সংরক্ষিত নারী আসনে নতুনদের প্রাধান্য দেবে আ.লীগ

সফিকুল ইসলাম প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২, ২০২৪, ০৩:৩৯ পিএম
জাতীয় সংসদ। ছবি : সংবাদ প্রকাশ

নিয়ম অনুযায়ী জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের বিপরীতে ৫০ জন সংরক্ষিত নারী এমপি নির্বাচিত করা হয়। এবার সংসদের সরকারি দল ও স্বতন্ত্র মিলিয়ে ৪৮ জন প্রার্থীকে মনোনয়ন দেবে আওয়ামী লীগ। সর্বশেষ বুধবার (৩১জানুয়ারি) নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি অবহিত করেছে দলটি। সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি পেয়েছে দুটি সংরক্ষিত আসন

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, সরকারি দলের হয়ে সংরক্ষিত আসনে বসতে চান আওয়ামী লীগের নারী নেত্রীরা। ইতিমধ্যে অনেকেই নিজেদের জীবন বৃত্তান্ত (সিভি) হাতে নেতাদের দ্বারস্থ হচ্ছেন। যদিও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ জানিয়েছে, সংরক্ষিত আসনে গুরুত্ব পেতে পারেন দলের দুঃসময়ে রাজপথে ভূমিকা রাখা নেত্রীরা। ইতিমধ্যে যারা দলের কোনো সুযোগ-সুবিধা পাননি। এসব নতুন নেত্রীদের এবার জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনগুলোতে মূল্যায়ন করার চিন্তা-ভাবনা করছেন দলীয়প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেষ হওয়ার পরপরই আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে ভিড় বাড়ে দলের নারী নেত্রীদের। বর্তমানদের পাশাপাশি সংরক্ষিত আসনের দৌড়ে যোগ হয়েছেন সাবেক নেত্রীরাও।

বিভিন্ন জেলা আওয়ামী লীগের কমিটি থেকেও কেন্দ্রে সুপারিশ পাঠানো হচ্ছে। জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের মাধ্যমে সুপারিশ করা হচ্ছে। তবে সেই সুপারিশ কতটা কাজে আসবে তা নিয়েও রয়েছে অনেকের সন্দেহ। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের একটি নারী সংগঠনের নেত্রী সংবাদ প্রকাশকে বলেন, জেলা থেকে কেন্দ্রে সুপারিশ করা হচ্ছে। অনেকের নাম দেওয়া হচ্ছে, অনেকের নাম বাদ দেওয়ার চেষ্টা করাও হচ্ছে। তবে সুপারিশ পাওয়ার পর তা যাচাই-বাছাই করছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। বাদ যাওয়া নাম সুপারিশ তালিকায় রাখতেও নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।

এদিকে কেন্দ্রীয় ও জেলার শীর্ষ নেতাদের পরামর্শ অনুযায়ী কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের দপ্তরে সিভি জমা দিচ্ছেন অনেক নেত্রী। যদিও দৌড়ঝাঁপ বা সিভি নিয়ে ঘোরাঘুরি করতে রাজি নন অনেকে। সংরক্ষিত আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সাবিনা আক্তার তুহিন মনে করেন, যার যার মূল্যায়ন হবে তার তার কাজে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে করেন তিনি। তবে হেরে যান। অনেকেই মনে করেন বিএনপি সরকারের আমলে আন্দোলন-সংগ্রামে সামনে থাকা এই নেত্রী আবারও সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য হতে পারেন। এ বিষয়ে সাবিনা আক্তার তুহিন বলেন, “আমি কারও কাছে যাইনি, যাবও না। আমি কাজ করি— সবাই এটা জানে। নেত্রী আমাকে যেখানে রাখবেন, আমি সেখানে থাকব।”

আওয়ামী লীগের পদে নেই, তবে মানবাধিকারকর্মী, সমাজকর্মী, গবেষক, শিক্ষক, সাহিত্যিক, অভিনয়শিল্পী, সাংবাদিক সব পর্যায় থেকেই এবার সংসদে প্রতিনিধি উঠে আসতে পারে বলেও জানা গেছে। সে ক্ষেত্রে বেশকিছু নামও সামনে এসেছে।

আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সংরক্ষিত নারী আসনের বিষয়ে গত সপ্তাহের শেষ দিকে আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডে আলোচনা হয়। সেখানে নতুনদের বিষয়ে বেশি আগ্রহ দেখানো হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা দলীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে পৃথকভাবে কথাও বলেছেন। সেখানেও নারী আসনে নতুনদের সুযোগ দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। দলের এই সিদ্ধান্তের কথা নেতাদের কেউ কেউ ইতোমধ্যে মনোনয়নপ্রত্যাশীদেরও জানিয়েছেন। ওই বৈঠকের পর আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক অনেককেই নীতিগত সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিয়েছেন। বিশেষ করে সাবেক এমপিদের মধ্যে কেউ কেউ দেখা করে সালাম দিতে গেলে তাদের সরাসরি না করে দিয়েছেন তিনি।

গত ২৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার কারণে শুভেচ্ছা জানাতে গণভবনে যান। সেখানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশাপাশি সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারাও উপস্থিত ছিলেন। মনোনয়নপ্রত্যাশী নারী নেত্রীদের অনেকেও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত নারী নেত্রীদের কেউ কেউ সংরক্ষিত আসনে দলীয় মনোনয়নের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। সেই সময় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এবারের সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে নতুনদের সুযোগ দিতে তার আগ্রহের কথা জানান। তবে দলের সিদ্ধান্তের কারণে যারা সরাসরি নির্বাচনে মনোনয়ন পেয়েও সরে গেছেন বা মনোনয়ন থেকে ছিটকে পড়েছেন এমন কাউকে কাউকে এবারও নারী আসনে দেখা যেতে পারে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।

একাদশ জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত নারী আসনে এমপির সংখ্যা ছিল ৪৩টি। এর মধ্যে চারজন এবার সরাসরি নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। তারা হলেন খাদিজাতুল আনোয়ার, রুমানা আলী, সুলতানা নাদিরা ও তাহমিনা বেগম। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, একাদশ সংসদের বাকি যে ৩৯ জন আছেন, তাদের মধ্যে কেউ কেউ এবারও থাকতে পারেন। তবে সেই সংখ্যা খুবই কম।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিম বলেন, “এবার যোগ্যরাই সংরক্ষিত আসনে উঠে আসবেন। আওয়ামী লীগের আদর্শের সাথে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সাথে যারা কাজ করেছেন, আগামী দিনে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের স্বপ্নের সোনার বাংলা নির্মাণে সততা, দক্ষতা এবং যোগ্যতা নিয়ে কাজ করবেন, সাহসী, নীতি-আদর্শে পরীক্ষিত তাদের মধ্য থেকে বাছাই করা হবে। এছাড়া বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা থেকে যারা কাজ করেছেন, বহুমাত্রিক প্রতিভার সমন্বয়ে সাধনের ভেতর দিয়ে এটা চূড়ান্ত করা হবে।”

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সংরক্ষিত আসনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। সেই হিসেবে আওয়ামী লীগ তাদের ও স্বতন্ত্র মিলে ৫০ আসনের মধ্যে ৪৮ আসনে প্রার্থী দেবে। সংরক্ষিত নারী আসনে আওয়ামী লীগ পরিবারের সন্তানদের বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে।

সংবিধান অনুযায়ী, নারীদের জন্য জাতীয় সংসদে ৫০টি আসন সংরক্ষিত রয়েছে। সাধারণ নির্বাচনের ফলের গেজেট প্রকাশের ৯০ দিনের মধ্যে এসব সংরক্ষিত আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে।এ হিসাবে চলতি বছরের ৯ এপ্রিলের মধ্যে ইসিকে সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনের ভোট করতে হবে।

আলোচনায় যারা

সংরক্ষিত নারী আসনে দলের মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে আলোচনায় আছেন আওয়ামী লীগের কৃষিবিষয়ক সম্পাদক ফরিদুন্নাহার লাইলী। দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার পরও জোটের কারণে তাকে বসে যেতে হয়েছে। এর আগে ২০০৮ সালেও একই অবস্থা হয়েছিল। দলীয় সিদ্ধান্তের প্রতি আস্থা রাখার কারণে তিনি সংরক্ষিত আসন থেকে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার দৌড়ে এগিয়ে আছেন। একই অবস্থা সাবেক শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ানের। দলের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামালকে সুযোগ করে দিতে দলীয় সিদ্ধান্ত মাথা পেতে নেন তিনি। তাকে নিয়েও দলের হাইকমান্ডের ইতিবাচক ধারণা রয়েছে। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় কমিটির বেশ কয়েকজন নেত্রী এবার আলোচনায় আছেন। এর মধ্যে রয়েছেন অর্থ ও পরিকল্পনাবিষয়ক সম্পাদক ওয়াসিকা আয়শা খান। একাদশ জাতীয় সংসদেও তিনি সংরক্ষিত আসনের সদস্য ছিলেন।

আলোচনায় আছে স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যাবিষয়ক সম্পাদক রোকেয়া সুলতানার নামও। বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে, বিশেষ করে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর আহত আওয়ামী লীগ নেতাদের চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি। শিক্ষা ও মানবসম্পদবিষয়ক সম্পাদক শামসুন নাহার চাঁপা, মারুফা আক্তার পপি ও হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়াও রয়েছেন আলোচনায়। এ ছাড়া দলীয় মনোনয়ন পেয়েও নাগরিকত্ব জটিলতায় সরাসরি আসনে নির্বাচনে অংশ নিতে না পারা আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পাদক শাম্মী আহমেদের বিষয়টি নিয়েও আলোচনা আছে দলের মধ্যে।

মহিলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সুলতানা রাজিয়া পান্নাও রয়েছেন আলোচনায়। এ ছাড়া যুব মহিলা লীগের সভাপতি ডেইজী সারোয়ার এবং সাধারণ সম্পাদক শারমিন সুলতানা লিলি—দুজনকে নিয়েও আলোচনা আছে।

আলোচনায় রয়েছেন মুন্সীগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য ও লৌহজং উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট রানু আখতার। তিনি বলেন, “আমি আজন্ম আওয়ামী লীগার। সবসময় দলের প্রয়োজনে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি। জানি না, কতটুকু করতে পেরেছি। আমার নেত্রী বাংলার কোটি কোটি মানুষের আস্থার ঠিকানা শেখ হাসিনা আমাকে যোগ্য মনে করলে সংরক্ষিত আসনে মনোনীত করবেন।”

বরাবরের মতো এবারও সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে আলোচনায় রয়েছেন একাদশ সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি আরমা দত্ত। বাসন্তী চাকমা ও গ্লোরিয়া ঝর্না সরকার গত সংসদে থাকলেও তাদের জায়গায় এবার নতুন মুখ দেখা যেতে পারে। এবার খ্রিস্টান সম্প্রদায় থেকে প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় আছেন মহিলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক দীপিকা রাণী সমাদ্দার।