সারা বছর যেমনই যাক, বছর ঘুরে বাজেট ঘোষণার আগে দেশের অর্থনীতি নিয়ে সবার টনক নড়ে। আলোচনা-সমালোচনার পাশাপাশি বাজেট নিয়ে প্রশ্নের যেন শেষ থাকে না। বাজেটের আকার বাড়বে না কমবে, কোন খাতে কেমন বাজেট ধরা হবে, ব্যবসায়ী নাকি সাধারণ লোকদের সুবিধা বাড়বেসহ ইত্যাদি প্রশ্ন অলিগলিতে আলোচনা হয়ে থাকে।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে আলোচনা হয় তা হলো, কোন কোন পণ্যের দাম কমছে বা বাড়ছে। এই আলোচনার (সাধারণ জনগণের আলোচনা) পরিপ্রেক্ষিতেই দ্রব্য মজুত বা বিক্রিও করে দেন অনেকে। তবে বিগত বছরের বাজার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাজেটে যেসব পণ্য বা সেবার দাম কমানো হবে বা শুল্কে ছাড় দেওয়া হবে বলে জানানো হয়, বাজারে ওই সব পণ্য বা সেবার দাম খুব একটা কমতে দেখা যায় না।
আগের অর্থবছরের বাজেটের দিকে তাকালে দেখা যায়, কিছু পণ্য বা সেবার দাম কমার কথা বলা হয়েছিল। এসব পণ্যের মধ্যে ছিল, হাতে তৈরি বিস্কুট-কেক, মিষ্টিজাতীয় পণ্য, ম্যালেরিয়া ও যক্ষ্মার ওষুধ, পশুখাদ্য, অপটিক্যাল ফাইবার, উড়োজাহাজ ইজারা, কনটেইনার, ব্লেন্ডার, জুসার, প্রেশার কুকারের মতো গৃহস্থালি সরঞ্জাম। সেসব সেবা বা পণ্য উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল।
একইভাবে ওয়াশিং মেশিন এবং মাইক্রোওয়েভ ও ইলেকট্রিক ওভেন উৎপাদনকারী কারখানা, তথ্যপ্রযুক্তি ও কম্পিউটার পণ্য উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি, রেফ্রিজারেটর ও ফ্রিজার উৎপাদনে এখনকার ৫ শতাংশের অধিক ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধার মেয়াদ এক বছর বৃদ্ধি, স্যানিটারি ন্যাপকিন ও ডায়াপারের কাঁচামাল আমদানিতেও ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধার সময় এক বছর বৃদ্ধি, সাবান ও শ্যাম্পুর দুটি কাঁচামালে ৫ শতাংশের অতিরিক্ত ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা এক বছর বহাল রাখাসহ আরও কিছু সুবিধা দেওয়া হয়েছিল।
উল্লেখিত পণ্যের পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) ও শুল্ক কমানোর সুপারিশ করেছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী। যে কারণে এসব পণ্য বা সেবার দাম কমার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। তবে বাজার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যেসব পণ্য বা সেবার দাম কমবে বলা হয়েছিল তার কোনোটির দামই কমেনি। বরং বেশির ভাগ পণ্যের দাম আরও বেড়েছে।
প্রশ্ন হলো, বাজেটে যেসব পণ্য বা সেবাকে গুরুত্ব দিয়ে দাম কমানো বা শুল্ক কমিয়ে বাজারজাত করার কথা, সেগুলো কেন করা হয়নি? অতীতের অনেক বাজেটেও এমন কিছু পণ্য বা সেবার দাম কমার কথা বলা হলেও পরবর্তীতে সেসব পণ্যের দাম প্রত্যাশিতভাবে কমেনি।
গত অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ভ্যাট বা শুল্ক কমানোর কারণে দাম কমতে পারে, এমন প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়েছে। নিচে কয়েকটি পণ্যের বর্তমান দামের চিত্র তুলে ধরা হলো।
হাতে তৈরি বিস্কুট
পাঁচ টাকার বিস্কুট পাঁচ টাকাই আছে। তবে আকারে ছোট হয়েছে। অর্থাৎ উৎপাদন খরচ কমিয়ে দিয়ে দাম আগের মতো রাখা হয়েছে। এতে দাম বেড়েছে বলেই ধরে নেওয়া যায়।
মিষ্টিজাতীয় পণ্য
মিষ্টির কেজিতে বেড়েছে ৩০-৩৫ টাকা পর্যন্ত। পাশাপাশি মিষ্টি জাতীয় সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে।
দেশীয় বৈদ্যুতিক এলইডি বাল্ব ও সুইস-সকেট
এসব পণ্যের মধ্যে প্রতিটির দাম বেড়েছে ২৫-৩০ টাকা পর্যন্ত। বর্তমানে সর্বনিম্ন এলইডি বাল্ব ১০০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। সকেটে বেড়েছে ২০-৮০ টাকা পর্যন্ত।
প্রেশার কুকার
৯০০ টাকার প্রেশার কুকার এখন ১৩০০-১৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতি প্রেশার কুকারে দাম বেড়েছে ৪০০-৫০০ টাকা পর্যন্ত।
বাইসাইকেল
দুই বছরে মানভেদে বিভিন্ন কোম্পানির বাইসাইকেলের দাম বেড়েছে এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত।
জুসার ও ব্লেন্ডার
মানভেদে ১-২ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। অর্থাৎ বাজেটে যে সুবিধা দেওয়া হয়েছিল তা কাজে লাগেনি।
গৃহস্থালি সরঞ্জাম
পাতিল, চামচ, ভাজনি, ঢাকনাসহ আরও অন্যান্য পণ্যের দাম বেড়েছে ৩০-১০০ টাকা পর্যন্ত।
ওয়াশিং মেশিন এবং ইলেকট্রিক ওভেন
৩০ হাজারের মিনি ওয়াশিং মেশিন এখন ৪১ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ইলেকট্রিক ওভেনে দাম বেড়েছে এক থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত।
কম্পিউটার
ডলার সংকটের কারণে কম্পিউটারের দাম তুলনামূলকভাবে অনেক বেড়েছে। আগে আমদানিতে যে টাকা খরচ পড়ত, বর্তমানে সেটা দ্বিগুণ হয়ে গেছে। মানভেদে কম্পিউটারের দাম প্রায় ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ
চলতি বছরের শুরু থেকেই কম্পিউটারের যন্ত্রাংশের দাম কিছুটা বেড়েছে। বিশেষ করে গ্রাফিক্স কার্ড ও মনিটরের দাম আগের চেয়ে বেশি।
রেফ্রিজারেটর
প্রায় সব ধরনের ফ্রিজের দাম বেড়েছে। বিশেষ করে তাপপ্রবাহে অসহনীয় গরমের কারণে রেফ্রিজারেটরের চাহিদা আগের চেয়ে বেড়ে যাওয়ায় দামও বেড়েছে।
সাবান ও শ্যাম্পু
সব ধরনের সাবান ও শ্যাম্পুর দাম বেড়েছে। বাজেটে এসব পণ্যের দাম পরিবর্তনের যে আভাস দেওয়া হয়েছিল তা কার্যকর হয়নি।
শুধু চলতি অর্থবছরেই নয়, বিগত প্রায় প্রতিটি অর্থবছরেই একই চিত্র দেখা গেছে। বাজারের কয়েক বছরের দামের চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, বাজেট ঘোষণার আগে যেসব পণ্য বা সেবার দাম কমবে বলে জানানো হয়, সেগুলোর মধ্যে ২-৩টা ছাড়া প্রায় সবগুলোরই দাম বাড়ে।
বিষয়টি নিয়ে সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের নামে বিভিন্ন অভিযোগ তোলা হলেও, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও সিন্ডিকেটের ওপর দোষ চাপানো হচ্ছে। তবে, দাম নিয়ন্ত্রণ করতে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়ার পরও তা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না।
চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) পুরো বাজেট গরিব মানুষের জন্য ‘উপহার’ বলে জানিয়েছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। কিন্তু হয়েছে তার উল্টো। পুরো অর্থবছর পার হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এরপরও কোনো সুফল পায়নি সাধারণ জনগণ।