‘সরকারের আদেশ আমরা কিভাবে মানবো’

জাহিদ রাকিব প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৩, ০৯:১৩ পিএম
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের আলু পেঁয়াজ বিক্রেতা। ছবি-সংবাদ প্রকাশ

‘পাইকারি বাজারে দাম না কমালে খুচরা বিক্রেতারা কী করে কম দামে বিক্রি করবে। যারা দাম বাড়ায় তাদের না ধরে তদারকি সংস্থা আমাদের ধরে, জরিমানা করে। ক্রেতারাও আমাদের গালাগাল করেন, আমরা অসহায়।’

‘আড়ত থেকে ৪২ টাকা কেজিতে আলু কিনেছি। প্রতি বস্তায় ৬০ কেজি, দুই কেজি থাকে নষ্ট। বস্তাপ্রতি শ্রমিককে দিতে হয় ২০ টাকা। জায়গার ভাড়া বস্তায় ৭০ টাকা। নিজেরও খরচ আছে। সব যোগ করার পর এক কেজি আলু অন্তত ৪৮-৫০ টাকায় বিক্রি করতে হয়। সরকারের আদেশ আমরা কিভাবে মানবো’ 


নিত্যপণ্যের বাজারে মূল্যবৃদ্ধির লাগাম টানতে গত বৃহস্পতিবার আলু, পেঁয়াজ ও ডিম, এই তিন পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দেয় সরকার। সিদ্ধান্ত কার্যকরে সর্বাত্মক শক্তি প্রয়োগের কথাও বলেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। মন্ত্রীর এই ঘোষণার তৃতীয় দিনেও বাজারে নির্ধারিত মূল্য কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। 

অপরদিকে, ঘোষণার পর থেকে বাজার নিয়ন্ত্রণে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর অভিযান চালাচ্ছে। প্রতিটি বাজারে সরকার নির্ধারিত দামে পণ্য বিক্রি করতে আহ্বান জানাচ্ছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করে বলা হয়, প্রতি কেজি আলুর দাম খুচরা পর্যায়ে ৩৫-৩৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, পেঁয়াজের দাম খুচরায় প্রতি কেজি ৬৪-৬৫ টাকা, সেই সঙ্গে প্রতি পিস ডিমের দাম ১২ টাকা বেঁধে দেওয়া হয়। কিন্তু সরকারের আদেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এখনো ভোক্তার পকেট কাটছেন ব্যবসায়ীরা।

সরেজমিনে রাজধানীর কারওয়ান বাজার, রামপুরা কাঁচাবাজার ও হাতিরপুলসহ কয়েকটি বাজারে গিয়ে এসব পণ্যের বিক্রয়মূল্য যাচাই করা হয়। দেখা যায়, সরকার নির্ধারিত দামের ধারে কাছেও এসব পণ্য বিক্রি হচ্ছে না। 

এক সপ্তাহ আগে যেমন প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৮৫-৯০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, এখনো সেই দামেই বিক্রি হচ্ছে। একইভাবে আলুর দাম ৪৫-৫০ টাকার নিচে নেই। প্রতি ডজন ফার্মের ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৫০-১৫৫ টাকায়।

কারওয়ান বাজার থেকে সাব্বির হোসেন নামের এক ক্রেতা দেশি পেঁয়াজ ৮৫ টাকায় ও আলু ৫০ টাকায় কেনেন। তিনি সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “শুনেছি সরকার আলু পেঁয়াজের দাম নির্ধারণ করেছেন, কিন্তু বাজারে তার কিছুই দেখলাম না। যে যেভাবে পারছে, তার মতো করে দাম নিচ্ছে।” ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “শুধু দাম নির্ধারণ করলে হবে না। বাজার মনিটরিংও করতে হবে।”

নির্ধারিত দামে পেঁয়াজ কিনতে না পেরে নাসির উদ্দিন সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াতে পারেন, কমাতে পারেন না। সরকার পেঁয়াজের দাম বলছে ৬৪-৬৫ টাকা, কিন্তু বাজারে দেশি পেঁয়াজ ৮০ টাকার নিচে নাই। কেজিতে ১৫ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। জিনিসের এত দাম, আর সামলাতে পারছি না।”

সরকার নির্ধারিত দামে আলু কেন বিক্রি করছেন না, এমন প্রশ্নের জবাবে ব্যবসায়ী আবুল কাশেম সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “সরকার আলু, পেঁয়াজের দাম নির্ধারণ করে দিয়ে খুচরা বাজারে অভিযান পরিচালনা করে। এতে কোনো লাভ নেই। আমরা আড়ত থেকে যে দামে মাল আনি,তার সঙ্গে খরচ যোগ করে এক দুই টাকা লাভে বিক্রি করি। দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের উচিত আলুর কোল্ডস্টোরেজ থেকে দাম নির্ধারণ করে দেওয়া।”

তিনি আরও বলেন, “আমরা আড়ত থেকেই ৪২ টাকা কেজিতে আলু কিনেছি। প্রতি বস্তায় আলু থাকে ৬০ কেজি, তারমধ্যে দুই কেজি থাকে নষ্ট। বস্তাপ্রতি শ্রমিককে দিতে হয় ২০ টাকা। জায়গার ভাড়া বস্তায় ৭০ টাকা। নিজেরও খরচ আছে। সব যোগ করার পর এক কেজি আলু অন্তত ৪৮-৫০ টাকায় বিক্রি করতে হয়। সরকারের আদেশ আমরা কিভাবে মানবো।”

কারওয়ান বাজারের পেঁয়াজের পাইকারি ব্যবসায়ী শংকর চন্দ্র দাস সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “আমদানিকারকরা পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণ করেন। তারা বাড়ালে সারা দেশে বেড়ে যায়, কমালে দাম কমে। যারা আমদানি করে ওইসব জায়গায় অভিযান পরিচালনা করা দরকার।”

রামপুরা বাজারের পেঁয়াজ বিক্রেতা আমানত আলী সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “সরকার পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দায়িত্ব শেষ করে বসে থাকে। পাইকারি বাজারে দাম না কমালে আমরা খুচরা বিক্রেতারা কি করে দাম কমিয়ে বিক্রি করব। দেখা যায়, যারা দাম বাড়ায় তাদের না ধরে তদারকি সংস্থা আমাদের ধরে। জরিমানা করে। ক্রেতারাও আমাদের গালাগাল করেন। আমরা অসহায়।”

বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আব্দুল জব্বার মণ্ডল মুঠোফোনে সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “পণ্যের দাম কার্যকরে অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের নির্দেশে রাজধানীসহ সারা দেশে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। সরকারের বেঁধে দেওয়া মূল্য কার্যকর করতে কাজ চলমান আছে। প্রতিটি বাজারে নির্ধারিত দামে পণ্য বিক্রি করতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা কাজ করছে। আশা করছি সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে পণ্য বিক্রি হবে।”

বেঁধে দেওয়া দামে পণ্য বিক্রি না হওয়ার বিষয়ে মুঠোফোনে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়শন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ ও অসাধুদের অতি মুনাফা রোধে সরকার একাধিকবার একাধিক পণ্যের দাম নির্ধারণ করেছে। কিন্তু সেই দাম কার্যকর করা যায়নি। বাড়তি দামেই পণ্য কিনতে হয়েছে। এবারও একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। যদিও দাম নির্ধারণের মাত্র তিনদিন অতিবাহিত হয়েছে। তাই আরও কয়েকদিন দেখলে বোঝা যাবে সরকার দাম কার্যকর করতে পেরেছে কিনা।”

তিনি আরও বলেন, “অসাধুদের অনেক ছাড় দেওয়া হয়েছে। এবার আর ছাড় দেওয়া ঠিক হবে না। আলু ও পেঁয়াজ নিয়ে কারা কারসাজি করছে তা সবাই জানে। ডিমের দাম বাড়িয়ে কারা ভোক্তার পকেট কেটেছে তারও তথ্য সংশ্লিষ্টদের কাছে আছে। সরকারের উচিত ভোক্তার স্বার্থে অসাধু ব্যবসায়ীদের কঠোরভাবে দমন করা।”