‘বাংলাদেশে ইসলামী উগ্রবাদীদের উত্থান হচ্ছে’- সম্প্রতি এমনই দাবি করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস। তবে দেশটির প্রভাবশালী গণমাধ্যমের এই প্রতিবেদনকে একপাক্ষিক বলে নাকচ করেছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার। একইসঙ্গে এটি দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার ঝুঁকি তৈরি করছে বলেও জানানো হয়েছে।
মঙ্গলবার (১ এপ্রিল) প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম অনলাইন সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া এক বিবৃতিতে এর প্রতিবাদ জানান।
শফিকুল আলম বলেন, “দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন বাংলাদেশ নিয়ে একটি উদ্বেগজনক ও একপাক্ষিক দৃষ্টিভঙ্গিকে তুলে ধরেছে। এই বর্ণনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক গতিশীলতাকে অতিসরলীকৃতভাবে দেখছে, এবং ১৮ কোটি মানুষের সমগ্র জাতিকে অন্যায়ভাবে কলঙ্কিত করার ঝুঁকি সৃষ্টি করছে।”
নিউ ইয়র্ক টাইমসের ‘বাংলাদেশ রিইনভেন্টস ইটসেলফ, ইসলামিস্ট হার্ড-লাইনার্স সি অ্যান ওপেনিং’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর— রাজনৈতিক শূন্যতার ফলে ধর্মীয় রক্ষণশীলতার দিকে একটি পরিবর্তন দেখা দিয়েছে।
সমালোচকদের উদ্ধৃত করে, প্রতিবেদনে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে নরম মনোভাবাপন্ন, গণতান্ত্রিক সংস্কারে অতিরিক্ত মনোযোগী, সংঘাত মোকাবিলায় দ্বিধাগ্রস্ত এবং স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির অভাবে ভুগছেন বলে অভিযুক্ত করা হয়েছে, যখন চরমপন্থীরা জনসমর্থন বৃদ্ধি করছে।
প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, বাংলাদেশ যখন তার গণতন্ত্র পুনর্গঠন ও ১৭৫ মিলিয়ন মানুষের জন্য নতুন ভবিষ্যৎ নির্ধারণের চেষ্টা করছে, তখন দীর্ঘদিন ধরে দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার আবরণের নিচে লুকিয়ে থাকা ইসলামপন্থী চরমপন্থার প্রবণতা দৃশ্যমান হয়ে উঠছে।
গত বছরের জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের পর থেকে ধর্মীয় উগ্রবাদীরা নারীর দেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা শুরু করে বলে প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বৈরাচারী নেতাকে উৎখাতের ফলে যে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হওয়ায়— ধর্মীয় কট্টরপন্থীরা একটি শহরে ঘোষণা দেয় যে, নারীরা আর ফুটবল খেলতে পারবে না। আরেক শহরে তারা মাথায় ওড়না না দেওয়ায় এক নারীকে উত্যক্তকারী ব্যক্তিকে ছেড়ে দিতে পুলিশকে বাধ্য করেছে। মুক্তির পর তার গলায় ফুলের মালাও পড়ায় তারা।
প্রতিবাদী বিবৃতিতে প্রেস সচিব বলেছেন, “এটি গুরুত্বপূর্ণ যে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অগ্রগতি এবং বাস্তব পরিস্থিতির জটিলতাকে স্বীকার করা হোক।”
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এরপর আরও দুঃসাহসী আহ্বান জানায় তারা। রাজধানী ঢাকায় এক সমাবেশে বিক্ষোভকারীরা হুঁশিয়ারি দেয় যে, যদি সরকার ইসলাম অবমাননাকারীদের মৃত্যুদণ্ড না দেয়, তাহলে তারা নিজেরাই শাস্তি কার্যকর করবে। কিছুদিন পর, নিষিদ্ধ ঘোষিত একটি সংগঠন– ইসলামি খেলাফতের দাবিতে বড় একটি মিছিল বের করে।
প্রতিবেদনের সমালোচনা করে শফিকুল আলম লিখেছেন, “এতে কিছু ধর্মীয় উত্তেজনার ঘটনা এবং রক্ষণশীল আন্দোলনের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু এর বিপরীতে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও সমাজের অগ্রগতির দিকটি উপেক্ষিত হয়েছে। বাংলাদেশ নারীদের উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে, এবং বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিশেষভাবে তাদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
নারী অধিকার ও সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া এই সরকারকে যে চিত্রে উপস্থাপন করা হয়েছে, তা বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না দাবি করে প্রেস সচিব বলেন, “যার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হলো ‘যুব উৎসব ২০২৫’। যেখানে দেশের প্রতিটি প্রান্ত থেকে প্রায় ২৭ লাখ মেয়ে অংশ নিয়েছে এবং ৩,০০০টি খেলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়েছে। এই বিশাল অংশগ্রহণ – যেখানে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, আদিবাসী তরুণী ও বিভিন্ন স্তরের নারীরা যুক্ত হয়েছে – বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের প্রাণবন্ততা প্রমাণ করে। একটি মাত্র ফুটবল খেলা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হওয়া মানে এই নয় যে, বাকি ২,৯৯৯টি সফল আয়োজনের মূল্য নেই। একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামগ্রিক অগ্রগতিকে খাটো করে দেখানো প্রকৃত সত্যকে আড়াল করে।”
তিনি বলেন, “আরেকটি ভুল তথ্য হলো, ‘প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস চরমপন্থী শক্তির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেননি’—এটি সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর এবং তার দীর্ঘদিনের নারী ক্ষমতায়নের কাজকে অস্বীকার করে। ইউনূস সবসময় নারীর ক্ষমতায়নের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। দুই কন্যারও পিতা ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক ও তার ক্যারিয়ার জুড়ে নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার জন্য কাজ করেছেন, যা তাকে নোবেল পুরস্কার এনে দিয়েছে। তিনি নারী অধিকারের প্রতি আজীবন অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন, এবং সেটিই তার কাজের মূল ভিত্তি।”
শফিকুল আলম বলেন, বাংলাদেশের মতো দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে ধর্মীয় সহিংসতাকে পৃথক করে চিহ্নিত করাটাও গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে ধর্মীয় সহিংসতা হিসেবে চিত্রিত করা বিভ্রান্তিকর। শেখ হাসিনার বিদায়ের পর যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, তা মূলত রাজনৈতিক এবং এর অনেকগুলো ঘটনাকে ধর্মীয় সংঘাত হিসেবে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়ই জনসমর্থন পেতে ধর্মকে ব্যবহার করে, যা সমস্যাটিকে আরও জটিল করে তোলে। ফলে পুরো বিষয়টিকে সাম্প্রদায়িক সংঘাত হিসেবে বর্ণনা করা বিভ্রান্তিকর, কারণ এখানে আর্থ-সামাজিক জটিল অনুঘটকগুলোকে অস্বীকার করা হয়।
প্রেস সচিব বলেন, “অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সুরক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং এই লক্ষ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও সন্ত্রাসবাদবিরোধী কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। বাংলাদেশ যে সামাজিক সংস্কার ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে চরমপন্থার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, তা ভুল তথ্য ছড়িয়ে ঢেকে ফেলা উচিত নয়।”