রিজার্ভ বাড়াতে রেমিট্যান্সে প্রণোদনায় জোর

মো. মির হোসেন সরকার প্রকাশিত: মে ২৯, ২০২৪, ০৯:৪৮ পিএম

দেশের রিজার্ভ বাড়াতে প্রবাসী আয়ে (রেমিট্যান্স) বিশেষ নজর দিয়েছে সরকার। বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স আনতে দুই দশমিক পাঁচ শতাংশ প্রণোদনার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে আরও দুই দশমিক পাঁচ শতাংশ। এতে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়ার কথা থাকলেও সেই তুলনায় বাড়েনি। ফলে অতিরিক্ত লাভের আশায় হুন্ডির মাধ্যমে এখনও দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা। এমন পরিস্থিতিতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে রেমিট্যান্সে প্রণোদনা আরও বাড়ালে রিজার্ভের পাল্লা ভারী হবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

তারা বলছেন, “বছর বছর বিদেশে কর্মসংস্থান বাড়ে। অথচ প্রবাসী আয়ে তেমন সুফল আসে না। রেমিট্যান্সের প্রবাহ কিছুদিন বাড়লে আবারও তা কমে যায়। রেমিট্যান্সের প্রবাহ স্থিতিশীল ও বৃদ্ধির জন্য প্রণোদনায় জোর দিতে হবে সরকারকে। তাহলেই রিজার্ভ বাড়বে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে।

জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবির সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “ব্যাংকে ডলারের দামের চেয়ে হুন্ডিতে টাকা বেশি পাচ্ছেন প্রবাসীরা। তাদের কষ্টার্জিত অর্থ যেখানে বেশি পাবেন সেখানেই ছুটবেন প্রবাসীরা। এটাই স্বাভাবিক। তাই আসছে বাজেটে জোর দিতে হবে দক্ষতা উন্নয়নে। সেই সঙ্গে বাড়াতে হবে প্রণোদনা। এতে প্রবাসী আয় ৫ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার বাড়তে পারে। তবে সেজন্য শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।”

বেসরকারি একটি পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত বাংলাদেশির সংখ্যা ছিল প্রায় ১ কোটি ৪৮ লাখ। একই বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ১১ লাখ ৩৬ হাজার বাংলাদেশির। পরবর্তী এক বছরে এতে যোগ হয়েছে আরও ১৩ লাখ ৬ হাজার। আর চলতি বছরের প্রথম চার মাসে যোগ হয়েছে ৩ লাখ ২২ হাজার ২৩৭ জন।

সূত্রমতে, বর্তমানে প্রবাসে বাংলাদেশি কর্মীর সংখ্যা বেড়ে প্রায় ১ কোটি ৬৪ লাখ ছাড়িয়েছে। বছর বছর বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর প্রবণতা বাড়লেও রেমিট্যান্স আয় পড়ে আছে সেই ২ হাজার ২০০ কোটি ডলারের ঘরেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবাসী আয় এসেছে ২ হাজার ১০৩ কোটি ১৬ লাখ ডলার। পরের অর্থবছরে বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ১৬১ কোটি ৭ লাখ ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে এসেছে ১ হাজার ৯১১ কোটি ৭৫ লাখ ডলার।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রবাসীদের অর্থ পাঠানোর ব্যবস্থাপনা সহজ করতে ব্যাংকের শাখা নয়, চুক্তি করতে হবে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর ব্যাংকের সঙ্গে। এছাড়াও বাড়ি বাড়ি সচেতনতা সৃষ্টির পরামর্শও দিয়েছেন তারা।

রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের (বিকেবি) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, “বাংলাদেশি ব্যাংকের শাখা বিদেশে স্থাপনের প্রয়োজন নেই। যেসব দেশ থেকে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠায়, সেসব দেশের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে চুক্তি করতে হবে।”

ইসমাইল হোসেন আরও বলেন, “প্রবাসী আয় বাড়ানোর জন্য রেমিট্যান্স পাঠানোদের অ-আর্থিক সুবিধা হিসেবে স্বদেশে ফিরে এলে কর্মসংস্থানে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সরকারি সেবা, বিমানবন্দরে অভ্যর্থনাসহ সব ধরনের কার্যক্রম দ্রুত শেষ করতে হবে। তাহলে প্রবাসীরা সন্তুষ্ট হয়ে দেশের ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাতে আগ্রহী বেশি হবে।”

তথ্য বলছে, দীর্ঘদিন ধরেই রিজার্ভ বাড়াতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে। তবে ২০২১ সালের আগস্টের পর থেকেই বাড়ার চেয়ে রিজার্ভ কমেছে। ২০২১ সালের আগস্টে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৪৮ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায় রিজার্ভ। প্রকৃত বা ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের পরিমাণ এখন ১৩ বিলিয়ন ডলারের কিছুটা কম।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রিজার্ভ বাড়াতে ডলারের দাম বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতি ডলার ১১০ থেকে ৭ টাকা বাড়িয়ে ১১৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে প্রবাসীরা বৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাতে আগ্রহী হবে বলেও মনে করেন অনেকে। তবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে প্রবাসীদের কথা বিবেচনা করে আরও প্রণোদনা বাড়ানোর দাবি তাদের।

ইউরোপের দেশ হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্ট থেকে প্রবাসী আরিফুর রহমান সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “আমরা সবসময়ই চাই আমাদের দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়তে থাকুক। এটা সচল থাকলে দেশের উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। তবে অনেক সময় সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠায় অনেকে। যেটা অবৈধ হলেও অতিরিক্ত মুনাফার আশায় এখন সেই পথই প্রবাসীরা বেশি ব্যবহার করছে। আমরা আশা করছি, সরকার প্রণোদনা বাড়ালে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাতে আগ্রহী হবেন প্রবাসীরা।”

আমেরিকা প্রবাসী মামুন সরকার বলেন, “প্রবাসীদের টাকার লোভ দেখিয়ে কাছে টেনে নেয় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। যারা হুন্ডির মাধ্যমে সেই প্রবাসীর বাড়ি পর্যন্ত টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করে। ফলে কোনো ঝামেলা ছাড়াই যখন একজন প্রবাসী বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারে তখন তারা বৈধ পথে আর যায় না।

মামুন সরকার বলেন, “আমরা আশা করবো সরকার বিষয়টি ভালোভাবে মনিটরিং করবে। বৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর পদ্ধতি সহজকরণসহ ঝামেলা এড়াতে সব রকম ব্যবস্থা সরকারের পক্ষ থেকে করা উচিত। এই বিষয়টিতে সরকার নজর দিলে দ্রুতই সুফল পাওয়া যাবে।”