সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জের ধামাইনগর ইউনিয়নের ধামাইনগর গ্রামের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র রাশিদুল ইসলাম হত্যা মামলায় ৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
পিবিআই জানায়, আসামিরা সংঘবদ্ধ চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইকারী দলের সক্রিয় সদস্য। তারা বিভিন্ন এলাকায় স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে যাত্রীবেশে ভ্যান, অটোরিকশা, সিএনজি ভাড়া করে সুবিধাজনক স্থানে চালকদের হত্যা করে সেগুলো নিয়ে যেত। আদালতে তারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে স্বেচ্ছায় ১৬৪ ধারা মোতাবেক জবানবন্দি দিয়েছেন।
গ্রেপ্তাররা হলেন, মো. হাসেন নবী ওরফে নুর নবী (৩০), মো. আ. কালাম (৩৩), মো. ফরিদুল ইসলাম (৩৩) ও মোছা. সুকিতন খাতুন ওরফে সুখী খাতুন (৪৮)।
সিরাজগঞ্জ জেলার পিবিআই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক (এসআই) ইমরান হোছাইন ও তদন্ত তদারকী কর্মকর্তা পুলিশ সুপার রেজাউল করিমের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
সেদিন যা ঘটেছিল
গত ১৯ মে সকাল ৭টায় রাশিদুল ইসলাম (১৪) সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জের ধামাইনগরে তার ভাইয়ের অটোভ্যান নিয়ে স্ট্যান্ডে যায়। এরপর বাড়িতে ফিরে না আসায় বিকাল ৫টার দিকে তার ভাই মো. তারিফুল ইসলাম তাকে ফোন করে মোবাইল ফোন বন্ধ পায়। খোঁজাখুঁজি করে রাশিদুল ইসলামকে না পাওয়ায় ২০ মে রায়গঞ্জ থানায় একটি হারানো জিডি করেন (জিডি নং-৯৯২)।
খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে ২৪ মে দুপুর সোয়া দুইটায় জানতে পারেন যে, সলঙ্গা থানাধীন ইছলাদিঘর গ্রামস্থ জনৈক অচিন্ত তালুকদারের বাঁশঝাড়ের ভেতরে গলায় গামছা পেঁচানো গাছের সঙ্গে বাঁধা অবস্থায় একটি অর্ধগলিত লাশ পাওয়া গেছে। খবরটি পেয়ে তারিফুল ইসলাম বিকাল ৩টার দিকে ঘটনাস্থলে গিয়ে অর্ধগলিত লাশের পাশে পড়ে থাকা পায়ের সেন্ডেল এবং পরনের গেঞ্জি ও পরিহিত কালো প্যান্ট দেখে তার ভাইকে শনাক্ত করেন।
সলঙ্গা থানা পুলিশ ভিকটিমের লাশের সুরতহাল প্রস্তুতপূর্বক লাশ ময়নাতদন্তের ব্যবস্থা করেন। অজ্ঞাতনামা আসামিরা পরিকল্পিতভাবে রাশিদুল ইসলামকে হত্যা করে অটোভ্যান ও তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন নিয়ে যায়। ভিকটিমের লাশ গোপন করার উদ্দেশে দুষ্কৃতিকারীরা সলঙ্গা থানাধীন ইছলাদিঘর গ্রামস্থ জনৈক অচিন্ত তালুকদারের বাঁশঝাড়ের দক্ষিণ পার্শ্বে গলায় গামছা পেঁচিয়ে পিপলটি গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে কৌশলে পালিয়ে যায়।
এ ঘটনায় ভিকটিম রাশিদুল ইসলামের ভাই মো. তারিফুল ইসলাম বাদী হয়ে রায়গঞ্জ থানায় একটি মামলা করেন। রায়গঞ্জ থানা পুলিশের পাশাপাশি পিবিআই সিরাজগঞ্জ জেলা টিম হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে ছায়া তদন্ত করতে থাকে। একপর্যায়ে রায়গঞ্জ থানা পুলিশ ঘটনার সঙ্গে জড়িত মো. জাহিদুল ইসলাম (৪১) ও মো. আ. লতিফকে (৩৪) গ্রেপ্তার করে এবং তাদের কাছ থেকে ভিকটিমের অটোভ্যানটি জব্দ করে। পরবর্তীতে মামলার বাদীর আবেদনের প্রেক্ষিতে বিজ্ঞ আদালতের নির্দেশে মামলাটির তদন্তভার পিবিআই সিরাজগঞ্জ জেলা গ্রহণ করে।
যেভাবে গ্রেপ্তার করা হয় আসামিদের
তদন্ত চলাকালে গত ৩০ আগস্ট রায়গঞ্জ থানা পুলিশ মো. হাসেন নবী নুরুন নবীকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পিবিআই ও থানা পুলিশের যৌথ প্রচেষ্টায় আসামি মো. আ. কালাম (৩৩) ও মো. ফরিদুল ইসলামকে (৩৩) আটকপূর্বক জিজ্ঞাসাবাদ করে পিবিআই।
আসামিদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী গত ৩১ আগস্ট পাবনা জেলার আমিনপুর থানাধীন চকভরিয়া গ্রামের মো. সামসুল মোল্লার কাছ থেকে মোবাইলটি জব্দ করাসহ ঘটনার সঙ্গে জড়িত অপর আসামি মোছা. সুকিতন খাতুন ওরফে সুখী খাতুনকে (৪৮) গ্রেপ্তার করা হয়। আরও এক আসামি পলাতক আছে, তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত আছে।
যেভাবে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল চক্রটি
ঘটনার আগের দিন গত ১৮ মে ভূইয়াগাঁতী বাজারে চায়ের দোকানে বসে আসামিরা পরিকল্পনা করে তারা একটি অটোভ্যান ছিনতাই করে তা বিক্রি করে টাকা সমানভাবে ভাগ করে নিবে। সেই পরিকল্পনা মোতাবেক ঘটনার দিন (১৯ মে) সকাল ৭টা বা ৮টার দিকে আসামি কালাম ধামাইনগর বাজারে গিয়ে ভিকটিম রাশিদুলের (১৪) অটোভ্যানটি সলঙ্গা থানাধীন ভূইয়াগাঁতী বাজারে যাওয়ার জন্য ভাড়া করে। আসামি কালাম অপর আসামি হাসেন নবীকে তাদের দলের অপর মহিলা সদস্য মোছা. সুকিতন খাতুন ওরফে সুখী খাতুনকে নিয়ে নিমগাছি মাহিলা ডিগ্রি কলেজের কাছে থাকতে বলে।
সেই মোতাবেক আসামি হাসেন নবী আসামি সুকিতন খাতুন ওরফে সুখী খাতুনকে নিয়ে পূর্ব থেকে অবস্থান করতে থাকে। আসামি কালাম নিমগাছি মহিলা ডিগ্রী কলেজের নিকট আসলে পরিকল্পনা মোতাবেক আসামি হাসেন নবী আসামী সুকিতন খাতুনকে অটোভ্যানে কালামের স্ত্রী হিসাবে তুলে দেয়। যাতে ভিকটিম ও লোকজন বুঝতে পারে তারা স্বামী-স্ত্রী। আসামি কালাম অপর আসামি হাসেন নবীকে অচিন্ত তালুকদারের বাঁশঝাড়ে যেতে বলে। আসামি হাসেন নবী তার ভাড়া করা মোটরসাইকেল নিয়ে অচিন্ত তালুকদারের বাঁশঝাড়ে যাওয়ার জন্য রওনা করে।
আসামী কালাম এবং সুকিতন খাতুন ভুইয়াগাঁতীতে স্থানীয় গ্রামীণ ব্যাংকের কাছে এলে পূর্ব থেকে অপেক্ষমান আসামি ফরিদুল এবং অপর আসামি অটোভ্যানে উঠে অচিন্ত তালুকদারে বাঁশঝাড়ের নিকট আসে। আসামি কালাম ভিকটিম রাশিদুল ইসলামকে ভ্যান থেকে নামতে বলে। ইতোমধ্যে আসামি হাসেন নবী সেখানে এসে উপস্থিত হয় এবং ভিকটিম রাশিদুল ইসলামকে বাঁশের লাঠি দিয়ে স্বজোড়ে মাথায় আঘাত করে। আসামি ফরিদুল ভিকটিমের বুকে কিল ঘুষি মারতে থাকে। আসামি কালাম এবং অপর পলাতক আসামি ভিকটিমের গলায় গামছা মোড়ন দিয়ে ভিকটিম রাশিদুল ইসলামকে অচিন্ত তালুকদারের বাঁশঝাড়ের মধ্যে নিয়ে যায়।
আসামি ফরিদুল ভিকটিমের হাত চেপে ধরে রাখে এবং আসামি হাসেন নবী এবং সুকিতন খাতুন ভিকটিমের পা চেপে ধরে রাখে। আসামিরা ভিকটিমের মৃত্যু নিশ্চিত করে আসামি হাসেন নবী ও কালাম ভিকটিমের অটোভ্যানটি বিক্রি করার উদ্দেশে চলে যায়। বাকি আসামিরা ভিকটিমের লাশ বাঁশ ঝাড়ের মধ্যে পিপলটি গাছের সঙ্গে গলায় গামছা দিয়ে বেঁধে রেখে চলে যায়।