মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা ‘কঠিন’

মো. মির হোসেন সরকার প্রকাশিত: জুন ৪, ২০২৪, ০৯:৫২ পিএম
মুদি দোকান। ছবি : সংগৃহীত

২০২৩ সালের ৭ নভেম্বর ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছিলেন, “ডিসেম্বরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশ ও জুনের মধ্যে তা ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে।” কিন্তু গত বছরের ডিসেম্বর অতিবাহিত হয়ে চলতি বছরের জুন মাস চলে এসেছে। তবে তার (আব্দুর রউফ তালুকদার) কথার সঙ্গে বর্তমান মূল্যস্ফীতির তথ্যে কোনো মিল নেই। বরং জুনে ৬ দশমিক ৫ শতাংশে মূল্যস্ফীতি নামিয়ে আনার কথা বলা হলেও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, মে মাসে দেশের সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি কমার বিপরীতে ৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ বেড়েছে। যা অস্বাভাবিক বলে দাবি অর্থনীতিবিদদের।

তারা বলছেন, এটা একটা ‘মনিটরি ফিনোমিনা’। অর্থাৎ, টাকা যদি বেশি ছাপা হয়, তাহলে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। কম হলে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। আর মনিটরি সাইটকে বাদ দিয়ে মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব নয়। এতদিন পর্যন্ত এ কারণেই মূল্যস্ফীতির হার নিচে নামিয়ে আনা যায়নি। এছাড়াও অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থার সঙ্গে উৎপাদনের তথ্যের গড়মিলকেও মূল্যস্ফীতি বাড়ার কারণ হিসেবে দেখছেন তারা।

এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “আমাদের বাজার ব্যবস্থাপনায় বড় দুর্বলতা রয়েছে। সরবরাহে ঘাটতি রয়েছে, সে কারণে দাম বাড়ছে। কাজেই সরবরাহ বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে হয় আমদানি বাড়াতে হবে, না হয় উৎপাদন বাড়াতে হবে। আর যে ‘প্রোডাকশন স্ট্যাটিসটিকস’ আছে, হয়তো সেখানে ভুল আছে, সে ভুলটা বাজারে রিফ্লেকটেড (প্রতিফলিত) হচ্ছে না। তবে রাজনৈতিক সদিচ্ছায় এ পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন সম্ভব।”

ড. আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, “আমাদের আশপাশের দেশগুলো হোক বা উন্নত দেশ, সবখানেই মূল্যস্ফীতি কমেছে। আন্তর্জাতিক বাজারেও পণ্যমূল্যের দাম কমেছে। চাপ কমানোর জন্য যেগুলো করণীয় ছিল এবং আমরা যেগুলো করণীয় বিষয়ের কথা বলেছিলাম, সেগুলো বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি।”

গত কয়েক বছর ধরেই দ্রব্যমূল্যের বাজার সিন্ডিকেটের দখলে। অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণে বাজারে পণ্যমূল্য অতিরিক্ত দামে বিক্রি হচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে সাধারণ মানুষের ওপর। ফলে চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে দুশ্চিন্তার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার বিভিন্ন সময় নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। তবে সেসব পদক্ষেপের বিপরীতে শতভাগ আশা পূরণ হয়নি। মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলা হলেও সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার দুই অঙ্কের ঘর ছুঁই ছুঁই করছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক প্রতিবেদন বলছে, গত এপ্রিল মাসে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। তবে বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে আবারও মে মাসে বেড়েছে খাদ্য ও সার্বিক মূল্যস্ফীতি। গত মে মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশে। যা গত এপ্রিলে ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, চলতি বছরের (এপ্রিল- মে) এক মাসের ব্যবধানে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়েছে শূন্য দশমিক ১৫ শতাংশ। মে মাসে খাদ্য খাতে সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ, যা এপ্রিলে ছিল ১০ দশমিক ২২ শতাংশ। মে মাসে খাদ্য বহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ১৯ শতাংশ, যা এপ্রিলে ছিল ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ।

এদিকে মে মাসে শহর ও গ্রামে সমানতালে বেড়েছে খাদ্য মূল্যস্ফীতি। মে মাসে গ্রামাঞ্চলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ, যা এপ্রিলে ছিল ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলে মে মাসে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৭৩ শতাংশ, যা এপ্রিলে ছিল ১০ দশমিক ২৫ শতাংশ। এ ছাড়াও খাদ্য বহির্ভূত খাতে মে মাসে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ, যা এপ্রিলে ছিল ৯ দশমিক ৬০ শতাংশ। মে মাসে শহরাঞ্চলে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ, যা এপ্রিলে ছিল ৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ। খাদ্য খাতে শহরাঞ্চলে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক ৮৬ শতাংশ, যা এপ্রিলে ছিল ১০ দশমিক ১৯ শতাংশ। এছাড়া খাদ্য বহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ০৩ শতাংশ, যা এপ্রিলে ছিল ৯ দশমিক ০১ শতাংশ।

মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় স্বস্তিতে নেই সাধারণ মানুষ। বাজার ব্যবস্থা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে না আসায় পরিবার নিয়ে কঠিন সময় পার করছেন তারা। ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সোবহান মোল্লা সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “যেভাবে নিত্যদিনের ব্যয় বাড়ছে, সেভাবে আয় বাড়ছে না। ব্যাটে বলে না মেলায় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আমরা যতই বলি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য কাজ করা হচ্ছে। কিন্তু কেন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না, সেটার হিসেব আমরা করি না। এখানে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব থাকতে পারে। হয়তো সরকার চায় না অথবা সরকারের মন্ত্রীসভা চায় না মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসুক। কারণ এখানে ব্যবসায়ীদের অনেক সার্থকতা আছে।”

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের আশপাশের দেশগুলো হোক বা উন্নত দেশ, সবখানেই মূল্যস্ফীতি কমেছে। আন্তর্জাতিক বাজারেও পণ্যমূল্যের দাম কমেছে। কারণ জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় আয় বেশি বাড়লে মানুষের তেমন সমস্যা হয় না। কিন্তু আয় না বাড়লে নানা সমস্যা তৈরি হয়। চাপ কমানোর জন্য যেগুলো করণীয় ছিল এবং সেগুলো করণীয় বিষয়ের বলা হয়ে। তবে সেগুলো বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা। যেহেতু সরকার বাজেটের আকার বড় করছে, সেখানে অর্থ জোগান কোথায় থেকে দেবে। এটাও সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ। মূল্যস্ফীতি কমার কোনো সম্ভাবনা আমি দেখি না।”

আবু আহমেদ আরও বলেন, “এখন বিদেশ থেকে অর্থ চাইলে তো বাংলাদেশ পাবে না। কারণ, যখন বাংলাদেশের অর্থনীতি দুর্বল হতে থাকবে, তখন বিদেশিরা আর ঋণ দেবে না। এটাই সত্য। সুতরাং বাইরে থেকে অর্থপ্রাপ্তি আগের থেকে বেশি হবে বলে আমার মনে হয় না।”