রাজধানীর শাহ আলী এলাকায় বাসু হত্যা মামলার প্রধান আসামি মো. আলকেসকে (৫২) গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
শুক্রবার (২৩ সেপ্টেম্বর) রাতে বরিশাল মহানগরী এলাকা থেকে র্যাব-৪-এর একটি আভিযানিক দল তাকে গ্রেপ্তার করে।
র্যাব জানায়, গত ১২ বছর ধরে আসামি আলকেস ঠিকানা পরিবর্তন করে বিভিন্ন ছদ্মবেশ ধারণ করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় আত্মগোপনে ছিল। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় আসামি নিজের পরিচয় গোপন করার জন্য ক্রমাগতভাবে পেশা পরিবর্তন করে আসছিল। প্রথম দিকে তিনি সাভারের বিভিন্ন এলাকায় শ্রমিকের কাজের পাশাপাশি হত্যা, ডাকাতি করত। পরবর্তী সময়ে বরিশালে ট্রাকের হেল্পার ও পরে ড্রাইভার হিসেবে কাজ করেন। বেপরোয়াভাবে বাস চালানের সময় সিলেটে তার বাসের নিচে পরে একজন নির্মভাবে নিহত হয়। এ ঘটনায় সিলেটের ওসমানীনগর থানায় পরিবহন আইনে ৮৭/১০৫ ধারায় তার বিরুদ্ধে পুনরায় হত্যা মামলা হলে তিনি পালিয়ে কুয়াকাটা মাছ ধরার ট্রলারে কাজ শুরু করেন।
জিজ্ঞাসাবাদে তিনি মাছ ধরার পাশাপাশি সাগরে বিভিন্ন ট্রলারে ডাকাতি করত বলে স্বীকার করেছেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি একজন অভ্যাসগত কুখ্যাত অপরাধী। গ্রেপ্তারের আগ পর্যন্ত আসামি আলকেস গত দেড় বছর ধরে একটি দূরপাল্লার পরিবহনের ড্রাইভার হিসেবে কাজ করে আসছিল।
শনিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) দুপুর ১২টায় রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-৪-এর অধিনায়ক (সিও) ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক এসব কথা বলেন।
ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক বলেন, “গ্রেপ্তার আসামি মো. আলকেস, মামলার বাদী চিনু মিয়া ও ভিকটিম বাসু মিয়া (৪৮) একই এলাকার বাসিন্দা। মামলার বাদী চিনু মিয়া, বাসু মিয়ার আপন ছোট ভাই। গ্রেপ্তার আসামি রাজধানীর শাহ আলী থানাধীন চটবাড়ী নবাবেরবাগ এলাকার ২০০ সদস্যবিশিষ্ট একটি মৎস্যজীবী সমিতির সদস্য। বাসু মিয়া ও বাদী চিনু মিয়ার চটবাড়ী এলাকায় ১০ শতাংশের একটি পৈতৃক দখলীয় সম্পত্তি ছিল। জমিটি মৎসজীবী সমিতির কাছে বাৎসরিক ভিত্তিতে লিজ দেওয়া ছিল। কিন্তু একসময় আসামি আজগর আলী প্রতারণামূলক জাল দলিল করে নিজের নামে নিয়ে নেয় এবং পরবর্তী সময়ে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে ২০১০ সালে সমিতির নামে হস্তান্তর করে।”
তিনি বলেন, “এতে করে এই জমি মালিকানা নিয়ে মামলার বাদী চিনু মিয়া এবং বাসু মিয়ার সঙ্গে মৎস্যজীবী সমিতির বিরোধ সৃষ্টি হয়। জমিটির প্রকৃতপক্ষে মূল মালিক চিনু মিয়া ও বাসু মিয়া। সমিতির লোকজনের সংখ্যা বেশি হওয়ায় তারা অর্থাৎ এই মামলার আসামি আলকেসসহ অন্যান্য আসামি আজগর, গিয়াস উদ্দিন, সানু মিয়া, জিন্নাত, রুমা, কদর আলীদের নেতৃত্বে সমিতির নামে রাখা জমি জোরপূর্বক দখল করে জায়গাটিতে সীমানাপ্রাচীর তৈরি করে ফেলে। তখন চিনু মিয়া ও বাসু মিয়া আসামিদের সঙ্গে বিরোধে না জড়িয়ে বিজ্ঞ সিভিল আদালতে মামলা করার পর প্রায় দুই বছর পর বিজ্ঞ আদালত চিনু মিয়া ও বাসু মিয়ার পক্ষে রায় প্রদান করেন। পরবর্তী সময়ে মামলার বাদী এবং ভিকটিম বিজ্ঞ আদালতের রায় পেয়ে উক্ত জমিতে ২০১২ সালের শুরুতে বিল্ডিং নির্মাণ করা শুরু করে প্রথম তলার ছাদ পর্যন্ত নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ হয়।”
র্যাব-৪-এর অধিনায়ক বলেন, “ঘটনার দিন ২০১২ সালের ১৪ মে বিকেল ৫টায় বাসু নবনির্মিত বিল্ডিংয়ের ছাদে পানি দেওয়ার জন্য একজন কর্মচারী নিয়ে যায়। তখন সমিতির সদস্যরা অর্থাৎ এই মামলার এজাহারনামীয় আসামি আলকেস, আজগর, রাজু, খলিল, সেলিম, কদর আলী, লেদুসহ অজ্ঞাতনামা আরও ৬-৭ জন আগ্নেয়াস্ত্র, দেশীয় ধারালো অস্ত্র ও লোহার রড নিয়ে আক্রমণ করে। একপর্যায়ে আলকেস তার কাছে থাকা অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র দ্বারা কয়েক রাউন্ড গুলি করলে বাসুর মাথার বাঁ পাশে লেগে ডান পাশ দিয়ে বের হয়ে গেলে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। এই ঘটনায় ভিকটিমের ভাই চিন্নু মিয়া আসামি আলকেসসহ ১৩ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা আরও ৬-৭ জন আসামির বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগরীর শাহ আলী থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।”
ডিআইজি বলেন, “ঘটনার পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে আলকেসসহ অধিকাংশ আসামিদের পুলিশ গ্রেপ্তার করে কারাগারে প্রেরণ করে। পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন আসামি আলকেস নিজেকে সম্পৃক্ত করে অন্যান্য আসামির নাম উল্লেখপূর্বক বিজ্ঞ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেন। কিন্তু আসামিরা চার মাস কারাভোগের পর জামিনে মুক্তি পেলে অন্যান্য আসামিরা আদালতে হাজিরা দিলেও আলকেস জামিন নিয়ে আত্মগোপনে চলে যায় এবং এই মামলায় আর কখনো হাজিরা দেয়নি।”
মো. মোজাম্মেল হক বলেন, “মামলাটি তদন্ত করে বিজ্ঞ আদালতে এজাহারনামীয় ১৩ জন এবং তদন্তে প্রাপ্ত ১ জনসহ মোট ১৪ জনের নামে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। বিজ্ঞ আদালত পর্যাপ্ত স্বাক্ষ্য প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে বিচারকার্য পরিচালনা করে গত বছরের ১৫ নভেম্বর আসামি মো. আলকেস, আজগর আলী, খলিল, সেলিম ও রাজুসহ মোট ৫ জন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড, আসামি কদর আলী ও লেদুকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেন। জামিনে থাকা অবস্থায় গ্রেপ্তার আলকেস গংয়ের আসামি আজাহার ও সানুর মতবিরোধ সৃষ্টি হওয়ায় আলকেসের দ্বারা আজাহার ও সানু নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। এই ডবল মার্ডারের মূল আসামি মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আলকেস।”
তিনি বলেন, “এ ঘটনায় আসামি মো. আলকেসের বিরুদ্ধে আরও একটি হত্যা মামলা বিজ্ঞ আদালতে বিচারাধীন এবং তার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট পেন্ডিং আছে। যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি কদর আলী হাজতে থাকা অবস্থায় স্টোক করে মারা যায় এবং অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় বিজ্ঞ আদালত আসামি নসু, জিন্নাত, গিয়াস, সালেম উদ্দিন এবং রুমাসহ মোট ৫ জনকে খালাস প্রদান করেন।”
গ্রেপ্তার আসামিকে সংশ্লিষ্ট থানায় হস্তান্তর কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানান র্যাবের এ কর্মকর্তা।