হারুন শেখ। বয়স আনুমানিক ২৩। বাবার অর্থসম্পদ ভালো হওয়ার সুবাদে কিনেছেন ছয় চাকার মিনি ট্রাক। এছাড়াও আছে এপাচি আরটিআর ১৫০ সিসি মোটরসাইকেল। সারাদিন মিনি ট্রাক চালান আর সন্ধ্যা হলেই কয়েকজন মিলে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা সদরে বসে পড়েন জুয়ার আসরে। লোভের ফাঁদে পড়ে ওয়ানএক্স বেট খেলে এ পর্যন্ত ৮-৯ লাখ টাকা খুইয়েছেন হারুন। কোনো কোনো দিন কিছু টাকা উপার্জন করতে তার চেয়ে বেশি হাতছাড়া হয়ে যায়।
সংবাদ প্রকাশকে হারুন শেখ বলেন, “এক আত্মীয়ের মাধ্যমে জুয়ার অ্যাকাউন্ট খুলে রেখেছিলাম। আগে এত লোভ ছিল না। শুরুর দিকে নিয়মিত খেলা না হলেও এখন প্রতিদিন খেলতে হচ্ছে। এক হাজার টাকা অ্যাকাউন্টে নিলে ক্রিকেট, ফুটবল, লুডু, ক্যান্ডিক্রাশসহ বিভিন্ন খেলা থেকে বেশি টাকা আসে।
হারুন শেখ আরও বলেন, আবার লোভে একবার পড়ে গেলে দুই-তিন ঘণ্টা খেলে দেখা যায়, লাভের পুরোটাসহ এক হাজার টাকার অর্ধেক নেই। এখন জুয়ার প্রতি লোভ এতটাই বেড়েছে যে, চাইলেও ছাড়তে পারছি না। নেশার মতো হয়ে গেছে। খেলতে না পারলে শান্তি মেলে না। এখানে টাকা যাবে আসবে এটাই নিয়ম।”
উপজেলা সদরের এশারত নামের আরেকজন বলেন, “এ খেলায় প্রথমে লোভে পড়ে কিছু টাকা ইনকাম করা যায়। তবে পরবর্তীতে বেশিক্ষণ এ খেলা খেলতে থাকলে লাভের কিছু থাকে না। নিজের কষ্টার্জিত টাকা জুয়া খেলে হেরে খুব খারাপ লাগে। খেলতে গিয়ে মাথায় থাকে না যে, টাকা হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। লোভের ফাঁদে কখন যে সময় চলে যায় বোঝা যায় না।”
ফরহাদ নামের আরেকজন বলেন, “এ খেলায় লাভ বলতে কিছু নেই। অ্যাকাউন্টে টাকা নিয়ে আধা ঘণ্টা খেললে কিছু টাকা হাতে আসে। তখনই যদি খেলা বাদ দেওয়া যায়, তাহলেই লাভ। তা না হলে ভর করে শনির দশা। যারা এজেন্ট তারা প্রতিদিন শত শত কোটি টাকা আয় করছেন শুধু আমাদের টাকায়। কেউ গাড়ি কিনেছে, কেউবা পাঁচতলা ভবন করেছেন। তবে তাদের পুলিশে ধরে না।”
শুধু যে হারুন শেখ একাই আসক্ত, তা নয়। উপজেলার প্রায় সব ইউনিয়নেই জুয়ায় জড়িয়ে পড়েছেন তার মতো শত শত তরুণ আর যুবক। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও জুয়ায় বাজি ধরে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন তারা। তবে জুয়া খেলে সব হারালেও লোকলজ্জা আর আইনের ভয়ে নীরব থাকছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্মার্টফোনের মাধ্যমে মোস্টবেট, ওয়ান এক্স বেট, বেট উইনার, বেট৩৬৫, মেলবেট, লাইনবেট, জিটুইন, ক্রিকেক্স, প্যারিম্যাচ, এমসিডব্লিউসহ বিভিন্ন অ্যাপ ডাউনলোড করে অনলাইনে খেলা হচ্ছে জুয়া। ১০ টাকা থেকে শুরু করে যে কোনো পরিমাণ অর্থ দিয়ে খেলা যায়। এগুলো পরিচালনা করা হচ্ছে রাশিয়া, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে।
এসব জুয়ার অ্যাকাউন্টে টাকা জমা হলে নির্দিষ্ট এজেন্ট দিয়ে টাকা উঠানো হয়। আর এসব টাকা উঠানো হয় ডিজিটাল মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। যেমন, বিকাশ, নগদ, রকেটের মাধ্যমে। তবে এসব অ্যাকাউন্টের এজেন্টকে বা কারা সেসব বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ ভুক্তভোগীরা।
এ বিষয়ে গোবিন্দগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শামছুল আলম শাহ সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “অনলাইন জুয়া বন্ধে আমরা নিয়মিত কাজ করছি। এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। তবে সচেতনতামূলক কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছি।”
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে জুয়া খেলা অবৈধ। তবে জুয়া প্রতিরোধে দেশে যে আইনটি রয়েছে, সেটি ১৮৬৭ সালে অর্থাৎ ব্রিটিশ আমলে প্রণীত। ১৫৫ বছরের পুরোনো এ আইন সংশোধন করে নতুন ‘জুয়া আইন, ২০২৩’ এর খসড়া করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। নতুন আইনে অনলাইন জুয়া অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।
খসড়া আইনে জুয়ার শাস্তি সর্বোচ্চ ৩ বছরের কারাদণ্ড বা ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড। আগের আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল ৫০০ টাকা জরিমানা ও তিন মাসের জেল। তবে সরকার চাইলে পর্যটন বা বিশেষায়িত এলাকা, কোনো হোটেল বা ক্লাবকে এ আইনের আওতামুক্ত রাখতে পারবে বলেও খসড়ায় জানানো হয়েছে।
খসড়া আইন অনুযায়ী, ‘জুয়া খেলা’ বলতে বোঝাবে সরকার বা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমোদন ছাড়া সব ধরনের বাজি ধরা, অর্থ কিংবা পণ্যের বিনিময়ে প্রতিযোগিতামূলক সব ধরনের হাউজি, সব ধরনের লটারি, অর্থ বা আর্থিক মূল্যমানের কোনো পণ্যের বিনিময়ে ভাগ্য ও দক্ষতার সংমিশ্রণে কোনো আর্থিক ঝুঁকিপূর্ণ খেলা।
খসড়া আইনে বলা হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা অন্য কোনো অনলাইন বা ইলেক্ট্রনিক বা ডিজিটাল মাধ্যমে খেলাধুলা বা এ সংক্রান্ত অন্য কোনো বিষয়ে বাজি ধরলে বা বাজি ধরার জন্য নগদ বা ক্যাশবিহীন ব্যাংকিং লেনদেন বা মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেন বা বিট কয়েনসহ অন্য যেকোনো ক্রিপ্টোকারেন্সি ইত্যাদি বা অন্য কোনো ধরনের ইলেক্ট্রনিক বা ডিজিটাল মাধ্যমে লেনদেন করলে তা অনলাইন বেটিং বা জুয়া হবে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনলাইন জুয়ায় সমাজের বিত্তশালী পরিবারের সন্তানদের আনাগোনা অনেক বেশি। পাশাপাশি জুয়া খেলার অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়ে অনেকে বিভিন্ন অপরাধ করছে। অনলাইন জুয়ায় অংশ নিয়ে তরুণদের যে নৈতিকতা বা তার ব্যক্তিত্বের সুদৃঢ় অবস্থান তৈরি হওয়ার কথা সেটিও হচ্ছে না। অনলাইন জুয়ায় জড়িয়ে অনেকে অপরাধ করছেন।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “আমাদের ভার্চুয়াল জগতকে পুঁজি করে নানা ধরনের অপরাধ হচ্ছে তার মধ্যে অনলাইন জুয়া অন্যতম। অনলাইন জুয়া নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সরকারের আইন বলুন অথবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু তৎপরতা রয়েছে। কিন্তু এটা নিয়ন্ত্রণ করাটা অনেকটা কঠিন।”
কারণ বিশ্লেষণ করে অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, জুয়া বন্ধে প্রতিরোধের ব্যবস্থা যতদিন অনলাইনভিত্তিক না হবে ততদিন এটা নিয়ন্ত্রণ করাটা খুবই কষ্টকর। অনলাইনভিত্তিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করার পাশাপাশি যারা এসব জুয়ার সাইট পরিচালনা করেন তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে কখনও কখনও বেগ পেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।”
ড. তৌহিদুল হক আরও বলেন, “জুয়া বন্ধে আমরা এখন পর্যন্ত একটা পরিপূর্ণ আইন তৈরি করতে পারিনি। এখন সময়ের প্রেক্ষাপটে অপরাধের ধরণ পাল্টে গেছে। অনেক অপরাধ আছে যেগুলো এই ভার্চুয়াল প্লাটফর্ম বা অনলাইন জগতকে কেন্দ্র করে হচ্ছে। এসব অপরাধ ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের ওপর প্রভাব ফেলছে।”