আস্থা সংকটে পুঁজিবাজার, হারাচ্ছে বিদেশি বিনিয়োগকারী

মো. মির হোসেন সরকার প্রকাশিত: জুলাই ২, ২০২৪, ০৯:৫৩ পিএম
শেয়ারবাজারের লেনদেন পর্যবেক্ষণ। ছবি : সংগৃহীত

দীর্ঘদিন ধরে আস্থা সংকটে ভুগছে দেশের পুঁজিবাজার। আস্থা ফেরাতে বিভিন্ন সময় নানা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে সেসব পরিকল্পনার বিপরীতে শতভাগ সুবিধা করতে পারেননি তারা। ফলে দিন দিন পুঁজিবাজার থেকে দেশি বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি এবার বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।

সংশ্লিষ্ট তথ্যে জানা গেছে, জুন মাসের প্রথম ২০ দিনে বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসাব কমেছে ৫০০টিরও বেশি। আর চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে বিদেশিদের বিও হিসাব কমেছে ৮০০টিরও বেশি। অর্থাৎ চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসের চেয়ে জুন মাসেই বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব কমেছে।

বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসাব হলো, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য ব্রোকারেজ হাউস অথবা মার্চেন্ট ব্যাংকে একজন বিনিয়োগকারীর খোলা হিসাব। এই বিও হিসাবের মাধ্যমেই বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজারে লেনদেন করেন। বিও হিসাব ছাড়া শেয়ারবাজারে লেনদেন করা সম্ভব না। বিও হিসাবের তথ্য রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করে সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল)।

সিডিবিএলের তথ্যানুযায়ী, গত ২০ জুন শেষে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৮৮ হাজার ২৪৪টি। যা মে মাস শেষে ছিল ১৭ লাখ ৯১ হাজার ২২৮টি। এ হিসাবে জুন মাসের ২০ দিনে বিও হিসাব কমেছে ২ হাজার ৯৮৪টি। আর ২০২৩ সালের শেষ দিন ৩১ ডিসেম্বর শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব ছিল ১৭ লাখ ৭৩ হাজার ২০৪টি। এ হিসাবে চলতি বছরে বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাবে বেড়েছে ১৫ হাজার ৪০টি।

অপরদিকে, বর্তমানে বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব আছে ৫৪ হাজার ৫১১টি। মে মাস শেষে এই সংখ্যা ছিল ৫৫ হাজার ৪৫টি। অর্থাৎ চলতি মাসের ২০ দিনে বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব কমেছে ৫৩৪টি। আর গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর শেষে বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের নামে বিও হিসাব ছিল ৫৫ হাজার ৩৪৮টি। এ হিসাবে চলতি বছরে বিদেশি ও প্রবাসীদের বিও হিসাব কমেছে ৮৩৭টি।

এ বিষয়ে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও আইডিএলসি সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “ভালো প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করলে সাধারণত বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির শিকার হন না। যদিও বেশিরভাগ ভালো প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। তবে তারা ভবিষ্যতে আরও বেশি মুনাফা দিতে পারে। তাই বিনিয়োগকারীদের ধৈর্য্য ধরতে হবে।”

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুঁজিবাজারে বড় ধরনের ধস নামে প্রতি ১০ বছর পরপর। বর্তমানে পুঁজিবাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের তেমন আস্থা নেই বললেই চলে। আর যেসব সাধারণ বিনিয়োগকারী গত ৩০-৪০ বছর পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে আসছেন, তাদের অভিজ্ঞতা খুবই হতাশাজনক। তবে বড় জাল-জালিয়াতিকারীদের তাতে বেশি সুবিধা। পুঁজিবাজারের প্রতি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা দুঃসাধ্য ব্যাপার। পুঁজিবাজারে সরবরাহ ঘাটতি ও চাহিদা স্বল্পতা উভয়ই আছে। তবে ‘ভালো’ শেয়ার যেমন নেই, তেমনি ‘খারাপ’ শেয়ারে তুলনামূলকভাবে বাজার সয়লাব।

অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশে ডলার সংকট দীর্ঘদিনের। এ কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ারের লাভের অংশ নিতে পারছেন না। আবার ডলারের দামের অস্থিরতার ফলে লোকসানে পড়তে হয় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের। এমন পরিস্থিতির মধ্যে পুঁজিবাজারে বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগ ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। এসব কারণেই বিদেশি বিনিয়কারীদের মধ্যে চরম আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে।

তবে সম্প্রতি পুঁজিাবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ সংক্রান্ত একটি তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) পুঁজিবাজারে যে পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে, চলে গেছে তার চেয়ে বেশি। এই ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) পুঁজিবাজারে মোট যে বিনিয়োগ হয়েছে, তার চেয়ে ৮ কোটি ৯০ লাখ ডলার দেশে নিয়ে গেছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। তখনকার বাজারদরে (প্রতি ডলার ১১০ টাকা) যার পরিমাণ দাঁড়ায় ৯ শত ৭৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ, নিট এফডিআই দাঁড়িয়েছে ৮ কোটি ৯০ লাখ ডলার ঋণাত্মক।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “শেয়ারবাজারের ওপর বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আস্থা পাচ্ছেন না। যে কারণে তারা শেয়ার বিক্রি করে চলে যাচ্ছেন। ফ্লোর প্রাইসের কারণে বাজারের ওপর থেকে বিদেশিদের আস্থা নষ্ট হয়েছে। এখন আবার দাম কমার সীমা ৩ শতাংশ বেঁধে দেওয়া হয়েছে। বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করতে না পারলে কেন শেয়ারবাজারে আসবে।”

অধ্যাপক আবু আহমেদ আরও বলেন, “নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত সূচকের ওপর হস্তক্ষেপ না করা। বাজারকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে হবে। বাজারের পরিবেশ স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানো কঠিন হবে।”