েলের ওপর যে হামলা চালিয়েছে, তা ছিল আগের হামলার চেয়ে বড়। ইসরায়েলের যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নিজেই স্বীকার করেছেন যে এই হামলা ছিল ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় হামলা। যদিও তিনিসহ ইসরায়লি কর্মকর্তারা প্রথমদিকে এই হামলাকে ব্যর্থ বলে দাবি করেছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে ইসরায়েলের ব্যর্থতা এবং তাদের ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত তথ্য একেবারে গোপন রাখা সম্ভব হয়নি।
ইরান সর্বশেষ হামলা চালানোর পরপরই ইসরায়েল সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ করে সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে ইসরায়েলি গণমাধ্যমের ওপর সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়। ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র যেসব জায়গায় আঘাত করেছে সেই সব জায়গার কোনো খবর, স্থিরচিত্র বা ভিডিও ফুটেজ প্রচার করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন ইসরায়েলি কর্মকর্তারা। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এই নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন তারা?
ইরান যে দুই দফা ইসরায়েলের ওপর হামলা চালিয়েছে, তার প্রত্যেকবারই বেসামরিক কোনো লক্ষ্য বস্তুতে হামলা চালায়নি। ইরান আগে পরে সবসময় বলেছে যে, তারা ইসরায়েলের শুধুমাত্র সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করেছে এবং সেই সব সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানো হয়েছে, যেসব লক্ষ্যবস্তু ইরান বা তার স্বার্থের বিরুদ্ধে হামলা চালানোর সাথে জড়িত ছিল। অর্থাৎ ইসরায়েল যেসব ঘাঁটি বা স্থাপনা ব্যবহার করে ইরানের স্বার্থে আঘাত করেছে, শুধুমাত্র সেইসব ঘাঁটি ও স্থাপনায় ইরান হামলা চালিয়েছে।
ইরান সর্বশেষ যে হামলা চালিয়েছে তার প্রধান লক্ষ্যবস্তু ছিল ইসরায়েলের নেভাটিম বিমানঘাঁটি, নেটজারিম বিমানঘাঁটি, তেলনফ সামরিক ঘাঁটি এবং তেল আবিবে অবস্থিত ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থার মোসাদের সদরদপ্তর। ইরানের সুস্পষ্ট অভিযোগ, এইসব ঘাঁটি থেকে ইরানের স্বার্থের ওপরে হামলা চালানো হয়েছে, ইরানে হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াকে হত্যা করা হয়েছে এবং লেবাননের হিজবুল্লাহ আন্দোলনের মহাসচিব সাইয়েদ হাসান নাসরুল্লাহর ওপর ভয়াবহ বিমান হামলা চালানো হয়েছে। সেই বিমান হামলায় হাসান নাসরুল্লাহসহ ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসির অন্তত একজন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা মারা গেছেন। এইসব অন্যায় অপরাধ এবং হামলার জবাব দিতে ইরান ১ অক্টোবর সর্বশেষ হামলা চালায়। হামলার পর বলা যায় সারা বিশ্ব কেঁপে উঠেছিল। সবাই ধারণা করেছিল, কী কাজ করল ইরান! নিশ্চয়ই ইসরায়েল ইরানকে তছনছ করে দেবে। সাথে থাকবে আমেরিকার মতো মহাশক্তিশালী দেশ। এবারে ইরানের আর রক্ষা নেই। কিন্তু এই লেখা যখন লিখছি তখন ইসরায়েলে ইরানের সর্বশেষ হামলার ১২ দিন পেরিয়ে গেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ইরানে হামলা চালানোর দুঃসাহস করেনি ইসায়েল। হামলার পরপরই নেতানিয়াহু বলেছিলেন, ‘ইরান বড় ভুল করেছে, এর চরম মূল্য দিতে হবে।’
সে সময় ভাবটা এরকম ছিল যেন, যেকোনো সময় ইরান আক্রান্ত হবে, ইরানকে তছনছ করে ফেলবে। কিন্তু তার কিছুই ঘটেনি। ইরান ইরানের জায়গায় আছে বরং হিজবুল্লাহ এবং ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের একের পর এক হামলায় দিশেহারা ইসরায়েল। তার সাথে যোগ হয়েছে ইয়েমেন এবং ইরাকের প্রতিরোধ যোদ্ধারা।
ইসরায়েলে হামলার পরপরই ইরান ঘোষণা করেছে, তাদের প্রতিশোধ নেওয়া শেষ। তবে ইরানি হামলার বিরুদ্ধে যদি কোনো রকমের পাল্টা হামলা বা পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করে তেল আবিব, তাহলে তেহরান বহুগুণ বেশি শক্তি নিয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আবার হামলা চালাবে। ইরানের কোনো কোনো কর্মকর্তা এমনও বলেছেন, ইরান এর চেয়ে ১০ গুণ বেশি শক্তি দিয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হামলা চালাবে। কোনো কোনো সূত্র থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল যে, ইসরায়েল যদি ইরানের ওপর কোনো রকম হামলা চালানোর চেষ্টা করে তাহলে ইরান তার ২ হাজার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র রেডি রেখেছে ইসরায়েলে হামলা চালানোর জন্য।
ইরান ইসরায়েলে হামলা চালানোর পর পরই মার্কিন প্রশাসন জানিয়েছিল, তারা ইরানের সাথে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে না; কিন্তু ইসরায়েলকে সহযোগিতা করবে। এর অর্থ হচ্ছে ইসরায়েল যদি ইরানে হামলা চালায়, সেই হামলা সফল করার জন্য আমেরিকা ইসরায়েলকে সাহায্য করবে। এটা হলো সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে সহজ বিশ্লেষণ। কিন্তু এই রকমের আশ্বাসের পরেও ইসরায়েল এখনো ইরানে বিরুদ্ধে হামলা করেনি। এর মানে বোঝা যাচ্ছে যে ইসরায়েল ইরানের আঘাত সামলে নিয়ে যে পাল্টা আঘাত করবে, সে অবস্থায় তারা নেই। হয়তো সময় নিয়ে ইরানের বিরুদ্ধে আঘাত হানার চেষ্টা করবে। কিন্তু এখনই বা তাৎক্ষণিকভাবে ইরানের বিরুদ্ধে তারা হামলা চালাতে পারেনি এবং তারা একাজে অক্ষম—এটা পরিষ্কার। এমনটা হলে মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র ও চালচিত্র বদলে যাবে, তাও নিশ্চিত।
ইসরায়েলে ইরান হামলা চালানোর পরপরই নেতানিয়াহু এবং তার যুদ্ধমন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট জোর গলায় ঘোষণা করেছিলেন, তারা ইরানের পরমাণু স্থাপনায় হামলা চালাবেন। একই সাথে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ সব তেল স্থাপনায় হামলা চালাবেন। সে সময় আমেরিকা ইসরায়েলকে ইরানের পরমাণু স্থাপনায় হামলা না চালানোর অনুরোধ করেছিল বা পরামর্শ দিয়েছিল। এর অর্থ হচ্ছে ইসরায়েল ইরানের ওপর হামলা চালাবে তাতে আমেরিকার সমর্থন আছে, কিন্তু ইসরায়েল ইরানের পরমাণু স্থাপনায় হামলা চালাতে পারবে না, এ বিষয়ে ওয়াশিংটনের রিজার্ভেশন আছে। আমেরিকা এরকম প্রকাশ্য সমর্থন এবং ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলকে হামলা চালানোর অনুমোদন দেওয়ার পরেও ইসরাইল হামলা চালায়নি বা চালাতে পারেনি। শোনা যাচ্ছে ইরানের হামলায় ইসরায়েলের অন্তত ২০টি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ধ্বংস হয়েছে। এ ছাড়া ইসরায়েলের নেভাটিম, নেটজারিম বিমান ঘাঁটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া মারাত্মক ধ্বংসলীলা দেখেছে তেলনফ সামরিক ঘাঁটি এবং মোসাদের সদর দপ্তর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসরায়েল এই হামলার ধকল কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
ইসরায়েল এখনো ইরানে হামলার বিষয়ে তর্জন গর্জনের ভেতরেই সীমাবদ্ধ আছে। তবে এরইমধ্যে ইরান আরও বেশ কিছু কাজ শেষ করেছে।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি ৪ অক্টোবর, অর্থাৎ ইসরায়েলে হামলার তিনদিন পর লেবানন সফর করেছেন। সেখানে লেবাননি কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনার পর তিনি সিরিয়া গেছেন। সেখান থেকে দেশে ফিরে আরাকচি নতুন করে মধ্যপ্রাচ্যের বিশেষ করে করে পারস্য উপসাগরীয় কয়েকটি দেশ সফরে বেরিয়েছেন। এই সফরের প্রথমেই তিনি গিয়েছেন সৌদি আরব। সেখানে তিনি সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল বিন ফারহানের সাথে বৈঠক করেছেন, বৈঠক করেছেন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথেও। এরপরে তিনি গেছেন কাতারে এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে। আমরা সবাই জানি সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার এবং সৌদি আরবে আমেরিকার সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। এর মধ্যে কাতারে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার সবচেয়ে বড় বিমানঘাঁটি অবস্থিত। এর পাশাপাশি সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে ইসরায়েলের সরাসরি কূটনৈতিক এবং সামরিক সম্পর্ক রয়েছে। বাহরাইনের সাথেও ইসরায়েলের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। এ অবস্থায় ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোতে সফরে গিয়ে যে মেসেজ দিয়েছেন তা একদম পরিষ্কার। তিনি এসব দেশকে নিকটতম প্রতিবেশী দেশ হিসেবে উল্লেখ করে তাদের সাথে মুসলিম ও প্রতিবেশীসুলভ ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা বলেছেন। তার আড়ালে নিশ্চয়ই আব্বাস আরাকচি সৌদি আরব, কাতার বা সংযুক্ত আরব আমিরাতকে এই মেসেজ দিতে ভুল করেননি যে, এইসব দেশ যদি তেহরানের বিরুদ্ধে হামলা চালানোর ক্ষেত্রে ইসরায়েল বা আমেরিকাকে কোনো রকমের সহযোগিতা করে তাহলে তারাও ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর যে মেসেজ আশা করা যায় তা সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন—সবার জন্য পরিষ্কার। ইরানের পশ্চিমে অবস্থিত ইরাক এবং কুয়েতের আকাশসীমা কিংবা সামরিক ঘাঁটি ব্যবহার করতে পারবে না ইসরায়েল। কারণ দেশ দুটির সাথে তাদের সম্পর্ক ভালো নয়। ওপাশে ওমানের সাথেও ইসরায়েলের সম্পর্ক ভালো না। ফলে তাদের আকাশসীমা কিংবা ঘাঁটি ইসরায়েল ব্যবহার করতে পারবে না। এছাড়া ওমানের পাশেই হচ্ছে ইয়েমেন। ইয়েমেনদের তীক্ষ্ণ নজরও থাকবে ওমানের ওপর।
সবকিছু মিলে এর আগে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর কাছ থেকে যেসব সুযোগ-সুবিধা আমেরিকা বা ইসরায়েল পেতে পারতো, এখন তা পাবে না।
এদিকে, নানা সূত্র থেকে নানা গুঞ্জন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আসছে। অনেক বিশ্লেষক বলছেন, ইরান পরমাণু বোমা কিংবা তার চেয়েও বেশি কিছু শক্তিশালী অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে। এই বিষয়ে আকার ইঙ্গিতে ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসির অ্যারো স্পেস ডিভিশনের প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমির আলী হাজিজাদেহ বলেছিলেন, ‘আমরা শিগগিরই টেবিলে এমন কিছু উপস্থাপন করব যা ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র ও পরমাণু প্রযুক্তির চেয়ে বেশি কিছু হবে।’
সম্ভবত সেই দিনই ইরানের সেমনান প্রদেশে অবস্থিত আমির-কাবির মরুভূমিতে সাড়ে চার মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। অথচ ওই মরুভূমিতে ভূমিকম্প হয় না। আবার ওইদিনই ইরানের সর্বোচ্চ নেতার পক্ষ থেকে জেনারেল আমির আলী হাজিজাদেকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ফাতাহ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
ইরান ইসরায়েলের ওপর হামলা চালিয়ে একেবারে পরিষ্কার যে বার্তা দিয়েছে তা হল—ইসরায়েল এবং মার্কিন প্রযুক্তি এখন আর ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র বা ড্রোন ঠেকাতে সক্ষম নয়। যার অর্থ দাঁড়াচ্ছে পুরো ইসরায়েল এখন ইরানের সামনে সম্পূর্ণভাবে অনিরাপদ। এতদিন ধরে ইসরায়েলের জনগণের যে নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা ছিল সেই নিরাপত্তা এখন তছনছ হয়ে গেছে। ইসরায়েল যদি বাড়াবাড়ি করে তাহলে তার জন্য আরো খারাপ পরিণতি অপেক্ষা করছে।
এই বার্তা ইসরায়েলে বসবাসকারী ইহুদিদের হৃদকম্পণ সৃষ্টি করবে। তারা ইসরায়েলে আর থাকতে চাইবে না, মোটামুটি এটা ধরে নেওয়া যায়। তারা এ কথা পরিষ্কার বুঝতে পারছে যে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র থেকে তারা এখন আর মোটেও নিরাপদ নয়। তারা এটাও বুঝতে পারছে, মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে আমেরিকার যতই সামরিক উপস্থিতি থাকুক, সেই সামরিক উপস্থিতি ইসরায়েলকে পূর্ণাঙ্গ নিরাপত্তা দিতে পারবে না। এছাড়া ইরানের সুস্পষ্ট পৃষ্ঠপোষকতায় যে হামাস ও হিজবুল্লাহ গড়ে উঠেছে কিংবা ইয়েমেন ও ইরাকে প্রতিরোধ সংগঠন গড়ে উঠেছে তাদের হাত থেকে ইসরায়েল এক মুহূর্তের জন্যও নিরাপদ নয়। এরা প্রতি মুহূর্তে ইসরায়েলকে অনিরাপদ এবং অস্থিতিশীল করে তুলতে সক্ষম।
এইসব আলোচনা থেকে এ কথা পরিষ্কার যে, ইসরায়েলের সরকার এবং জনগণের কাছে ইরান একেবারে ক্রিস্টাল ক্লিয়ার মেসেজ দিয়েছে্য। সেই মেসেজ হলো, ইসরায়েল বা আমেরিকা পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী হলেও ইরানের হাত থেকে তাদের নিস্তার নেই। এ মেসেজ সবার জন্য পরিষ্কার। এখন ইসরায়েল সরকার কী করবে সে সিদ্ধান্ত তাদের। তবে সেখানকার জনগণ নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নেবে, তারা ইসরায়েলে থাকবে, কী থাকবে না।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক