কল-রেডী যেভাবে বাংলাদেশের ইতিহাস

সোহানুর রহমান, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত: মার্চ ৭, ২০২৪, ১০:২৪ এএম
ঐতিহাসিক ;৭ মার্চে ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি : সংগৃহীত

স্বাধীনতার আন্দোলনের প্রতিটি ধাপের সঙ্গে কিছু নাম ইতিহাসে সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নীরবে-নিভৃতে। ভাষা আন্দোলনের পরেই বাংলাদেশে পাকিস্তানের নিপীড়নের ইতিহাস ক্রমেই বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে মিছিল-সমাবেশ। মিছিল সমাবেশ হলেই সেখানে প্রয়োজন হত মাইকের। আর ’৫২-পরবর্তী সময়ে প্রতিবাদ আন্দোলনের প্রতিটি ধাপে ‘কল-রেডী’ মাইক সার্ভিস জড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হিসেবে। কল-রেডী সার্ভিস ইতিহাসের এক অমলিন অংশ।

১৯৭১ এর সেই অগ্নিঝরা উত্তাল সময়ে কল-রেডী মাইক সার্ভিস ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হয়েও শুধুমাত্র দেশের স্বার্থে সেবা দিয়ে গেছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন, ১৯৭১ এর ও ইতিহাসিক ৭ই মার্চের সমাবেশেও যোগ দিয়েছে কল-রেডী। কল-রেডীর মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিয়েছেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এবং স্বাধীনতা পরবর্তীকালের জাতীয় নেতৃবৃন্দ। স্বাধীনতা পরবর্তী কালেও কল-রেডী’র মাইক সার্ভিস সমানভাবে সেবা দিয়া যাচ্ছে।  ঐতিহাসিক ৭ মার্চ কল-রেডীর মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

 কল-রেডী মাইকের শুরু যেভাবে

মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুরের শ্রীনগর থানার মঠবাড়িয়া গ্রামের সহোদর দুই ভাই দয়াল ঘোষ ও হরিপদ ঘোষ। ১৯৪৮ সালে তারা পুরান ঢাকার সূত্রাপুরে (পুরান ঢাকার ৩৬ ঋষিকেশ দাস লেন) মাইকের ব্যবসা শুরু করলেন। প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল আইএম অলওয়েজ রেডি, অন কল এট ইয়োর সার্ভিস বা আরজা (এআরজেএ) অথবা ‘আরজু’ ইলেকট্রনিক্স। বছরখানেক পরই নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘কল-রেডী’। মূলত লাইটিং, সাজসজ্জা ভাড়া দিত আরজু ইলেক্ট্রনিক্স। বিয়ে-শাদিতে লাইটের সঙ্গে গ্রামোফোনও ভাড়া নিত লোকজন। দোকানটি পরিচিত হয়ে ওঠে অল্পদিনেই। সেই সঙ্গে চাহিদাও বাড়তে থাকে, চাহিদা অনুযায়ী যোগান দিতে ভারত থেকে কয়েকটি মাইক নিয়ে আসেন। কিন্তু তা দিয়েও চাহিদা পূরণ হচ্ছিল না।। মাইকের কারিগরি জানা থাকায় হরিপদ ঘোষ নিজেই যন্ত্রপাতি কিনে কয়েকটি হ্যান্ডমাইক তৈরি করেন।

আরজু লাইট হাউস থেকে কল-রেডী
দেশভাগের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা মাইক ভাড়া নিতে শুরু করেন আরজু লাইট হাউস থেকে। চাহিদা বাড়তে থাকে দিনে দিনে। তাই তাইওয়ান, জাপান, চীন থেকে আনা হয় মাইক। তবে মাইকের মূল অংশ মানে ইউনিট বেশি আনা হতো বাইরে থেকে। এরপর নিজের দোকানের কারিগর দিয়ে হরিপদ ঘোষ তৈরি করতেন বাকি অংশ। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর থেকে সভা-সমাবেশ বাড়তে থাকে এবং সামাজিক আর ধর্মীয় অনুষ্ঠানের প্রয়োজনেও মাইকের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। তাই মাইক সার্ভিসের সাথে মিল রেখে ‘কল-রেডী’ নামটিই ঠিক করেন। প্রয়োজনে কল করলেই যেন মাইক রেডি থাকে। অর্থাৎ কল করলেই রেডি—কল-রেডী।

দায়িত্বশীলতার কারণে শহরে কল-রেডী সার্ভিসের গ্রহনযোগ্যতা বাড়তে থাকে। ব্যবসা শুরু করার পরে ১৯৫৪ সালে কল-রেডীর কর্মী ছিল ২০ জন। কাজের চাপ বৃদ্ধি পেলে বাড়তি লোক নিয়ে সামাল দিতে হত। মাঝেমধ্যে তাদের ছোট দুই ভাই গোপাল ঘোষ ও কানাই ঘোষও সাহায্য করতেন।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের সভা-সমাবেশেও কল-রেডীর মাইকে বক্তব্য দিয়েছেন নেতারা।ঐতিহাসিক ৭ মার্চ কল-রেডির মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিয়েছিলেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।

৭ মার্চে যেভাবে কল-রেডী

কল-রেডীর মালিক হরিপদ ঘোষ ও দয়াল ঘোষকে ধানমণ্ডির বাসায় ডেকে পাঠালেন বঙ্গবন্ধু। নির্দেশ দিলেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) মাইক লাগাতে। কাজে নেমে পড়েন হরিপদ ও দয়াল ঘোষ। তখন রেসকোর্সে মাইক লাগানো সোজা ছিল না-শাসকগোষ্ঠীর চোখ ছিল সদা সতর্ক। রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে লুকিয়ে মাইক লাগাতে লাগলেন দুই ভাই।

৭ই মার্চের বাকি আর তিন দিন। মাইক লাগিয়ে কাপড় দিয়ে ঢেকে দিলেন হরিপদ আর দয়াল ঘোষ। কিছু বাড়তি মাইক বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মজুদ রাখেন যেন সমাবেশের দিন তাৎক্ষণিকভাবে লাগিয়ে নিতে পারেন। তিন দিন ধরে ৩০ জন কর্মী নিয়ে বাঁশ, খুঁটি গাঁথার কাজ করেন ঘোষেরা। তারপর সেই দিনটি আসে-৭ই মার্চ। কবি গিয়ে দাঁড়ান জনতার মঞ্চে। মুখের সামনে কল-রেডী। বলেন, ‍‍`এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।‍‍`

বঙ্গবন্ধুর ভাষণকালে যেন কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি না হয়, সে জন্য নিজে উপস্থিত থাকার পাশাপাশি একজন সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ দিয়েছিলেন হরিপদ ঘোষ। অতিরিক্ত তিনটি মাইক্রোফোন সঙ্গে রেখেছিলেন দয়াল ঘোষ।

বড় একটি সমাবেশে মাইক সার্ভিস দিয়ে কত টাকা পারিশ্রমিক নিয়েছিল কল-রেডী? জানতে চাইলে হরিপদ ঘোষের ছেলে কল-রেডীর বর্তমান পরিচালক সাগর ঘোষ জানান, সেই সময় পারিশ্রমিকের কথা চিন্তা করার সুযোগ বাবা ও জ্যাঠা মশাইয়ের ছিল না। বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিয়েছেন সেটাই বড় কথা। আর তা ছাড়া দেশের পরিস্থিতি তখন সবাই কম-বেশি জানতেন। আর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বাবা-কাকার ভালো সম্পর্ক থাকার কারণে বাবা শুধু খরচটাই নিতেন। আরো বললেন, ‍‍`সেদিন সেই সমাবেশে আমার বাবার হাতে তৈরি অনেক হ্যান্ড মাইক ব্যবহৃত হয়েছিল।‍‍`

জাদুঘরে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন  
৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে কল-রেডীর যে মাইকগুলো ছিল, সেগুলো অযত্ন আর অবহেলায় নষ্ট হতে বসেছে। ওই দিন জনসভায় ব্যবহৃত মাইক্রোফোনের স্ট্যান্ডটি আজও সংরক্ষিত আছে কল-রেডির কাছে। সেদিন যেসব অ্যামপ্লিফায়ার ব্যবহার করা হয়েছিল তার মধ্যে ৭টি অ্যামপ্লিফায়ার এখনও আছে। আছে চারটি মাইক্রোফোন। জাদুঘরে এসব সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা একান্ত প্রয়োজন।

এখন যেমন আছে কল-রেডী
রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ, ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি কনসার্ট, বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন বা বিয়েতে মাইকের পাশাপাশি এখন সাউন্ড সিস্টেম সার্ভিস দিয়ে থাকে কল-রেডী। সার্বক্ষণিক সেবাদানের জন্য রয়েছে ২০ জন কর্মী। চাহিদা বেশি হলে অস্থায়ী শ্রমিক নিয়োগ করা হয়। কল-রেডি এখন একই দিনে তিনটি মহাসমাবেশ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার সামর্থ্য রাখে।

প্রতিষ্ঠার পর কল-রেডীর ৭৫ বছর পেরিয়ে গেছে। শুরুর সেই জায়গায়ই আছে কল-রেডী। একটি মাইকের দোকানের এই দীর্ঘ পথ চলাকে কিভাবে দেখেন জানতে চাইলে সাগর বলেন, অনেক পথ কল-রেডী পাড়ি দিয়েছে এটা সত্য। তবে এতটা পথ পাড়ি দেওয়া খুব একটা সহজ ছিল না। প্রতিষ্ঠার পর থেকে অনেক পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজকের এই অবস্থানে এসেছে প্রতিষ্ঠানটি। এখনো সারা দেশের মানুষ এক নামে কল-রেডীকে চেনে। দেশে বড় বড় অনুষ্ঠানের আয়োজকরা এখনো অনুষ্ঠানের জন্য প্রথমে কল-রেডীকেই ডাকেন। সুন্দর-সুষ্ঠু এবং যথাযথ সেবা দানের কারণে কল-রেডীর প্রতি মানুষের এই আগ্রহ বলে আমি মনে করি। আমার জানা মতে, কখনো কল-রেডী সেবাদানের সময় বড় কোনো যান্ত্রিক গোলযোগের মুখোমুখি হয়নি। এর কারণ সব সময় আমাদের সঙ্গে একজন সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার থাকেন।