থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে সময়—ভেঙে চুরমার বিভাজনের বেড়াজাল।
এই শারদময় পুলকিত দিনে মুখোমুখি আজন্মকাল স্বপনে লালিত—মাস্টার পাড়া। পুরোনো দিনের সেই ছবিগুলো চোখের সামনে ভাসছে কেবল, ছবিগুলো দেখে চমকে গেলাম—‘রোদেলা দুপুরে মধ্য পুকুরে’ আমার ‘অবাধ সাঁতার’। উঠানে কাঠের পিঁড়িতে উবু হয়ে ঘোমটা মাথায় বসে বোধনের আয়োজনে ব্যস্ত কত মানুষ-কত আপনজন।
মাস্টার পাড়া—ভিটেমাটি, আম-জাম-কাঁঠাল ঘেরা স্বপ্নের শান্তিনীড়। শারদ মধ্যাহ্নের আলস্য ভরা পুকুরের আলসেমি ভেঙে রুই-কাতলার উল্লাসের কলরোল। দালানের কোণে অনাদরে বেড়ে ওঠা বাতাবি-লেবু গাছের কোঠরে দোয়েলের স্বপ্ননীড়। কবে যেন সেসব ভেঙে খানখান হয়ে গেছে! সেই মাস্টার পাড়া—এত মানুষের জন্মভূমি, এত মানুষের বাস্তুভিটে, এত মানুষের দামাল ছেলেবেলা, উদ্দাম কৈশোর, মন কেমন করা যৌবন, স্মৃতির জাবর কাটা বার্ধক্য, এত মানুষের আবেগ...সব স্মৃতিতে আগলে নিয়ে চলে গেছে!
মাস্টার পাড়া ছিল আমাদের হাওয়া বদলের আঁতুড়ঘর। আমাদের আক্ষেপ, দূষণের দাপটে সেই ‘খাঁটি’ জল আর নেই। বদলে গেছে সেই ‘বিশুদ্ধ’ বাতাস। উজার সেই খেঁজুর-নারিকেল-সুপারির মিতালি। আর বদলেছে হাওয়া বদলের মনটাও। এক সময় পূজার ছুটিতে যে মাস্টার পাড়া গমগম করত। এখন সেখানে প্রগতিমনস্ক মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এক সময় পূজা হতো হিন্দু-মুসলমান গলাগলি গাঁটছড়ায়। সময় আর নানা পরিস্থিতির বিভাজন আন্তরিক এ সম্প্রীতিতে অনেকটা ফিকে, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জৌলুস হারাচ্ছে সে বন্ধন। এ বন্ধন ছিঁড়ে গেছে অনেকটা।
আজও আম-কাঁঠাল বৃক্ষবনের গা বেয়ে বয়ে যাওয়া উতলা বাতাসের করুণ কাকুতি জাগায়, রোদেলা পুকুরের ছলছল চাহনি—মায়া ভরা নিদারুণ আকুতি। সব ফেলে স্মৃতিকে আঁচলে বেঁধে আমরা অনেকে আজ ‘ভিনদেশী’। স্মৃতির পিদিম সবসময়ই উসকে দেয় উৎসবে, পূজায়।
দুই।
আজো পূজার আয়োজন হয়—বোধনের ঢাক বাজে। এবং সেই পূজাকে ঘিরেই উতলে ওঠে স্মৃতি। এই তো সেদিনও আসতেন, পূজার ছুটিতে দেখা যেত কথাসাহিত্যিক-নাট্যকার প্রণব ভট্টকে। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে পূজার সমস্ত আয়োজন করতেন। অনেকে হয়তো এ মানুষটাকে ভুলে গেছে। এ প্রজন্মের অনেকের কাছে তিনি অচেনা। এরকম অনেকে আজ বিস্মৃতির গর্ভে হারিয়ে গেছেন। আমি তাদের স্মরণ করি—যারা আমাদের মাস্টার পাড়াকে একটি আদর্শ এবং অসাম্প্রদায়িক পাড়া গড়ে তুলতে তাদের অবদান রেখে গেছেন।
তিন।
কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানই শুধুমাত্র ধর্মকেন্দ্রিক নয়। বরং আচার-আয়োজনের ঊর্ধ্বে তা হয়ে দাঁড়ায় উদযাপন। বিশেষ উপলক্ষে উৎসবকে কেন্দ্র করে মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনক্ষেত্র তুলে ধরে আবহমান বাংলার সংস্কৃতি—বাংলার জীবনীশক্তি। দুর্গাপূজার নেপথ্যে থাকা আসল কারণ যাই হোক না কেন, তা কিন্তু বহমানতার প্রতীক। এটা বাঙালির ঐতিহ্য—যেকোনো ধর্মীয় উৎসবে ধর্মকে ছাপিয়ে মানুষের মিলন হয়ে ওঠে প্রধানতম উপজীব্য। এখানে মানুষে মানুষে মিশে গেছে প্রাণোচ্ছ্বল। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে উচ্চঅর্থে সীমাবদ্ধ হলেও ছড়িয়ে গেছে মনোন্তরে।
ধর্মীয় আয়োজন নিছক ধর্মে নির্দিষ্ট নয়। এর প্রকাশ আর ভঙ্গি বাঙালি হিন্দু-মুসলমানদের সমষ্টিগত উৎসবের আকৃতি। এ কথা সত্য বাঙালিরা প্রথম জীবন থেকে চিরায়তভাবে উৎসবে আচ্ছন্ন। পহেলা বৈশাখ-বাংলা নববর্ষ এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। ইতিহাস এও সাক্ষ্য দেয়, রমনা বটমূলে নৃশংস্য ঘটনার পরও সমস্ত ভয়-শঙ্কা ছাপিয়ে সকল ধর্মের মানুষ একত্রিত হয়। কোনো প্রতিকূলতা অথবা সীমাবদ্ধতাই উৎসব-আমেজে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারেনি। আমাদের এসব ধর্মীয় উৎসবগুলো নিজস্ব সম্প্রদায় থেকে উৎসারিত হলেও এর মধ্য দিয়ে আমাদের সামাজিক ঐক্যের বন্ধন দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করে চলে, নির্মাণ করে চলে পারস্পরিক সংহতি, সম্প্রীতির ঐক্য নির্মাণ করে চলে। পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার সুযোগ তৈরি করে এসব ধর্মীয় আচারে-ই। নিশ্চয়ই এ উপলব্ধি এভাবে আসে ধর্মীয় উৎসব ব্যক্তিচারণে যতটা না আনন্দের, তার চেয়ে সামাজিক বন্ধন প্রভাবিত করে চলে অনেক বেশি। এখানে কোনো ভেদাভেদ-বৈষম্য স্পর্শ করে না, ছুঁয়ে যায় না।
চার।
আমাদের বাসায় ভাড়া থাকতেন চন্দন নামে একজন ভদ্রলোক, সিলেট অঞ্চলের মানুষ তিনি। একটি ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করতেন, ‘মামা’ বলে ডাকতাম। তিনি আমাদের ভাই-বোনদের বিভিন্ন রকম বাজিপটকা এনে দিতেন। আর লক্ষ্মীপূজার সময় আমরা সেগুলো ফুটাতাম। পাড়া দাপিয়ে বেড়াতাম। মনে পড়ে দীনেশ স্যারের কথা। স্যার রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন, তার বাসায় যাওয়ার জন্য।
লক্ষ্মীপূজা অথবা সরস্বতী পূজায় নারিকেল, তিলের তৈরি সন্দেশের জন্য এ বাড়ি-ও বাড়ি ঘুর ঘুর করতাম। আর মণ্ডপগুলোর আশে-পাশেই থাকতাম। চেয়ে থাকতাম মুগ্ধ চোখে প্রতীমার রূপ, দুর্গা মায়ের ঐশ্বর্য। হিন্দুদের উপাসনালয় ছাড়াও সরস্বতী পূজা, দুর্গাপূজা উদযাপন হয় বিভিন্ন বাড়িতে, বিভিন্ন আঙ্গিনায়। সেখানে কীর্তন, শ্যামা গীতি গাওয়া হয়। বন্ধুরা মিলে ছুটে যেতাম, শুনতাম। প্রাণ ছুঁয়ে যেত। চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে পাড়ায় একটি বিশেষ দল আসতো প্রতিবেশীদের বাড়িতে। ছুটে যেতাম সেখানে। রঙ-বেরঙের পোশাকে তারা নাচ-গান-অভিনয়ের কসরত দেখাতো বিভিন্নভাবে। মনের ভেতর বাঙলা সংস্কৃতির শেকড়ের সঙ্গে সংহতি হতো। পূজার জন্য আমিও বন্ধুদের চাঁদা সংগ্রহে বেরিয়ে পড়তাম।
হিন্দু ধর্মের বন্ধুরা ঈদের সময় আমাদের উদ্যোগের সঙ্গে একাত্ম হতো। ঈদ উপলক্ষে আগের দিন (চাঁন) রাতে পাড়ায় কনসার্ট হতো। সেখানে তারা সহযোগিতা করতো। সার্বজনীন হয়ে উঠে এসব ঈদ, পূজা। এ ধারা চলে আসছে বহুদিন ধরে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভেতর-বাইরে পরিপক্বতা এসেছে, পরিবর্তন এসেছে। অনেক কিছুই এখন ম্লান হয়েছে, গৌরবের উজ্জ্বলতা হারিয়েছে। শুভেচ্ছা প্রকাশে নানান মাধ্যম যুক্ত হয়েছে। ভিজ্যুয়াল ভালো লাগা তৈরি হচ্ছে। এখানে আবেগ অশীতিপর হলেও, সমালোচনার খিলান খুললেও তারুণ্যের উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনায় নতুন আঙ্গিক মুদ্রিত হচ্ছে। অসাম্প্রদায়িক মৌলবোধের জায়গাটাও কতটা স্বচ্ছ হচ্ছে, তা নিয়ে হয়তো প্রশ্ন আছে।
পাঁচ।
১৯০৫ সালে বাংলা একবার বিভক্ত হয়েছিল। প্রদেশ হিসেবে বাংলা তখন অনেক বড়—বিহার, উড়িষ্যা ও ছোট নাগপুর তার সঙ্গে যুক্ত হয়। সেই প্রদেশকে ভেঙে দুটুকরো করা হলো। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিভাগকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করে গঠিত হলো পুর্ববঙ্গ ও আসাম। বাংলা ভাগ হওয়ার প্রতিবাদে রাখীবন্ধন করেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় ‘রাখীবন্ধনের দিন পরস্পরের হাতে হরিদ্রা বর্ণের সূত্র’ বাঁধার আহ্বান জানালেন। লিখলেন রাখি-সংগীত। এ উৎসবের মাধ্যমে হিন্দু-মুসলমানকে একসূত্রে গেঁথেছিলেন তিনি। প্রবল আন্দোলনের মুখে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলো। তবে বাংলা প্রদেশকে আর আগের রূপে পাওয়া যায়নি।
১৯৪৭ সালে বাংলা আবার ভাগ হয়েছে। দুটুকরো বাংলা সেবার রূপ নিয়েছিল পরস্পরের প্রতি ভীষণ রকমের বৈরিভাবাপন্ন দুটি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীনে। ৫ সালের দুই প্রদেশের মধ্যে যোগাযোগের কোনো বিচ্ছিন্নতা ঘটেনি। পাসপোর্ট, ভিসার কোনো প্রশ্নই ওঠেনি। কিন্তু ৪৭ সালের এপার বাংলা-ওপার বাংলার একেবারেই বিচ্ছিন্ন। নাগরিকত্বতো অবশ্যই, জাতীয়তাও আলাদা, এপার বাংলার মানুষেরা হয়ে গেছে পাকিস্তানি, ওপার বাংলার বাসীরা ভারতীয়, মাঝখানে বহমান হলো দ্বি-জাতি তত্ত্বের অদূরদর্শী গভীর ও প্রবল নদী। হিন্দু-মুসলমান ভাই-ভাই। এ ভ্রাতৃত্ববোধের অবিসংবাদিত সম্প্রীতি-সৌহাদ্য সম্পর্ককে ভেঙে দেওয়ার প্রয়াস তৈরি করার একটি চক্রান্ত ছিলো এ দ্বি-জাতি তত্ত্বে। অসাম্প্রদায়িক মূল্যচেতনায় চিড় ধরার এ প্রয়াস ছিল ইতিহাসে একটি বোকা ভুল। তবে, এ ভুলের জের এখনও দুই বাংলাকে টানতে হচ্ছে, যতদিন যাচ্ছে তত সম্পর্কের ভেতর ঘোর অন্ধকার আর অবিশ্বাস জাগছে।
লর্ড কার্জন একটি লেখায় লিখেছেন, ‘বাঙালিরা, নিজেদের যারা একটি জাতি বলে ভাবতে পছন্দ করে।’ কার্জনের এই লেখাটির সত্যতা চূড়ান্ত রূপ লাভ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে। কোনো বিশেষ মানুষ কিংবা জনগোষ্ঠীকে তাদের ধর্মবিশ্বাসের জন্য লাঞ্ছিত ও অবদমিত হয়ে থাকতে হবে না। ’৪৭ এর দেশভাগে বাংলা বিভাজন হলেও দুবাংলার প্রতি আমাদের গভীর ভালোবাসা, অনুভূতি বিচ্ছিন্ন হয়নি। আমি যখন পশ্চিমবঙ্গে যাই, তখন আমার কাছে মনে হয় না তারা আলাদা কেউ, স্বজনের কাছে থাকা আনন্দ অনুভব করি।
বাংলা ও বাঙালি জাতীয়তাবোধের অঙ্গীকার ছিল অসাম্প্রদায়িক সুস্থ জীবন, সংস্কৃতি ও শিল্পের প্রাণোচ্ছল স্বস্তির বিকাশ। আমাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল বাংলার নদী, বাংলার জল, বাংলার ফুল, বাংলার ফল, বাংলার শস্যক্ষেত্র হবে জীবনের জয়গান। কিন্তু মুক্ত অর্থনীতি আর আকাশ-সংস্কৃতির যুগে পাশ্চাত্য অনুকরণে বিবেকহীন ঘোর অন্ধকারে এ অঙ্গীকার ও আকাঙ্ক্ষা সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসনে আজ সংজ্ঞাহীন। আমাদের বসবাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সংরক্ষণ এবং বিকাশের প্রক্রিয়া বাধাগস্ত হচ্ছে কায়েমী স্বার্থান্বেষীদের হীন চক্রান্ত এখনও চলছে। দেশভাগের যে ক্ষত-যে যন্ত্রণা আমাদের বিঁধে, সে একই যন্ত্রণা আমরা ভোগ করছি এখনও।
ছয়।
হিন্দু বুঝি না-মুসলমান বুঝি না, আমরা বুঝি মানুষ। ‘সবার উপর মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই’—এ আপ্তবাক্যের ভেতর দিয়ে যেতে চাই আমরা সবাই। মানুষের পরিচয়-মানুষই সে! ধর্ম-বর্ণ দিয়ে মানুষ হয় না। মানুষ মানুষকে মহান করেছে। ধর্ম মানুষকে মহান করেনি; মানুষই ধর্মকে স্থান দিয়েছে সমাজের মাঝে।
আমাদের আটপৌরে জীবনে ধর্মের ভেদাভেদ আজও অনুপস্থিত। আবার বাস্তবতা হলো অসাম্প্রদায়িক শব্দটা অনেকটাই ম্রিয়মান। সেই আলোচনা অনেক দীর্ঘ। স্মৃতিকাতরতা আমাদের ব্যথিত করে—আচ্ছন্ন করে। বার বার মন উসকে দেয় পুরানো সেই দিনে ফিরে যেতে। সময় তো অনেকটা চলে গেছে। পুরানো সেই দিনে ফিরে যাওয়াও সম্ভব নয়, আবার বর্তমানকে উদযাপন না করেও সম্ভব নয়। এর মাঝখানে যে দোলাচল, সেটা বরং পাশ কাটানো উচিত, তাহলে সমস্ত অস্বস্তি কিংবা ম্রিয়মান অনেকটাই কেটে যাবে। যে বোধনের ডাক দিচ্ছে দেবী দুর্গা, সেটি বরং আত্মস্থ করা জরুরি। সমস্ত অসুর বিনাশে আমাদের শপথ নিতে হবে, ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
লেখক: কবি ও সংবাদিক