ধনীদের সুবিধা রেখেই বাজেট পাস

মো. মির হোসেন সরকার প্রকাশিত: জুন ৩০, ২০২৪, ০৯:৫৫ পিএম
জাতীয় বাজেট। ছবি : সংবাদ প্রকাশ গ্রাফিক্স

বড় কোনো পরিবর্তন ছাড়াই জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট। বিশেষ করে ধনীদের দেওয়া সুবিধা অক্ষুণ্ণ রেখেই রোববার (৩০ জুন) পাস করা হয়েছে বাজেট। যদিও গত ৬ জুন প্রস্তাবের পর থেকেই এবারের বাজেট নিয়ে নানা মহলে বিস্তর আলোচনা হয়েছে।

সংকটময় অর্থনীতির মধ্যে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট অনেকটা বিলাসী বলেই মত দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। তারপরও সংকট উত্তরণে বাজেটে বড় পরিবর্তনের আশা করা হলেও সেটাও পূরণ হয়নি বলে মনে করছেন তারা।

বাজেটে এবার অর্থনীতিবিদদের আলোচনায় ছিল অতি ধনীদের করহার নিয়ে। বিগত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে অতি ধনীদের করহার ছিল ২৫ শতাংশ। তবে চলতি অর্থবছরে তা ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৩০ শতাংশের প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী।

তবে শেষ পর্যন্ত সেই প্রস্তাব প্রত্যাহার করা হয়েছে। যা যৌক্তিক নয় বলে মনে করা হচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ধনীদের করহার কমানোর ফলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) লক্ষমাত্রা অর্জন নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই যাবে।

সূত্রমতে, বিগত ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে ব্যক্তিশ্রেণির সর্বোচ্চ করহার ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছিল। এরপর থেকে তিনবছর এ করহার অব্যাহত ছিল। এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে করহার বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।

বার্ষিক ৩৮ লাখ ৫০ হাজার টাকার বেশি আয় থাকলে এ হার প্রযোজ্য। তবে প্রভাবশালীদের চাপে সেই অবস্থান থেকে সরে আসে এনবিআর। এক্ষেত্রে সংস্থাটির যুক্তি হলো- ‘করভার লাঘবে’ এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে সরকারের এমন সিদ্ধান্তে রাজস্ব আদায়ে প্রভাব পড়বে বলে মতামত দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।

এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. মো. আইনুল ইসলাম সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “গত ৬ জুনের প্রস্তাবিত বাজেট সংসদে পাস হয়েছে। আশা করেছিলাম অতি ধনীদের করহার ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হবে। তবে ৫ শতাংশ বাতিল করে শেষ অবধি ২৫ শতাংশই রাখা হয়েছে।”

ড. মো. আইনুল ইসলাম বলেন, “এমন সিদ্ধান্তে করহার কমিয়ে কীভাবে রাজস্বের লক্ষমাত্রা পূরণ হবে সেটা এখন ভাবনার বিষয়। এছাড়াও কালো টাকা সাদা করার প্রস্তাব করেছিলাম। সেটা নিয়ে সংসদে ভালোই আলোচনা হয়েছে।”

অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক আরও বলেন, “২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। সুতারাং এখন দেখার বিষয় শেষ অর্থবছরে বাস্তবায়নের হার কতটুকু থাকে। কারণ, চলে যাওয়া যে বছরটা আছে সেখানে বাজেটের বাস্তবায়নের যে হার তা সন্তোষজনক নয়।”

তবে শুধু অতি ধনীদের করহারেই পরিবর্তন আসেনি। বরং ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সংসদ সদস্যদের গাড়ি আমদানির ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ শুল্কমুক্ত সুবিধা বাতিল করে তার পরিবর্তে শুল্ক বসানোর ঘোষণা করেছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। তবে শেষ পর্যন্ত চাপের মুখে সেই অবস্থান থেকেও সরে এলেন মন্ত্রী।

অর্থাৎ এমপিরা আগের মতোই গাড়ি আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবেন। এ ছাড়া সম্পদশালীদের কোম্পানির কাজে ব্যবহৃত গাড়ির পরিবেশ সারচার্জও মওকুফ করা হয়েছে। ড. আইনুল ইসলাম বলেন, “আমরা বলেছিলাম সংসদ সদস্যদের গাড়ির শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রত্যাহার করতে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো সেটি আবারও রয়ে গেলো।”

এদিকে, অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাইটেক পার্কে মূলধনী যন্ত্র আমদানি শুল্কমুক্তই থাকছে। অর্থমন্ত্রী মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে ১ শতাংশ শুল্কারোপের প্রস্তাব করেছিলেন অর্থমন্ত্রী। পরে ব্যবসায়ীরা তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। তারা বলছিলেন, কর অবকাশ সুবিধার কথা জেনেই অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ এসেছে। এই ১ শতাংশ শুল্কারোপ সেই বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।

বিরোধী দলগুলোও এই শুল্ক প্রস্তাবের সমালোচনা করে আসছিল। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের দাবির মুখে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে মূলধনি যন্ত্রপাতির ওপর ১ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপের প্রস্তাব থেকে সরে এসেছে সরকার।

অন্যদিকে, রপ্তানি ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর চেষ্টার অংশ হিসেবে সরকার দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে, যেগুলোয় বিনিয়োগে কর অবকাশ সুবিধার কথা জানিয়েছিল সরকার। এদিকে গত ২৯ মে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এনবিআর বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগকারীদের কর অবকাশসহ ৮টি কর সুবিধা প্রত্যাহার করে নেয়। ১০ বছর মেয়াদি কর অবকাশ সুবিধা তুলে নেওয়ার ফলে শিল্পভেদে কোম্পানিগুলোর আয়ের ওপর করহার ২০-২৭.৫ শতাংশ বা এরও বেশি প্রযোজ্য হওয়ার কথা।

তবে দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের চাপে বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলের কর অবকাশ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে সরকার। অর্থাৎ বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগকারীরা আগের মতোই কর অবকাশ সুবিধা পাবেন।