বাঙালির সঙ্গে মিষ্টির সম্পর্ক সেই প্রাচীনকাল থেকে। খাওয়ার শেষ পাতে অথবা কোনো শুভ কাজে মিষ্টি ছাড়া অন্য কিছু কল্পনা করতে পারে না বাঙালিরা। এর যেন কোনো বিকল্প নেই। আর সে কারণে ভোজন রসিক বাঙালিকে ডায়াবেটিসের চোখরাঙানিও মিষ্টি থেকে দূরে রাখতে পারে না। তবে এই মিষ্টি-পাগল বাঙালির জন্য রয়েছে দুঃসংবাদ। নিত্যপণ্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মিষ্টির দাম।
রাজধানীর বিভিন্ন মিষ্টির দোকান ঘুরে জানা যায়, গত দুই মাসে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টিতে কেজি প্রতি দাম বেড়েছে ২০ থেকে ৮০ টাকা। চিনি, তেল, ময়দাসহ বিভিন্ন উপকরণের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় মিষ্টির দাম বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা।
তেজগাঁওয়ের বিখ্যাত মরনচাঁদ গ্র্যান্ড সন্স মিষ্টির দোকানে গিয়ে দেখা যায়, দুই মাস আগেও যেখানে রসগোল্লার দাম ছিল মাত্র ২৩০ টাকা, সেখানে এখন বিক্রি হচ্ছে ২৬০ টাকায়। এছাড়া লালমোহন, ছানা, চমচম, পান্তুয়া, কালোজাম, ল্যানচা, লাড্ডু, রাজভোগ, বালুসাই, কৃষ্ণভোগ, বেবি সুইটস, দই, রসমলাইসহ প্রতিটি মিষ্টির দাম ২০ থেকে ৩০ টাকা বাড়ানো হয়েছে।
মিষ্টি বিক্রেতাদের বক্তব্য
মিষ্টির দাম বাড়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে মরনচাঁদ গ্র্যান্ড সন্সের শাখা ম্যানেজার তপন চন্দ্র ঘোষ বলেন, “মিষ্টি তৈরিতে যেসব উপকরণ প্রয়োজন হয়, তার সবগুলোরই দাম বেড়েছে। আগে ৫০ কেজির চিনির বস্তা কিনতে লাগতো ২ হাজার ৪০০ টাকা, সেই চিনি এখন কিনতে হয় ৩ হাজার ৮০০ টাকা দিয়ে। এছাড়া ১ হাজার ২০০ টাকার ময়দার বস্তা এখন ১ হাজার ৮০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এছাড়া গত দেড় বছরে তেলের দাম বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। তাই বাধ্য হয়ে মিষ্টির দাম প্রকার ভেদে ২০—৩০ টাকা বাড়াতে হয়েছে।”
দাম বাড়ালেও ক্রেতাদের কাছে আগের দামে মিষ্টি বিক্রি করতে হচ্ছে বলে দুঃখপ্রকাশ করেন তপন চন্দ্র ঘোষ। তিনি বলেন, “করোনায় দীর্ঘ দিন দোকান বন্ধ থাকায় ব্যাপক লোকসান গুনতে হয়েছে। এখন আবার চিনি, তেল, ময়দার দাম বাড়ায় আমাদের ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে। ক্ষতি পোষাতে মিষ্টির দাম বাড়ালেও ক্রেতারা সেটি কিনতে চান না। তাই ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে নিরুপায় হয়েই আগের দামে মিষ্টি বিক্রি করতে হচ্ছে। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে আমাদের ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হবে।”
শুধু মরনচাঁদ নয়, মিষ্টির দাম বেড়েছে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোরও। প্রিমিয়ার সুইটস-এর মিষ্টির দাম বেড়েছে কেজিতে ৪০ থেকে ৮০ টাকা। প্রায় দুই মাস আগে মিষ্টির দাম বাড়িয়েছে ‘মিঠাই’। প্রতিষ্ঠানটি তাদের প্রতিটি মিষ্টির দাম কেজিতে ২৫ টাকা বাড়িয়েছে।
মিঠাইয়ের কারওয়ান বাজার শাখার ম্যানেজার আশরাফুল ইসলাম আরিফ বলেন, “দুই মাস আগে আমরা আমাদের মিষ্টির দাম বাড়িয়েছি। বর্তমানে চিনির দাম বাড়লেও কোম্পানি নতুন করে মিষ্টির দাম বাড়ায়নি। আমাদের এখানে সর্বনিম্ন ৩৭৫ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৬৭৫ টাকা পর্যন্ত মিষ্টি বিক্রি হয়। কোম্পানি যদি ভবিষ্যতে দাম বাড়ায়, তাহলে আমাদেরও বাড়তি দামে মিষ্টি বিক্রি করতে হবে।”
ক্রেতাদের কথা চিন্তা করে মিষ্টির দাম বাড়ায়নি ঢাকার ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি বিক্রির প্রতিষ্ঠান বিক্রমপুর মিষ্টান্ন ভাণ্ডারও। তবে মিষ্টি তৈরির উপকরণের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির কারণে তাদের উৎপাদন ও সরবরাহ কিছুটা কমেছে। যার কারণে ক্রেতারা অনেক সময় তাদের চাহিদা মতো মিষ্টি কিনতে পারছেন না।
বিক্রমপুর মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের পান্থপথ শাখার ম্যানেজার বলেন, “দুই বছর ধরে আমরা একই দামে মিষ্টি বিক্রি করে আসছি। মিষ্টি তৈরির উপকরণের দাম বাড়লেও ক্রেতাদের কথা চিন্তা করে কোম্পানি দাম বাড়ায়নি। তবে উৎপাদন ও খরচ কিছুটা কমেছে। যে কারণে অনেক মিষ্টিই এখন আর আসে না। কোম্পানি যদি নতুন করে আবার দাম বাড়ায়, তাহলে আমাদের সেই দামেই বিক্রি করতে হবে।”
ক্রেতা/ভোক্তাদের ক্ষোভ
ছেলেকে নিয়ে বিক্রমপুর মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে মিষ্টি কিনতে এসেছেন শওকত আলী ভূঁইয়া। মিষ্টির দাম বাড়ায় হতাশা প্রকাশ করে এই ব্যবসায়ী বলেন, “চিনির দাম বাড়ায়, মিষ্টির বাজারেও একটা বড় প্রভাব পড়েছে। প্রত্যেক প্রকার মিষ্টির কেজিতে দাম বেড়েছে ৪০—৫০ টাকা। বিক্রমপুর তাদের ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য দাম না বাড়ালেও অন্যান্য দোকানে দাম বেড়েছে।”
শওকত আলী ভূঁইয়া আরও বলেন, “এমনিতেই করোনার কারণে সাধারণ মানুষের আয় কমেছে। তার ওপর যদি নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে, তাহলে আমাদের খুব কষ্ট হয়ে যায়। কোনো অনুষ্ঠানে গেলে মিষ্টি তো সঙ্গে নিতেই হয়। সরকারের উচিত চিনি, দুধের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমানো। তাহলে ক্রেতা এবং বিক্রেতা সবার জন্যই ভালো হয়।”
নার্গিস নামের এক ক্রেতা বলেন, “শুধু চিনি নয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় সব কিছুর দামই বেড়েছে। যার কারণে বেড়েছে মিষ্টির দামও। এটাই স্বাভাবিক। ভোগান্তি শুধু আমাদের ক্রেতাদের। বাড়তি দামেই আমাদের সব কিছু কিনতে হয়।”
সরকারি নির্দেশনা মানছেন না চিনি বিক্রেতারা
সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম বাড়ার ফলে দেশের বাজারেও এর প্রভাব পড়ে। হু হু করে বাড়তে থাকে নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যটির দাম। এক মাসের ব্যবধানে কেজিতে ৮ থেকে ১২ টাকা বেড়ে চিনির দাম কেজিতে দাঁড়ায় ৮০ থেকে ৯০ টাকায়। এমন পরিস্থিতিতে বাজার স্থিতিশীল রাখতে চিনির দাম নির্ধারণ করে দেয় সরকার। খোলা চিনির সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করা হয় কেজি ৭৪ টাকা এবং প্যাকেট করা চিনির সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করা হয় কেজি ৭৫ টাকা। গত ৯ সেপ্টেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করে এই দাম নির্ধারণ করে বাংলাদেশ সুগার রিফাইনারস অ্যাসোসিয়েশন।
গত ১০ সেপ্টেম্বর থেকে সরকার নির্ধারিত মূল্যে চিনি বিক্রির নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে সেটি কার্যকর হয়নি। রাজধানীর কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা যায়, বর্তমানে প্রতি কেজি খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ৭৮ থেকে ৮০ টাকা এবং প্যাকেট করা বিভিন্ন ব্র্যান্ডের চিনি বিক্রি হচ্ছে ৮৪ থেকে ৮৫ টাকা। চিনির দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রতিনিয়ত মনিটরিং ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তারপরও চিনির ঊর্ধ্বগতি ঠেকানো যাচ্ছে না।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাইকারি বাজার থেকেই বাড়তি দামে চিনি কিনে আনতে হচ্ছে। তাই চাইলেও সরকার নির্ধারিত দামে চিনি বিক্রি করতে পারছেন না। অন্যদিকে পাইকারি বিক্রেতারা দোষ দিচ্ছেন মিল মালিকদের। তাদের দাবি, মিল গেট থেকে বাড়তি দামে চিনি কেনায় তাদেরও বাড়তি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
কারওয়ান বাজারের হাজী মিজান স্টোরের কর্মচারী জাকির বলেন, “এক মাস আগেও প্রতি কেজি চিনি বিক্রি করেছি ৭০ টাকা। এক মাসের ব্যবধানে চিনির দাম বেড়েছে ৭ থেকে ৮ টাকা। বস্তায় (৫০ কেজি) বেড়েছে ৪০০ টাকা। গত ছয় মাসের সঙ্গে যদি তুলনা করি তাহলে চিনির দাম কেজিতে বেড়েছে ১৭ থেকে ১৮ টাকা।”
সরকারের দাম নির্ধারণের পরও কেন বাড়তি দামে চিনি বিক্রি করছেন জানতে চাইলে জাকির বলেন, “সরকারের নির্ধারণ করে দেওয়া দামের চেয়ে দুই টাকা বেশি দামে আমাদের চিনি কিনতে হচ্ছে। প্রতি কেজি চিনিতে যদি দুই টাকা লাভ না করতে পারি, তাহলে আমরা কীভাবে পোষাবো? আমাদের তো দোকান ভাড়া, কর্মচারীর বেতন, প্যাকেটের খরচ আছে।”
আলী স্টোরের স্বত্বাধিকারী মো. আলী বলেন, “সরকার যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সেই দামে আমরা চিনি পাবো কোথায়? আমাদের তো পাইকারি দোকান থেকেই ৭৬—৭৭ টাকা কেজি দরে কিনে আনতে হয়। এরপর আমাদের এক টাকা লাভে ৭৮ টাকা বিক্রি করতে হয়। এর নিচে বিক্রির সুযোগ নেই। অথচ ম্যাজিস্ট্রেট এসে আমাদের জরিমানা করে।”
অন্যান্য নিত্যপণ্যের দামের বিষয়ে তিনি বলেন, “মাসখানেক আগেও খোলা ময়দা বিক্রি করেছি ৩০—৩২ টাকা। এখন বিক্রি করতে হয় ৩৭—৩৮ টাকা। তেলের দামও বেশি। আগে যেই তেল প্রতি লিটার বিক্রি করতাম ১০০ টাকার কম, সেই তেল এখন বিক্রি করি ১৩২ টাকা লিটার। ক্রেতারা এসে আমাদের সঙ্গে দাম নিয়ে বাকবিতণ্ডায় জড়ান। কিন্তু আমাদের কিছুই করার নেই। সরকারের উচিত মিল ও পাইকারি পর্যায়ে দাম নিয়ন্ত্রণ করা। তাহলে খুচরা বাজারেও দাম নিয়ন্ত্রণে থাকবে।”
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যা বলল
সরকারের নির্ধারণের পরও বাজারে চিনির দাম কেন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না—জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, “চিনির দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতিদিন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মনিটরিং টিম বাজারে যাচ্ছে। জেলা প্রশাসন থেকে দেশব্যাপী বাজার পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। কেউ নির্ধারিত দামে চিনি বিক্রি না করলে তাদের জরিমানা করা হচ্ছে। তারপরও কোথাও কোনো কমতি থাকলে আমরা আমাদের পর্যবেক্ষণ জোরদার করবো।”
তপন কান্তি ঘোষ আরো বলেন, “চিনির দাম নিয়ন্ত্রণে ক্রেতাদেরও ভূমিকা রয়েছে। তারা বাড়তি দামে চিনি না কিনলেই দাম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। এক দোকানে সরকার নির্ধারিত দামে চিনি না পেলে অন্য দোকানে যেতে হবে।”
নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য পণ্যের ঊর্ধ্বগতির বিষয়ে তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির জন্য তেলসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে সরকার থেকে সেগুলোর দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।”