ভেটেরিনারি হাসপাতাল

সরঞ্জাম আছে, নেই বিশেষজ্ঞ ডাক্তার

জাহিদ রাকিব প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১০, ২০২৩, ০৯:৩৬ পিএম
হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসা একটি বিদেশি প্রজাতির কুকুর। ছবি-সংবাদ প্রকাশ

কয়েকদিন বেশ উৎকণ্ঠায় কেটেছে পুরান ঢাকার ওয়ারি এলাকার বাসিন্দা হামিদুর রহমানের। তার পোষা বিদেশি কুকুর ক্যান্ডির হঠাৎ করেই জ্বর চলে আসে। চিকিৎসার জন্য কেন্দ্রীয় ভেটেরিনারি হাসপাতালে ক্যান্ডিকে নিয়ে আসেন তিনি। ক্যান্ডির অস্থিরতায় সকাল ৭টায় ডাক্তারের শরণাপন্ন হন হামিদুর রহমান।

তিনি সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “ক্যান্ডি আমার পরিবারের সদস্য। আমার দুই ছেলে যতটা আদরের, ক্যান্ডিও ঠিক ততটা আদরের। গত তিনদিন থেকে জ্বরে ভুগছে সে। তাই সকাল বেলায় হাসপাতালে নিয়ে আসি। ডাক্তার একটা ভ্যাকসিন দিয়ে দিছে। কিছু ওষুধ লিখে দিয়েছে। বললো ওষুধগুলো খাওয়ালে দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবে ক্যান্ডি।”

শুধু হামিদুর রহমান নন, তার মতো আরও অনেকেই প্রতিদিন পোষা প্রাণির চিকিৎসার জন্যে ছুটে আসেন রাজধানীর কেন্দ্রীয় ভেটেরিনারি এই হাসপাতালে।

কর্তৃপক্ষের নিবন্ধন তালিকা অনুযায়ী, এই হাসপাতালে প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ পশুর চিকিৎসা দেওয়া হয়। এর বাইরে আরও অর্ধশতাধিক পশুকে ফলোআপ চিকিৎসার জন্যে আনা হয়। হাসপাতালে আসা পশুপ্রেমীরা চিকিৎসা নিয়ে সন্তুষ্ট হলেও পর্যাপ্ত পরিমাণে ওষুধ সরবারহ নিয়ে অসন্তুষ্টি রয়েছে তাদের। 

কর্তৃপক্ষ বলছে, হাসপাতালে আসা রোগাক্রান্ত পশুগুলোকে আরও বেশি সেবা নিশ্চিত করতে হলে প্রয়োজন বিশেষজ্ঞ জনবল। এজন্য বাড়াতে হবে বৈদেশিক প্রশিক্ষণ।

সরজমিনে হাসপাতালে দেখা যায়, রাজধানীসহ আশেপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে পশুপ্রেমীরা তাদের পোষা কুকুর, বিড়াল, খরগোশ ও পাখি নিয়ে ভিড় জমিয়েছেন। হাসপাতালের চিকিৎসক সংকটের কারণে মাঝে মাঝেই ভিড় জমে যায়। এজন্য সেবা নিতে আসাদের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।

সরেজমিনে দেখা গেছে, হাসপাতালটির ভিতর-বাইরে পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। কিছুক্ষণ পরপর পশু চিকিৎসায় ব্যবহৃত জায়গাগুলো পরিস্কার করা হচ্ছে। 

রাজধানীর শেরেবাংলা কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী সাব্বির হোসেন। তার শখের পোষা বিড়ালটি তিনদিন ধরে খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। আদর করে নাম রেখেছেন মিকি। খাওয়া বন্ধ করে দেওয়ায় মিকিকে ভেটেরিনারি হাসপাতালে নিয়ে আসেন সাব্বির হোসেন।

সংবাদ প্রকাশকে তিনি বলেন, “হঠাৎ করে খাওয়া বন্ধ করে দেয় মিকি। বাসার কোণায় নিরিবিলি বসে থাকে। তাই আজ ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসার পর বললো খাবার হজমে সমস্যা তার। ডাক্তার বললো একটা ইনজেকশন দিয়ে দিলেই সুস্থ হয়ে আবার ঘর মাতাবে মিকি।”

হাসপাতালটির প্রধান ভেটেরিনারি অফিসারের রুমের ভিতর শখের পোষা বিড়াল আদরের লিয়াকে কোলে নিয়ে বসে আছে সাথি আক্তার। সঙ্গে আছে তার বড় সন্তানও। বাসায় লিয়ার মতো আর সাতটি বিড়াল আছে তাদের। লিয়ার চোখ দিয়ে গত কয়েকদিন ধরে পানি পড়ছে।

সংবাদ প্রকাশকে তিনি বলেন, “হাসপাতালে দীর্ঘদিন আসেন, চিকিৎসা ভালো। যার যার সমস্যা অনুযায়ী ডাক্তাররা দ্রুত চিকিৎসা দিয়ে দেয়।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর একুশে হল থেকে চোখে আঘাত পাওয়া একটি বিড়াল নিয়ে আসেন দুই শিক্ষার্থী। তারা সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “কোনোভাবে চোখে আঘাত পেয়েছে সে। ফোলা চোখ নিয়ে হলের রুমে রুমে ঘুরে বেড়াচ্ছিল বিড়ালটি। পরে চিকিৎসার জন্য বিড়ালটিকে হাসপাতালে নিয়ে আসি। চিকিৎসক বিড়ালের তাপমাত্রা পরীক্ষা করে একটি ইনজেকশন দেয়।”

তারা আরও বলেন, “আমরা চেয়েছিলাম বিড়ালটিকে হাসপাতালে রেখে যাইতে। কারণ, হলের বিড়ালটাকে দেখে রাখার কেউ নেই। ডাক্তাররা জানিয়েছে হাসপাতালে ভর্তির সুযোগ নেই। ডাক্তার বিড়ালের জন্য চোখের ড্রপ ও প্যারাসিটামল লিখে দিয়েছিলেন। হাসপাতালে তা পাওয়া যায়নি, বাইরে থেকে ক্রয় করতে হবে।”

কেন্দ্রীয় ভেটেরিনারি হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, এখানে গরু-মহিষ, ছাগল-ভেড়া, হাঁস-মুরগি, কুকুর-বিড়াল, কবুতরসহ অন্যান্য পশুপাখির চিকিৎসা দেওয়া হয়।

হাসপাতালটিতে ২০২০ সালে প্রায় ১৬ লাখের অধিক পশুকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। ২০২১ সালে ৩৪ লাখ , ২০২২ সালে  ৮২ লাখ, আর ২০২৩ সালের ৯ মাসে প্রায় ১১ লাখ পশুকে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া সব পশুপাখিকে প্রাথমিক চিকিৎসা থেকে শুরু করে শল্যচিকিৎসা, ময়নাতদন্ত, এক্স-রে, কুকুর-বিড়াল ও অন্যান্য পশুর টিকাদান ও  আলট্রাসনোগ্রাম করা হয়।

হাসপাতালের প্রধান ভেটেরিনারি অফিসার ডা. রেজাউল করিম সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “চিকিৎসা পেশাটি একটি চ্যালেঞ্জের। পশু চিকিৎসায় একটু বেশি চ্যালেঞ্জ। প্রতিনিয়ত তাদের আক্রমণের শিকার হতে হয় আমাদের। বিশেষ করে বাসা বাড়িতে পোষা বিড়াল, কুকুরের আক্রমণের শিকার হতে হয়। এইসব প্রাণী থেকে অনেক সময় ভাইরাস ও ভ্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে আমাদের।”

তিনি আরও বলেন, “সরকারের পক্ষ থেকে অন্যান্য  প্রাণির ভ্যাকসিন সরবারহ থাকলেও বিড়ালের কোনো ভ্যাকসিন সরবারহ নাই। বিড়ালের ভ্যাকসিন শুধুমাত্র স্কয়ার কোম্পানি উৎপাদন করে। বর্তমানে বাজারে অনেক ঘাটতি রয়েছে।” 

হাসপাতালটির পরিচালক ডা. আজিজ উল মামুন সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “দেশে কেউ শখ করে, আবার কেউ ব্যবসায়ীকভাবে পশুপালন করে। এই হার দ্রুত বাড়ছে। এই হাসপাতালে শুধু রাজধানী নয়, সারা দেশ থেকে পশুপাখি আসে উন্নত চিকিৎসার জন্য। কিন্তু আমাদের ডাক্তারসহ লোকবলের স্বল্পতা থাকায় যথাযথ সেবা দেওয়া যাচ্ছে না। এখানে ওষুধের অভাব থাকলেও চিকিৎসা সরঞ্জামের ঘাটতি নেই। অত্যাধুনিক ডিজিটাল এক্স-রে, আল্ট্রাসনোগ্রাফি, প্রাথমিক অস্ত্রোপচার, প্যাথলজিক্যাল ল্যাব প্রভৃতি রয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, “কেন্দ্রীয় হাসপাতাল হওয়ায় শহরের অনেক বিত্তশালী থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের পালা পশুপাখিও আসে। সকাল থেকেই মানুষ এখানে আসতে শুরু করেন। সকাল ৯টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত সেবা দিই। হাসপাতালের ভেতরে ডাক্তার, নার্স-স্টাফদের বাসা থাকায় জরুরিভাবে রাতে আসা পশুপাখিদের চিকিৎসা দেওয়া যায়। জনবল সংকট থাকলেও আমরা সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করি। বিদেশি পশুর আমদানি বেড়ে যাওয়ায় এখানকার চিকিৎসক ও স্টাফদের উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা প্রয়োজন। তাহলে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চাহিদা অনুযায়ী চিকিৎসাসেবা দেওয়া যাবে।”