‘স্ত্রীকে ভালোবাসি বলেই রাতে হাসপাতালের বারান্দায় ঘুমাই’

আবদুল্লাহ আল মামুন প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৮, ২০২২, ০৪:১৬ পিএম

মো. ইয়াকুব মিয়া (৫২)। তার স্ত্রী রাজিয়া বেগম (৪৫)। দুইজনের ৩৪ বছরের সংসার। এই দম্পতির দুই মেয়ে ও এক ছেলে। বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জে। আট দিন হলো ইয়াকুব মিয়া তার স্ত্রীকে নিয়ে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) আছেন। রাজিয়া বেগমের ব্রেন টিউমার। ১৬ বছর আগে ২০০৬ সালে এই হাসপাতালেই অপারেশন করে সুস্থ হয়েছিলেন তিনি। এরপর এখন আবার সেই টিউমার দেখা দিয়েছে।

ইয়াকুব মিয়ার সঙ্গে কথা হলে তিনি সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “এত বছর কিছু ওষুধ খাওয়ার মাধ্যমে সুস্থ ছিল রাজিয়া। পরে যখন সমস্যা বেশি দেখা দেয় তখন প্রথমে ধানমন্ডির পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা করার পর রিপোর্ট দেখে ডাক্তাররা বলেন, তার ব্রেন টিউমার হয়েছে। এই কথা শুনে সেখান থেকে চলে আসি। ভালোভাবে জানার জন্য বর্তমানে পিজিতে (বিএসএমএমইউ) মঙ্গলবার (১ সেপ্টেম্বর) স্ত্রীকে নিয়ে এসে ভর্তি করি। এখানেও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডাক্তার জানালেন, তার আসলেই ব্রেন টিউমার হয়েছে। এর আগেও একবার এই হাসপাতালেই অপারেশন করিয়েছিলাম। এখন আবার ডাক্তাররা বলছেন তাকে অপারেশন করাতে হবে। বর্তমানে রাজিয়াকে ১০-১২টি বিভিন্ন পরীক্ষা করানো হয়েছে।”

চিকিৎসার খরচ কেমন হচ্ছে, এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আগে যখন অপারেশন করিয়েছিলাম, তখন কোনো টাকা লাগেনি। শুধু পরীক্ষা এবং ওষুধের টাকা লাগছে। ডাক্তার বললেন এখনো শুধু পরীক্ষা ও ওষুধের টাকাটাই লাগবে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আনার পর রাজিয়ার অপারেশন করা হবে। আমি একজন মুদিদোকানদার। যদি অপারেশন করতে টাকা লাগত, তাহলে আমার জন্য অনেক সমস্যা হয়ে যেত।”

হাসপাতালে রোগীর সঙ্গে শুধু একজন নারী থাকতে পারে উল্লেখ করে ইয়াকুব মিয়া বলেন, “এই হাসপাতালেই শুধু না, সরকারি-বেসরকারি অনেক জায়গায়ই নারী রোগীর সঙ্গে শুধু একজন নারীই থাকতে পারেন। এখানে তো আর কিছু করার নেই। তাই রাত হলে হাসপাতালের কোনো এক বারান্দায় শুয়ে রাত কাটিয়ে দিই। স্ত্রীকে ভালোবাসি বলেই হয়তোবা এতটা কষ্ট সহ্য করতে পারি।”

বৃহস্পতিবার (৮ সেপ্টেম্বর) সরেজমিনে দেখা যায়, বিএসএমএমইউতে চিকিৎসাসেবা নিতে দূরদূরান্ত থেকে অনেক মানুষের দীর্ঘ লাইন। বহির্বিভাগে তাদের প্রায় সবার হাতে চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন, এক্স-রে, সিটিস্ক্যান, এমআরআই কিংবা বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষাসংক্রান্ত রিপোর্টের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। অনেকে মেডিসিন, হেমাটোলজি, পেডিয়াট্রিক, নিউরোলজি বিভাগে চিকিৎসাসেবা নিতে এসেছেন।

কেউ ডাক্তার দেখাতে আসছেন। আবার কারও রোগী হাসপাতালে ভর্তি। ২০ টাকার বিনিময়ে সকাল থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ডাক্তার দেখানো যাবে। তবে দুপুর ২টা থেকে ২০০ টাকার টিকিটের বিনিময়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ (বৈকালিক চিকিৎসাসেবা) পেতে প্রতিদিনই থাকে লম্বা লাইন। সে ক্ষেত্রে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ডাক্তার দেখানো যায়।

কুমিল্লা থেকে আসা এক রোগীর ভাই আমানউল্লাহর সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, “পাঁচ বছর আগে এই পিজি হাসপাতালে আমার বোন মাহিয়া মাহিকে (১৫) চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসছিলাম। কোমরে তখন টিউমারের মতো সমস্যা ছিল। তখন ওষুধ দিয়ে বিষাক্ত পানি বের করেছিল ডাক্তাররা। কিন্তু কয়েক বছর ভালো থাকার পর সেই জায়গাতে একই সমস্যা দেখা দিয়েছে। তাই প্রথমে রাজধানীর শ্যামলীতে ডিপিআরসি হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক ল্যাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানোর পর এখানে আবার রিপোর্টগুলো ডাক্তারকে দেখানোর জন্য আসছি। রোগী ছাড়া রিপোর্ট দেখা যাবে না, তাই বোনকে নিয়ে এসে দেখাতে হবে।”

আরেক রোগী মাহদী হাসানের পা মচকে গেছে। তাই ডাক্তার দেখাতে এসেছেন। তিনি বলেন, “অর্থোপেডিক ডাক্তার দেখিয়েছি। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডাক্তারকে আবার রিপোর্ট দেখাতে হবে।”

হাসপাতালের ‘সি’ ব্লকের নিচতলার ১২২ নম্বর কক্ষে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা/তাঁদের পরিবারবর্গের চিকিৎসা সেল’। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যরা সেবা নিতে এসেছেন। সেখানে কথা হয় কয়েকজনের সঙ্গে। তাঁরা বলেন, একজন সেবা নিয়ে যাওয়ার পর তিনি অন্যদের জানান। আবার অনেকে হাসপাতালে ভর্তি হতে এসে চিকিৎসা সেলের সন্ধান পান। অনেকে চিকিৎসা বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পেছনে টাকা খরচ করার পর জানতে পারেন এই সেলের কথা।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, এই সেলে চিকিৎসাসেবা পেতে মুক্তিযোদ্ধা সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র ও জন্মনিবন্ধন সনদের অনুলিপি জমা দিতে হয়। সকাল আটটা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত চিকিৎসা সেল থেকে কাগজপত্র বুঝে নিতে হয়। সেল থেকেই বলে দেওয়া হয়, রোগীকে কোথায়, কার কাছে যেতে হবে।