এত বিদ্যুৎকেন্দ্র, তবু কেন লোডশেডিং?

হাবীব ইমন প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১১, ২০২৪, ০৮:৩৫ এএম

সপ্তাহখানেক ধরে দেশে বিদ্যুৎ-সংকট চলছে। এর ফলে চরম ভোগান্তিতে পড়ছেন মানুষ। শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিং বেশি হচ্ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ নেই। 

সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণে লোডশেডিং বেড়েছে। গ্যাস সংকট ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য প্রায় ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম উৎপাদিত হচ্ছে।

বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো বলছে, চাহিদার অর্ধেক বিদ্যুৎও পাওয়া যাচ্ছে না, যার কারণে লোডশেডিং বেড়েছে। এতে মানুষ ভোগান্তিতে পড়ছে, ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্ষতি হচ্ছে এবং সেচ কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্র বলছে, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহের একটি টার্মিনাল (সামিটের মালিকানাধীন) তিন মাস ধরে বন্ধ। এতে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ছে না। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র  থেকে এক হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন কমেছে।

গত দেড় দশকে দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্র ২৭টি থেকে বেড়ে ১৫৩টি হয়েছে। বিচ্ছিন্ন চর, দুর্গম পাহাড়েও বিদ্যুৎ–সংযোগ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার শতভাগ বিদ্যুতায়নের অর্জন উদ্‌যাপন করেছে। আর এখন শহর-গ্রাম সবখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিংয়ে ভুগছে মানুষ। চাহিদার চেয়ে বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা থাকলেও জ্বালানিসংকটের কারণে তা কাজে লাগছে না।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, জ্বালানি নিশ্চিত না করেই বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হয়েছে।

এ দিকে, জ্বালানি সংকটের পাশাপাশি ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি কমেছে। ত্রিপুরা থেকে ঘণ্টায় ১৬০ মেগাওয়াটের পরিবর্তে ৬০ থেকে ৯০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে। ভারতের সরকারি-বেসরকারি খাত থেকে ভেড়ামারা দিয়ে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসার কথা থাকলেও মিলছে ৮৮০ মেগাওয়াট। আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেও ৪০০ মেগাওয়াট কম আসছে।

টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের কাছে ভারতের ৫ বিদ্যুৎ কোম্পানির প্রায় ১০০ কোটি ডলার পাওনা রয়েছে। এই বকেয়ার মধ্যে আদানি পাওয়ার পাবে প্রায় ৮০ কোটি ডলার। ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাহীরা বলেছেন, বকেয়া থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ চলছে। তবে তারা সতর্ক করে বলেছেন, এই অবস্থা অনির্দিষ্টকাল চলতে পারে না।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্র বলছে, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহের একটি টার্মিনাল (সামিটের মালিকানাধীন) তিন মাস ধরে বন্ধ। এতে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ছে না। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে এক হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন কমেছে। বিল বকেয়া থাকায় আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরবরাহ কমেছে ৫০০ মেগাওয়াট। বেসরকারি খাতের তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেও সর্বোচ্চ চাহিদায় উৎপাদন করা যাচ্ছে না। কারণ, তারাও অনেক টাকা পাবে। তাই ঘাটতি পূরণে লোডশেডিং করতে হচ্ছে।

দেশে দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়। কক্সবাজারের মহেশখালীতে দুটি ভাসমান টার্মিনালের মাধ্যমে এলএনজি থেকে আসে ১১০ কোটি ঘনফুট। সামিটের এলএনজি টার্মিনাল গত ২৭ মে থেকে বন্ধ। এতে এলএনজি সরবরাহ দাঁড়িয়েছে দৈনিক ৬০ কোটি ঘনফুট।

দিনে এখন গ্যাস সরবরাহ নেমে এসেছে ২৬০ কোটি ঘনফুটে। বিদ্যুৎ খাতে গ্যাস সরবরাহ কমে দাঁড়িয়েছে ৮২ কোটি ঘনফুট। আড়াই মাস আগেও গ্যাস থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হতো। এখন হচ্ছে ৫ হাজার মেগাওয়াট।

কক্সবাজারের মহেশখালীতে দুটি ভাসমান টার্মিনালের মাধ্যমে এলএনজি থেকে আসে ১১০ কোটি ঘনফুট। সামিটের এলএনজি টার্মিনাল গত ২৭ মে থেকে বন্ধ। এতে এলএনজি সরবরাহ দাঁড়িয়েছে দৈনিক ৬০ কোটি ঘনফুট।

কমেছে গ্যাস সরবরাহ 

বিল বকেয়া থাকায় আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরবরাহ কমেছে ৫০০ মেগাওয়াট। বেসরকারি খাতের তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেও সর্বোচ্চ চাহিদায় উৎপাদন করা যাচ্ছে না। কারণ, তারাও অনেক টাকা পাবে। তাই ঘাটতি পূরণে  লোডশেডিং করতে হচ্ছে। দেশে দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়। কক্সবাজারের মহেশখালীতে দুটি ভাসমান টার্মিনালের মাধ্যমে এলএনজি থেকে আসে ১১০ কোটি ঘনফুট। সামিটের এলএনজি টার্মিনাল গত ২৭ মে থেকে বন্ধ। এতে এলএনজি সরবরাহ দাঁড়িয়েছে দৈনিক ৬০ কোটি ঘনফুট। সার্বিকভাবে দিনে এখন গ্যাস সরবরাহ নেমে এসেছে ২৬০ কোটি ঘনফুটে। বিদ্যুৎ খাতে গ্যাস সরবরাহ কমে দাঁড়িয়েছে ৮২ কোটি ঘনফুট। আড়াই মাস আগেও গ্যাস থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হতো। এখন হচ্ছে ৫ হাজার মেগাওয়াট।

৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ কম জাতীয় গ্রিডে 

ঢাকা এবং বড় শহরগুলোতে লোডশেডিং তুলনামূলক কম হলেও গ্রামাঞ্চলে এবং ছোট শহরগুলোতে ব্যাপক লোডশেডিং হচ্ছে। বিদ্যুৎ না থাকায় গরমে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাচালক, রাইস মিলের শ্রমিকসহ বিভিন্ন খাতের ক্ষুদ্র আয়ের মানুষের আয় কমেছে। গবাদিপশুর খামারিরাও বড় ধরনের আর্থিক সংকটের আশঙ্কা করছেন  লোডশেডিংয়ের কারণে।

পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) সদস্য দেবাশীষ চক্রবর্তী (বিতরণ ও পরিচালন) জানান, চাহিদার তুলনায় প্রতিদিন গড়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ কম সরবরাহ পাওয়ায় তাদের বিতরণ এলাকায় লোডশেডিং বেড়েছে।

জ্বালানি নিশ্চিত না করেই একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। চাহিদাকেও বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। ফলে প্রতিবছর বড় সময় অলস বসিয়ে রাখতে হয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্র। দিতে হয়েছে অলস কেন্দ্রের ভাড়া। খরচের চাপ সামলাতে  ভোক্তা পর্যায়ে দাম বেড়েছে, সরকারের দায় বেড়েছে। অথচ তিন বছর ধরে গরম বাড়লেই লোডশেডিংয়ে ভুগতে হচ্ছে মানুষকে।

বেড়েছে ভারত-নির্ভরতা

দেশের বিদ্যুৎ চাহিদার এক-পঞ্চমাংশ ভারতের ওপর নির্ভরশীল। বিদ্যুৎ বিক্রি বাবদ বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) কাছে বিপুল পরিমাণ পাওনা বকেয়া পড়েছে ভারতীয়  কোম্পানি আদানি গ্রুপের। এ বিল পরিশোধে এরই মধ্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে সতর্কবার্তা দিয়েছে আদানি।

দেশের বিদ্যুৎ বিভাগের সবচেয়ে বড় সংকট হলো দেশের বিদ্যুৎ চাহিদার এক-পঞ্চমাংশ ভারতের ওপর নির্ভরশীল।

আদানি ছাড়াও ভারত থেকে দেশটির সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশে দ্বিপক্ষীয় বিদ্যুৎ বাণিজ্য চুক্তির আওতায় আনা হচ্ছে আরও ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। সেখানেও বকেয়া পড়ছে। এ বিপুল পরিমাণ বকেয়ার কারণে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি ও সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় বিঘ্ন এমনকি বন্ধ হয়ে পড়ারও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

যদিও বিপিডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, দেশটি থেকে সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে জরুরি ভিত্তিতে তাৎক্ষণিকভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলার মতো সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাংলাদেশে আছে। যদিও আশঙ্কা রয়েছে এগুলো চালানোর জন্য পর্যাপ্ত জ্বালানির সংস্থান করা নিয়ে। এ ধরনের সমস্যা  দেখা দিলে জ্বালানি সংকটের কারণে বিপিডিবি তা তাৎক্ষণিকভাবে মোকাবিলা করতে পারবে কি না  সে বিষয়ে বড় ধরনের সংশয় রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা গড়ে ১৪ হাজার মেগাওয়াটের আশপাশে। ভারতের সঙ্গে আমদানি চুক্তি রয়েছে ২ হাজার ৭৬০ মেগাওয়াটের (আদানি ও জিটুজি মিলিয়ে), যা চাহিদার ২০ শতাংশের কাছাকাছি। এর মধ্যে আদানি গ্রুপে ও ভারত সরকারের সঙ্গে জিটুজি চুক্তির আওতায় প্রতিবেশী  দেশটি মোট ২ হাজার ৭৬০ মেগাওয়াট আসার কথা। কিন্তু এরই মধ্যে আদানি গ্রুপের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ বিক্রি বাবদ কোম্পানিটির পাওনা  বেড়েই চলেছে। এ পরিস্থিতিকে ব্যবসা চালানোর জন্য ‘টেকসই নয়’ বলে মনে করছে আদানি গ্রুপ। বকেয়া বেড়ে যাওয়ায় বিপিডিবিকে জিটুজির আওতায় আনা বিদ্যুতের সরবরাহও কমিয়ে দিয়েছে  দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত  কোম্পানিগুলো। বকেয়া পরিশোধ নিয়ে সংকট আরও বাড়লে একপর্যায়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুতের সরবরাহ বন্ধও হয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।  

এ ধরনের পরিস্থিতিতে তাৎণিক সংকট মোকাবেলায় পর্যাপ্ত জ্বালানির সংস্থান রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল হাসিব চৌধুরী। তিনি বলেছেন, “আকস্মিকভাবে গ্রিড বিপর্যয় ঘটলে কিংবা গ্রিড  থেকে বড়  কোনো সক্ষমতা আউট হয়ে  গেলে তা মোকাবিলার জন্য  মোটা দাগে দুটি বিষয় প্রস্তুতি ও পর্যবেক্ষণ থাকতে হয়। এর একটি হলো  যে সক্ষমতার সরবরাহ গ্রিডে কমছে, তা পুষিয়ে নেয়ার জন্য অন্য বিদ্যুৎ  কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা।  সে প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ওই বিদ্যুৎ  কেন্দ্রের পর্যাপ্ত জ্বালানির সংস্থান রাখা। দ্বিতীয়ত, পাওয়ার প্লান্ট নির্দিষ্ট একটি সময়ে রক্ষণাবেক্ষণে নিতে হয়। ফলে গ্রিড ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সবসময়ই হিসাবটাও রাখতে হয়।”

চাপ ও চ্যালেঞ্জে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার 

অন্যদিকে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ বিপুল পরিমাণ বকেয়া অর্থ এখন অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে ভারতের ঝাড়খন্ডের ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট সক্ষমতা গড্ডা  কেন্দ্র  থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ শুধু আদানি গ্রুপের কাছে বাংলাদেশের বকেয়া বেড়ে ৫০০ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সংক্রান্ত মোট দায়ের পরিমাণ এখন ৩৭০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। এ বিষয়ে জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেছেন, আদানি বাংলাদেশের কাছে ৮০ কোটি ডলার পায়, তার মধ্যে ৪৯ কোটি ২০ লাখ ডলার পরিশোধ বিলম্বিত হয়েছে। আদানি পাওয়ারের বাইরে বাংলাদেশ জিটুজি চুক্তির আওতায় ভারত থেকে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট আমদানি চুক্তি রয়েছে। এই বিদ্যুৎ আমদানিতেও বিপুল পরিমাণ বকেয়া রয়েছে। এমনকি ত্রিপুরা দিয়ে আসা ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির বিল পরিশোধ করতে না পারায় এরই মধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে ত্রিপুরার বিদ্যুৎ সরবরাহকারী কোম্পানি ত্রিপুরা স্টেট ইলেকট্রিসিটি করপোরেশন লিমিটেড (টিএসইসিএল)।

ভারত থেকে আদানির মাধ্যমে আমদানি বিদ্যুতের বেশির ভাগ দেশের উত্তরাঞ্চলে সরবরাহ করা হচ্ছে। ওই অঞ্চলে এ মুহূর্তে বড় সক্ষমতার  তেমন  কোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্র নেই। ফলে কোনো কারণে আমদানি বিদ্যুতের সরবরাহ কমে গেলে সেখানে সরবরাহ করতে হবে জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ  কেন্দ্র চালিয়ে। কিন্তু এ জন্য পর্যাপ্ত জ্বালানির সংস্থান নেই বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বিপিডিবির এক কর্মকর্তা বলেছেন, ‘দেশে জ্বালানি সংকট থাকায় আমদানি বিদ্যুতে নির্ভরতা বেড়েছে। কারণ সেই আমদানির পরিমাণটাও কম নয়। তবে কোনো কারণে সংকট তৈরি হলে জ্বালানি সংকটের যে চিত্র তার তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা বা বিকল্প সরবরাহ সক্ষমতা এ মুহূর্তে তৈরি করা নেই।’

অন্যদিকে বিদ্যুতের লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ায় কলকারখানার উৎপাদনও চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। চাহিদার তুলনায় গ্যাস সরবরাহ অপ্রতুল হওয়ার কারণে এ সমস্যা হচ্ছে। শুধু ব্যবসার

ক্ষেত্রে নয়, অন্যান্য খাতেও গ্যাস সরবরাহে বিঘ্ন ঘটছে, বিশেষ করে সার ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে। রূপসায় ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি গ্যাসের জন্য চালু করা যাচ্ছে না।

উৎপাদন ৩ গুণ, কেন্দ্রভাড়া বেড়েছে ১৬ গুণ: ব্যাপক লোডশেডিং থেকে মুক্তি পেতে ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভাড়াভিত্তিক (রেন্টাল) বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ শুরু করে। এরপর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বেশি হারে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প নেওয়া শুরু হয়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন-২০১০ পাস করা হয়, যা দায়মুক্তি আইন নামে পরিচিত। এ আইনের অধীন দরপত্র ছাড়াই নির্মাণ করা হয় একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে প্রথমে বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীরা যুক্ত হলেও পরে আওয়ামী লীগের নেতারা নিতে থাকেন বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকানা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ভারত থেকেও বিদ্যুৎ আমদানি শুরু হয়।

গত দেড় দশকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা বেড়েছে পাঁচ গুণের বেশি, উৎপাদন বেড়েছে ৩ দশমিক ৬ গুণ। আর কেন্দ্রভাড়া বেড়েছে ১৬ গুণ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মূলত বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে এভাবে অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। এ সময় দেখা গেছে, ৫ হাজার থেকে বেড়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা হয়েছে প্রায় ২৮ হাজার মেগাওয়াট, যা চাহিদার প্রায় দ্বিগুণ। যদিও অর্ধেকের মতো সক্ষমতা অলস পড়ে থাকে। পরিশোধ করতে হচ্ছে সক্ষমতার ভাড়া, যা ক্যাপাসিটি চার্জ নামে পরিচিত।

বিদ্যুৎ খাতে উৎপাদনক্ষক্ষমতা, খরচ কেন বাড়ল ইত্যাদি নিয়ে গত ২৫ আগস্ট বিদ্যুৎ বিভাগে একটি ব্যাখ্যা তুলে ধরেছে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিদ্যুৎ খাতের দুজন ব্যবসায়ী বলেন, ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বাড়তে থাকে। এটি হয়েছে মূলত জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায়। বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয়ের ৬৫ শতাংশ হয় জ্বালানির দাম বাবদ। সেই জ্বালানির দাম বেড়েছে ১৬৩ শতাংশ। এটি না হলে বিদ্যুৎ খাতে কোনো ভর্তুকির প্রয়োজন হতো না। আর বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া নিয়েও কেউ প্রশ্ন তুলত না। যদিও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তিগুলোই হয়েছে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করে, যা সংকটে ফেলেছে মানুষকে। নতুন সরকার চুক্তিগুলো পর্যালোচনার উদ্যোগ নিয়েছে। এ জন্য হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরীকে কমিটির আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে ৫ সেপ্টেম্বর। দরপত্র ছাড়া গত সরকারের করা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের চুক্তিগুলো পর্যালোচনা করবে কমিটি। 

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, “জ্বালানি নিশ্চিত না করেই বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হয়েছে। সব বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি পর্যালোচনা করে কমিটি প্রতিবেদন দেবে। কোনো অনিয়ম পেলে কমিটি সুপারিশও করবে। একটু সময় লাগবে। তবে মেয়াদ শেষে কোনো কেন্দ্রের চুক্তি নবায়ন করা হচ্ছে না।”

তিনি বলেন, “যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র অধিকাংশ সময় অলস বসে থাকে, সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হবে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হবে না, এটা মাথায় রেখেই কাজ করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আমাদের দেশে যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো আছে, সেগুলো চালু করলেও স্বয়ং সম্পূর্নতা আসতে পারে। সেজন্য জ্বালানি আমদানি করে সব বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালালে বিদ্যুৎ স্বয়ংসম্পূর্নতা আসতে পারে সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ভাবতে হবে।”