পরীক্ষার্থীদের ভোগান্তি

‘বাসা থেকে বেরিয়ে দেখি রাস্তায় কোনো বাস নেই’

সুব্রত চন্দ প্রকাশিত: নভেম্বর ৫, ২০২১, ০৩:৫০ পিএম

ভর দুপুরে রাজধানীর ফার্মগেটে তপ্ত রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে ঘামছেন মরিয়ম বিপাসা। কপালে তার চিন্তার ভাঁজ। একটু পরপর বিআরটিসির বাস এলেই দৌড়ে যাচ্ছেন গেটের কাছে। কিন্তু আগে থেকেই বাসে বাঁদুড়ঝোলা যাত্রী থাকায় উঠতে পারছেন না। এদিকে ঘণ্টা দুই পরেই শুরু হবে সমন্বিত সাত ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষা। দুই বছর অপেক্ষার পর কাঙ্ক্ষিত এই পরীক্ষার সুযোগ এলেও এতে অংশ নিতে পারবেন কিনা তা নিয়ে সন্দিহান মরিয়ম।

শুধু মরিয়ম নয়, এভাবেই বিআরটিসির বাসে ওঠার ব্যর্থ চেষ্টা করছেন শতশত যাত্রী। তাদের কেউ চাকরির পরীক্ষার্থী, কেউ সাধারণ যাত্রী, কেউবা আবার কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থী। শুক্রবার (৫ নভেম্বর) সকাল থেকে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় এমন দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে তাদের।

বুধবার (৩ অক্টোবর) হঠাৎ করেই ডিজেল ও কেরোসিন তেলের দাম ১৫ টাকা বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। এতে ডিজেল ও কেরোসিন তেলের দাম ৬৫ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৮০ টাকা। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করা হলেও এর সঙ্গে সমন্বয় করা হয়নি ভাড়া। তাই জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে ও ভাড়া সমন্বয়ের দাবিতে বৃহস্পতিবার ধর্মঘটের ডাক দেয় বাস, ট্রাক, পিকআপ ও কাভার্ডভ্যান মালিক ও শ্রমিকদের সমিতি। শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে রাজধানীসহ সারাদেশে এই ধর্মঘট শুরু হয়।

এদিকে শুক্রবার ছিল সমন্বিত সাত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ ২৬টি সরকারি প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ পরীক্ষা। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক (সম্মান) শ্রেণির বাণিজ্য ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষাও অনুষ্ঠিত হয় এদিনে সকালে। কিন্তু গণপরিবহন বন্ধ থাকায় পরীক্ষার হলে পৌঁছাতে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয় চাকরি প্রত্যাশি ও ভর্তিচ্ছুদের।

বেসরকারি গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও রাস্তায় চলছে সরকারি বিআরটিসির বাস। কিন্তু সেটি যাত্রীর তুলনায় অপ্রতুল। সিএনজি অটোরিকসা ও রিকসা চলাচল করছে রাজধানীর রাস্তায়, তবে সুযোগ বুঝে তারা হাঁকাচ্ছেন কয়েকগুণ বেশি ভাড়া। এতে সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন বাস স্টপে বিপুল সংখ্যক যাত্রীকে নিরুপায় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে গেছে।

চাকরি প্রত্যাশী মরিয়ম বিপাসা বলেন, “সকালে একটি সরকারি চাকরির পরীক্ষা ছিল মোহাম্মদপুরে। কিন্তু মিরপুরে বাসা থেকে বেরিয়ে দেখি রাস্তায় কোনো বাস নেই। তাই কয়েকগুণ বেশি রিকসা ভাড়া দিয়ে ভেঙ্গে ভেঙ্গে পরীক্ষা দিতে গিয়েছি। বিকাল ৩টা আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষা আছে। সেটির সিট পড়েছে গোড়ানে। অনেক কষ্ট করে ফার্মগেট পর্যন্ত এসেছি। বাকিটা কিভাবে যাবো বুঝতে পারছি না। বিআরটিসিতে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও উঠতে পারিনি।”

মরিয়ম আরো বলেন, “দুই বছর পর সমন্বিত সাত ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষা হচ্ছে। আমি ঢাকায় থাকায় হয়তো কষ্ট করে যেতে পারছি। কিন্তু যারা ঢাকার বাইরে থাকে তারা কিভাবে আসবে। তারা তো পরীক্ষাও দিতে পারবে না। আজকে যেহেতু গণপরিবহন বন্ধ, সেহেতু চাকরির পরীক্ষাগুলো স্থগিত করা উচিত ছিল।”

ফার্মগেটে দাঁড়িয়ে থাকা আরেক চাকরি প্রত্যাশি রাজ আহমেদ বলেন, “আমার পরীক্ষা তিনটায়। সিট পড়েছে যাত্রাবাড়ী দানিয়া কলেজ। ফার্মগেট থেকে যে যাত্রাবাড়ি যাবো তেমন কোনো বাস নেই। শুধু বিআরটিসির বাস চলছে, তাও আবার গুলিস্তান পর্যন্ত। এখন বিআরটিসিতে করে গুলিস্তান গিয়ে সেখান থেকে আবার যাত্রাবাড়ী যাওয়া লাগবে। কিন্তু বিআরটিসিতেও যে ভিড় দীর্ঘক্ষণ চেষ্টা করেও উঠতে পারছি না। সিএনজি করে যে যাবো, সেই সুযোগও নেই। প্রচুর ভাড়া চাচ্ছে তারা। তাই বাধ্য হয়ে বিআরটিসির জন্য অপেক্ষা করছি।”

ক্ষোভ প্রকাশ করে রাজ আহমেদ বলেন, “এভাবে হঠাৎ করে গণপরিবহন চলাচল বন্ধ করা উচিত হয়নি। পরিবহন মালিকদের উচিত ছিল সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া।”

চাকরি প্রত্যাশি আবু হানিফ বলেন, “সকালে চাকরির পরীক্ষার জন্য বাসা থেকে বের হয়ে দেখি কোনো গণপরিবহন নেই। যেহেতু পরীক্ষা দিতেই হবে, তাই রিকসা, সিএনজি দেখেছি। কিন্তু তারা ১০০ টাকার ভাড়া ৪০০-৫০০ টাকা চাচ্ছে। অনেকটা নিরুপায় হয়েই বাড়তি ভাড়া দিয়ে পরীক্ষার হলে গিয়েছি। এটা আমাদের মতো সাধারণ যাত্রীদের জন্য চরম ভোগান্তি।”

স্বর্ণা নামের আরেক চাকরি প্রত্যাশি বলেন, “শ্যামলী থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত এলাম অনেক কষ্ট করে। বিআরটিসি ছাড়া আর কোনো বাস নেই। বিআরটিসিতেও যে পরিমাণ ভিড়, তাতে ছেলেরাই উঠতে পারছে না। আমার মেয়েদের উঠতে পারার তো প্রশ্নই আসে না। এখন এই পরিস্থিতিতে পরীক্ষা হলে সময়মতো পৌঁছাতে পারবো কি পারবো না সেটাই ভেবে কুল পাচ্ছি না।”

জান্নাত নামের আরেকজন বলেন, “এই ভোগান্তি শুধু আমার না, লাখ লাখ শিক্ষার্থীর। শুক্র-শনিবার চার-পাঁচটা নিয়োগ পরীক্ষার তারিখ দেওয়া। যখনই তেলের দাম বাড়ানো হয়, তখনই হয় শিক্ষার্থীরা অথবা পরিবহন শ্রমিকরা আন্দোলনে নামে। তাই সরকারের মাথায় রাখা উচিত ছিল এই সময় তেলের দাম বৃদ্ধি না করা। তাহলে হয়তো আমাদের এই ভোগান্তি হতো না।”

হঠাৎ করে বাড়ানো এই তেলের দাম নিয়ে অনেকেই সংবাদ প্রকাশকে বলেন, সরকার জ্বালানি তেলে সাত বছরে মুনাফা করেছে ৪০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু গত ৫ মাসে লোকসান হওয়ায় এখনই এমন হুট করে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো উচিত হয়নি।