ভোলা জেলার অটোরিকশাচালক আব্দুল কায়য়ুম। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য তিনদিন আগে ভর্তি হয়েছেন রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। প্রতিদিন চিকিৎসার জন্য এক থেকে দেড় হাজার টাকার ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয় তাকে। যে তালিকায় রয়েছে সাধারণ শিরায় দেওয়ার ‘স্যালাইন’।
এ বিষয়ে আব্দুল কায়য়ুম সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “বিনামূল্যের চিকিৎসার জন্য ভোলা থেকে এসে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। কিন্তু তারা স্যালাইন থেকে শুরু করে প্রায় সব ওষুধ বাইরে থেকে নিয়ে আসতে বলেন। কিন্তু বাইরেও তা পাওয়া যাচ্ছে না। আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ঢাকায় এসেছি। হাসপাতালের ওষুধ পেলে আমাদের খুব উপকার হতো।”
মুগদা হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, আব্দুল কায়য়ুমের মতো অনেকেই স্যালাইন না পেয়ে বাইরের ফার্মেসিতে ভিড় করছেন। বিশেষ করে ডেঙ্গু আক্রান্তদের শিরায় দেওয়া স্যালাইন ও রক্তের প্লাজমা বাড়ানোর জন্য এই স্যালাইনের চাহিদা বেশি হওয়ায় সংকট দেখা দিয়েছে।
হাসপাতালে রোগীদের চাহিদার তুলনায় স্যালাইন সরবরাহ দিতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। আবার বাইরের ফার্মেসিগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণ সরবরাহ নেই এই স্যালাইনের। এ কারণে হাসপাতালটিতে আসা রোগীর স্বজনরা পড়েছেন ভোগান্তিতে।
গত কয়েক মাস ধরে ডেঙ্গু রোগী আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় স্যালাইনের সংকট বেড়ে যায়। বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের স্যালাইন সরবরাহ নিয়ে কোনো অভিযোগ না থাকলেও সরকারি হাসপাতালে আসা ডেঙ্গু রোগীরা তা ঠিকমতো পাচ্ছেন না।
ফার্মেসি মালিকদের দাবি, চাহিদার তুলনায় স্যালাইনের সরবরাহ কম। এতে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন মুমূর্ষু ও সার্জারির রোগীরা।
মুগদা হাসপাতালের সামনে ভাবনা ফার্মেসিতে স্যালাইন কিনতে আসা মো. আসলাম শেখ সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “এই হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর ব্যাপক চাপ। এখানে শয্যার পাশাপাশি স্যালাইনেরও ব্যাপক সংকট রয়েছে। হাসপাতাল থেকে প্রথম দিন স্যালাইন পাওয়া গেলেও এখন পাওয়া যাচ্ছে না। নার্সরা বলছেন, বাইরে থেকে নিয়ে আসতে হবে। প্রথম তিনটি দোকানে খোঁজ করেও এক ব্যাগ স্যালাইন পাইনি। এখানে এসে স্যালাইন পেলাম।”
ডেঙ্গু আক্রান্ত চাচার জন্য স্যালাইন কিনতে এক ফার্মেসি থেকে আরেক ফার্মেসি ঘুরছেন নজরুল ইসলাম। তিনি সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “আমার চাচা ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি। হাসপাতালে স্যালাইন নেই। বাইরে থেকেও কিনতে পারছি না। কয়েকটি ফার্মেসি ঘুরে এক ব্যাগ স্যালাইন পেয়েছি। এরপরও যদি স্যালাইন দরকার হয়, তাহলে কোথায় পাব ভাবছি।”
ডেঙ্গুর ভয়াবহতা শুরু হওয়ার পর ডিএনএস স্যালাইনের প্রয়োজনীয়তা বাড়ে। আর কোনো কোম্পানি এটি সরবরাহ করতে পারছেন না বলে জানান মুগদা হাসপাতালের সামনের আল শাফা ফার্মেসির মালিক শাহাজান। তিনি সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “ডেঙ্গু রোগী বেড়ে যাওয়ার পর দোকানে এ স্যালাইন সরবরাহ ঠিকভাবে দিতে পারছে না ওষুধ কোম্পানিগুলো। আগে প্রতিদিন কোম্পানির লোক এলেও এখন ঠিক মতো আসেন না। যখন আসে ১০ কার্টুন অর্ডার দিলে ২ কার্টুন দেয় তারা।”
ভাবনা ফার্মেসির ম্যানেজার মো. মোস্তফা সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “ডেঙ্গু রোগীর কারণে বাজারে স্যালাইনের এই সংকট তৈরি হয়েছে। স্যালাইনের জন্য হাহাকার তৈরি হয়েছে। আমরা ১০০ ব্যাগ স্যালাইনের চাহিদা দিলে কোম্পানি মাত্র ৬ থেকে ১০টার বেশি দিতে পারছে না। অন্য সময়ে সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিরা এসে বলতেন, কয় ব্যাগ দেবো স্যালাইন? আর এখন তারা দোকানের সামনেও আসেন না।”
মুগদা হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের ডা. আব্দুল মান্নান সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে রক্তের জলীয় অংশ কমে যায়। এতে রক্তের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি রক্তচাপ কমে যায়। রক্তের তারল্য ঠিক রাখতে ও রক্তচাপ স্থিতিশীল রাখতে রোগীকে স্যালাইন দিতে হয়। একজন রোগীকে দিনে এক থেকে দুই লিটার, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর বেশি স্যালাইন দেওয়া প্রয়োজন হয়। ডেঙ্গুর চিকিৎসায় সাধারণত দশমিক ৯ শতাংশ সোডিয়াম ক্লোরাইড স্যালাইন রোগীর শরীরে পুশ করতে হয়। কিন্তু অতিরিক্ত রোগীর চাপে চাহিদা অনুযায়ী স্যালাইন সরবরাহ করা যাচ্ছে না। ফলে অনেক রোগীকে বাইরে থেকে অতিরিক্ত দামে স্যালাইন কিনতে হয়।”
এদিকে, স্যালাইনের সংকট সমাধানে ২০ লাখ স্যালাইন আমদানির অনুমতি দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব অনুযায়ী, ২০ লাখ ব্যাগ স্যালাইনের মধ্যে ১২ লাখ পিস নরমাল স্যালাইন (১০০০ মিলিলিটার) ও ৮ লাখ পিস গ্লুকোজ স্যালাইন (১০০০ মিলিলিটার) আমদানি করা হবে।
স্যালাইন সংকটের বিষয়ে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) মো. সালাহউদ্দিন সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “আমরা স্যালাইন উৎপাদনকারী সব ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির এমডিদের সঙ্গে কথা বলেছি। পরিস্থিতি সামাল দিতে সবাই এখন তিন শিফটে উৎপাদন করছে। ডেঙ্গু সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় কিছু সংকট মার্কেটে রয়েছে। এখন ডেঙ্গু রোগী বেড়ে যাওয়ায় স্যালাইনের চাহিদাও বেড়েছে। হঠাৎ করে কোনো জিনিসের চাহিদা বেড়ে গেলে, সরবরাহে কিছুটা ঘাটতি দেখা দেয় এটা স্বাভাবিক।”
সালাহউদ্দিন সংবাদ প্রকাশকে আরও বলেন, “সংকট সমাধানে ২০ লাখ স্যালাইন আমদানির অনুমতি দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। দেশে মাত্র ৫-৬টি কোম্পানি স্যালাইন বানায়। যার ফলে এক লাফে চাহিদা যদি বেড়ে যাওয়ায়, সামাল দিতে কিছুটা সময় লাগে। শিগগিরই সংকট কেটে যাবে।”