পল্লবী (মিরপুর-১২) থেকে কোন যাত্রী বাসে উঠে যদি ফার্মগেট নামেন তাহলে তাকে সরকারি ভাড়ার তালিকা অনুযায়ী দিতে হয় ১৫ টাকা। একই যাত্রী যদি শাহবাগ নামেন তাহলে তার জন্য নির্ধারিত ভাড়া ১৯ টাকা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এই রুটের সব বাসই যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করছে ২৫ টাকা। অর্থাৎ পল্লবী থেকে শাহবাগ পর্যন্ত আসতে যাত্রীদের ৬ টাকা বেশি ভাড়া গুণতে হচ্ছে। অতিরিক্ত ভাড়া আদায় নিয়ে পরিবহন শ্রমিক ও যাত্রীদের মধ্যে বাকবিতণ্ডাসহ হাতাহাতির ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত।
এদিকে গেটলক সার্ভিসের নামে ভাড়া আদায় হচ্ছে স্টপেজ থেকে আরেক স্টপেজের। মাঝখানে যাত্রী নেমে গেলেও তাদের ভাড়া দিতে হচ্ছে পুরোটারই। কিলোমিটার অনুযায় সরকারের নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত অর্থ আদায় করছে বাস মালিকরা। কেউ যদি ফার্মগেট থেকে শাহবাগ যান তাহলে সরকার নির্ধারিত ভাড়া ৭টাকা, কিন্তু বাসে আদায় করা হচ্ছে ১০টাকা। এমনকি কেউ যদি ফার্মগেট থেকে শাহবাগের আগে বাংলামোটরেও নামেন, তাদেরকেও ভাড়া গুণতে হচ্ছে সেই ১০টাকাই। এভাবে বাড়তি ভাড়া প্রতিদিন দিতে হচ্ছে বলে নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে মধ্যবিত্ত নগরবাসীর।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ অনুযায়ী, মহানগরের বাস ও মিনিবাসের নির্ধারিত ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে এক টাকা ৭০ পয়সা। যার হিসাব মতে মিরপুর-১২ বাসস্ট্যান্ড থেকে কাজীপাড়ার দূরত্ব ৪ দশমিক ২ কিলোমিটার এবং ফার্মগেট বাস স্টপেজের দূরত্ব প্রায় ৯ কিলোমিটার। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহত কর্তৃপক্ষ, বিআরটিএ নির্ধারিত ভাড়া অনুযায়ী মিরপুর-১২ থেকে কাজীপাড়ায় ভাড়া আসে ৬ টাকা ৮০ পয়সা, তবে সেটিকে সরকারিভাবেই ৭ টাকা ধরা আছে। আর মিরপুর-১২ থেকে ফার্মগেটের ভাড়া দাঁড়ায় ১৫ টাকায়। ভাড়ার তালিকায় এটি আবার ১৫টাকাই রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে ফার্মগেট পেরিয়ে কারওয়ান বাজার এলেই এই ভাড়া বেড়ে যায়, যাত্রীদের দিতে হয় ২৫ টাকা। অথচ ফার্মগেট থেকে কারওয়ান বাজারের দূরত্ব এক কিলোমিটারেরও কম।
এছাড়া গুলশান-বাড্ডা লিংক রোড, রামপুরা থেকে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার রুটে চলাচলকারী স্বাধীন, রমজান, রাজধানী পরিবহনে স্টাফ কোয়ার্টার থেকে রামপুরা পর্যন্ত ভাড়া নেওয়া হয় ২০ টাকা, যা বিআরটিএ নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অনেক বেশি। এছাড়া মাঝপথে যেখানেই যাত্রী নামে, ১০ টাকার নিচে ভাড়া নিতে চায় না কোনো পরিবহন। একইভাবে যাত্রাবাড়ী বা সদরঘাট থেকে গাজীপুর বা আব্দুল্লাহপুর রুটে চলাচলকারী আকাশ, ভিক্টর ক্ল্যাসিক, রাইদা বাস চলাচল করে। এসব বাসে উঠে সামনের স্টপেজ আসা পর্যন্ত যাত্রী যেখানেই নামেন সেখানেই ১০ টাকা ভাড়া গুনতে হয়।
মিরপুরের কালশী হয়ে উত্তরা, বনানী, গুলশান, রামপুরা রুটের বাসগুলোতেও একইভাবে যাত্রীদের জিম্মি করে রাখা হয়েছে বলে যাত্রীরা অভিযোগ করেছেন। প্রজাপতি, পরিস্থান, তুর, রবরব, অছিম পরিবহনসহ বিভিন্ন রুটের গাড়িতে উঠলেই যাত্রীদের দিতে হচ্ছে পুরো ভাড়া।
যাত্রীরা অভিযোগ করে বলছেন, এ পদ্ধতির জন্য প্রতিনিয়ত প্রকাশ্যে তারা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। বাস মালিকদের এমন নৈরাজ্য প্রতি মুহূর্তেই সরকারি নির্দেশনাকে উপেক্ষা করছে। তবে এ নিয়ে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইমরান সারওয়ার সংবাদ প্রকাশকে জানান, যাত্রীদের কাছ থেকে বাস ভাড়া বেশি আদায় করার জন্য বাস মালিকরা এ সিস্টেমের নাম দিয়েছেন ‘সিটিং সার্ভিস’। সাধারণ যাত্রীদের পকেট কাটতে এই সিটিং সার্ভিসের বাসগুলোতে নির্ধারিত দূরত্বে পরপর কতজন যাত্রী উঠেছেন, তা গণনা করে যে খাতায় লেখা হয় সেটাই 'ওয়েবিল' নাম দিয়েছে বাস মালিকরা। আসলে এমন নৈরাজ্যরে একটা সুরাহা করা উচিত। কেননা প্রতিনিয়ত তাদের নানা ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে সবাইকে।
রোকেয়া আক্তার নামে আরেক যাত্রী অভিযোগ করেন, “মিরপুর থেকে প্রতিদিন আমাকে বাসে করে কারওয়ান বাজার অফিসে যেতে হয়। সরকার নির্ধারিত ভাড়া মিরপুর থেকে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত ১৬ টাকা আসে। তবে বাসের হেলপার ওয়েবিলের কথা বলে আমার থেকে ২৫ টাকা আদায় করছে।”
রোকেয়া দাবি করেন, “এমন অভিযোগ শুধু আমার একার নয় সবাই এমন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। এমন নৈরাজ্যমূলক ভাড়া যদি সরকার এখনই শক্ত হাতে দমন না করে তাহলে পরিবহন মালিকরা সাধারণ জনগণকে আরো জিম্মি করে ফেলবে।”
এদিকে পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চালক, হেলপার, কন্ডাক্টর কিংবা ওয়েবিলে স্বাক্ষর করা লাইনম্যান কারোই নির্দিষ্ট বেতন দেন না পরিবহন মালিকরা। লাইনম্যানরা প্রতি ট্রিপ বাবদ ১০ টাকা নেন। এভাবে প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা আদায় হয় লাইনম্যানদের। ওয়েবিলের স্বাক্ষর হিসাব করে ভাড়ার টাকা বুঝে নেন মালিকরা। ওয়েবিলে স্বাক্ষরের বাইরে বাস থামিয়ে যেসব যাত্রী তোলা হয়, তাতে যে ভাড়া আসে, সেটা ভাগ করে নেন চালক এবং শ্রমিকরা।
যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “বাংলাদেশে সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী যে ভাড়ার কথা উল্লেখ আছে, তার কোথাও ওয়েবিলের কথা উল্লেখ নেই। বিআরটিএ আইন অনুযায়ী, রাস্তায় ভাড়া নির্ধারণ করা হয় প্রতি কিলোমিটার হিসাব করে। অথচ বাস মালিকদের কাছে এসে তাদের নির্ধারিত ওয়েবিলের নামে ভাড়া নির্ধারণ হয়ে যায়। বাসে যেখান থেকে উঠবো এবং যেখানে নামবো আমি তো সেখানেই ভাড়া দিবো। কিন্তু এর বেশি কেন আমাকে ভাড়া দিতে হবে, এটি কেমন নিয়ম?”
অভিযোগের স্বরে তিনি বলেন, “দিনের পর দিন নানা রকম অনিয়ম করে এই অবস্থায় রাজধানীর গাড়িগুলো চলছে। গাড়ির মালিকরা কোনো আইনের তোয়াক্কা করছে না। তাহলে তারা কি সরকার থেকেও শক্তিশালী? এদের যদি এখনই দ্রুত নিয়ন্ত্রণ না করা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে আরো ভয়াবহ অবস্থা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।”
এসব অভিযোগের বিষয়ে বিআরটিএ এনফোর্সমেন্ট উইং কর্মকর্তা মো. সারোয়ার আলম সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “বিআরটিএ আইনের কোথায়ও ওয়েবিলের ভাড়ার কথা উল্লেখ নেই। আর বিআরটিএ’র নির্ধারিত ভাড়া ছাড়া অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের কোনো সুযোগ নেই। যদি কেউ এমন অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে আর আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ আসে, আমরা অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।”
এই কর্মকর্তা মনে করেন, “রাজধানীর প্রতিটি এলাকাকে মনিটরিংয়ের মাধ্যমে তদারকি করা আবশ্যক। যদি প্রতিটি এলাকাকে মনিটরিংয়ের আওতায় আনা যায়, তাহলে অবশ্যই সাধারণ যাত্রীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া ভাড়া থেকে তারা রক্ষা পাবে।”