বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খুনিদের পক্ষে ছিল গণমাধ্যম

শাহাদাত হোসেন তৌহিদ প্রকাশিত: আগস্ট ১৪, ২০২১, ০৬:২৫ পিএম

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যার পর বিদেশি গণমাধ্যমগুলো ফলাও করে খবর প্রচার করলেও দেশের গণমাধ্যমগুলো যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের খবর প্রকাশ তো দূরের কথা, অবৈধভাবে দখল করা নতুন সরকার খন্দকার মোশতাক আহমেদের গুণগান করেছিল। এমনকি ছাপা পত্রিকাগুলো বিতরণ করতেও দেওয়া হয়নি।

বঙ্গবন্ধুতে হত্যার পরপরই ক্ষমতায় বসেন খন্দকার মোশতাক। জারি করা হয় সামরিক আইন। দশ দিনের মাথায় জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করেন মোশতাক। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বন্ধ করে দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের পথ। অথচ সে সময়কার প্রথম সারির পত্রিকাগুলোর শিরোনাম ছিল খন্দকার মোশতাকের ক্ষমতার গ্রহণের খবরাখবর। এড়িয়ে যাওয়া হয় বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পুরো বিষয়টি।

তৎকালীন বাংলাদেশের প্রথম সারির ৪টি দৈনিকের মধ্যে রয়েছে—দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, দ্য বাংলাদেশ অবজারভার, দ্য বাংলাদেশ টাইমস। পত্রিকার শিরোনামগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৫ আগস্টের আগে প্রতিদিনই পত্রিকাগুলোর প্রথম পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু ও তার রাষ্ট্র পরিচালনার খবারখবর প্রচার হতো। ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সব কটি দৈনিকই বিষয়টি এড়িয়ে গিয়েছিল।

বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম সারির ৪টি দৈনিকের শিরোনাম :

যে চারটি দৈনিকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবরটি কোনো পত্রিকায় প্রধান শিরোনামে আসেনি। কোনো কোনো খবরে খন্দকার মোশতাকের নতুন সরকারের গুণগান করতেও দেখা যায়। চাপা পড়ে সেনা অভ্যুত্থান ও অবৈধ ক্ষমতা দখলের খবর। 

বাংলা একাডেমির গ্রন্থাগার বিভাগে ডকুমেন্ট হিসেবে ওই সময়কার ৪টি দৈনিক সংবাদ প্রকাশের পক্ষ থেকে পর্যালোচনা করা হয়। স্বাধীনতার আগে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া সম্পাদিত যে ইত্তেফাককে আওয়ামী লীগের মুখপাত্র মনে করা হতো, বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ায় সেই পত্রিকাটি মোড় নিয়েছিলে বিপরীত মুখে।

১৬ আগস্ট তৎকালীন ৪টি দৈনিকের শিরোনাম :

দৈনিক ইত্তেফাকের শিরোনাম ছিল—“খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনীর  শাসনক্ষমতা গ্রহণ।” শোল্ডারে লেখা ছিল— “দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি উচ্ছেদ।। সুবিচার ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ঘোষণা।”

দৈনিক বাংলার প্রধান প্রতিবেদনে সবগুলো কলাম জুড়ে শিরোনাম ছিল— “খোন্দকার মুশতাক নয়া রাষ্ট্রপতি’। শোল্ডারে লেখা ছিল “শেখ মুজিব নিহত : সামরিক আইন ও সান্ধ্য আইন জারি : সশস্ত্র বাহিনীসমূহের আনুগত্য প্রকাশ।”

দ্য বাংলাদেশ অবজারভারের প্রধান শিরোনাম ছিল— “মোশতাক বিকাম প্রেসিডেন্ট। মুজিব কিলড, সিচ্যুয়েশান রিমেইনস কাম। অর্থাৎ, মোশতাক রাষ্ট্রপতি হয়েছেন, শেখ মুজিব নিহত, পরিস্থিতি স্বাভাবিক। শোল্ডারে লেখা ছিল, ‘মার্শাল ল প্রক্লেইমড ইন দ্য কান্ট্রি : মুজিব কিলড।”

আব্দুল গনি হাজারি সম্পাদিত দ্য বাংলাদেশ টাইমসের প্রধান শিরোনাম ছিল—“মোশতাক এসেম প্রেসিডেন্সি।” শোল্ডারে লেখা ছিল, “মার্শাল ল প্রক্লেইমড ইন দ্য কান্ট্রি : মুজিব কিলড। ” 

১৭ আগস্ট ৪টি দৈনিকের শিরোনাম :

দৈনিক ইত্তেফাকের শিরোনাম ছিল—“সৌদি আরব ও সুদানের স্বীকৃতি।” শোল্ডারে লেখা ছিল, “রাষ্ট্রপতি মোশতাকের প্রতি বাদশাহ খালেদ ও প্রেসিডেন্ট নিমেরীর অভিনন্দন।”

দৈনিক বাংলার শিরোনাম ছিল—“সৌদি আরব ও সুদানের স্বীকৃতি।” শোল্ডারে লেখা ছিল, “নয়া সরকারের সাথে বাদশাহ খালেদের ইসলামী সংহতি প্রকাশ।”

দ্য বাংলাদেশ অবজারভারের প্রধান শিরোনাম সেদিন ছিল—“সৌদি আরব, সুদান রিকোগনাইজ বাংলাদেশ।” অর্থাৎ, সৌদি ও সুদানের স্বীকৃতি।

আগস্ট দ্য বাংলাদেশ টাইমসের প্রধান শিরোনাম ছিল—“সৌদি আরাবিয়া, সুদান একোরড রিকোগনেশন”। শোল্ডারে লেখা ছিল, “কিং খালিদ নিমেরী কনগ্রেজুলেটস মোশতাক।”

১৮ আগস্ট ৪ দৈনিকের শিরোনাম :

দৈনিক ইত্তেফাকের শিরোনাম ছিল—“সততা ও নিষ্ঠার সহিত কাজ করুন : রাষ্ট্রপতি।”

দৈনিক বাংলার শিরোনাম ছিল—“নিষ্ঠার সাথে প্রত্যেককে দায়িত্ব পালন করতে হবে।” শোল্ডারে লেখা ছিল, “অফিসের কাজে অনিয়ম অবহেলা বরদাস্ত করা হবে না : রাষ্ট্রপতির আদেশ।”

দ্য বাংলাদেশ অবজারভারের প্রধান শিরোনাম ছিল—“সিচ্যুয়েশান নরমাল, ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল একটিভিটিস ইনকারেজিং।”, “পরিস্থিতি শান্ত, শিল্প কারখানা চলমান।”

দ্য বাংলাদেশ টাইমসের প্রধান শিরোনাম ছিল—“সিচ্যুয়েশান নরমাল অল ওভার কান্ট্রি। শোল্ডারে লেখা, “ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল একটিভিটিস রিজিউম।”

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো খুনিদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল উল্লেখ করে একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক জাফর ওয়াজেদ সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর গণমাধ্যম খুনিদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। ইত্তেফাকের শিরোনাম ছিল, মোশতাকের নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণ। অথচ শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে এবং মোশতাকের ক্ষমতা গ্রহণ অবৈধ, এই বিষয়গুলি কোনো গণমাধ্যম তুলে ধরেনি। রাষ্ট্রপতির অবর্তমানে আইন অনুযায়ী তো প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব নিতেন। সেখানে মোশতাক কোনোভাবেই ক্ষমতা নেওয়ার কথা না।”

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক শেখ আদনান ফাহাদ সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পরদিন থেকেই সেই সময়কার মূলধারার গণমাধ্যমগুলো ইউটার্ন নিয়ে সম্পূর্ণভাবে বিপরীত অবস্থান নিয়ে নিয়েছে। খুনিদের মতো করে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থকেই সমুন্নত রাখে। জাতির পিতা হত্যাকাণ্ড পরবর্তী যে সাহসী, দায়িত্বশীল, মুক্ত সাংবাদিকতা আমরা প্রত্যাশা করছিলাম সেটা আমরা পাইনি।”

বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে এক শ্রেণির গণমাধ্যম দায়িত্বজ্ঞানহীন ভূমিকা পালন করেছে উল্লেখ করে শেখ আদনান ফাহাদ আরো বলেন, “আমি সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ও সচেতন নাগরিক হিসেবে মনে করি, বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে ওই সময়কার এক শ্রেণির গণমাধ্যম দায়িত্বজ্ঞানহীন ভূমিকা পালন করেছে। ’৭২ সালের ১৬ জুলাই জাতীয় প্রেস ক্লাবে বঙ্গবন্ধু একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু আমরা দেখছি বাংলাদেশে অপসাংবাদিকতার চর্চা ওই সময় শুরু হয়েছিল। জাতির জনকের প্রতিটি কাজকে বিতর্কিত করা, তাঁর সরকার-প্রশাসনকে দুর্বল করা, প্রশ্নবিদ্ধ করার অপপ্রয়াস চালানো হয়েছে। এক শ্রেণির গণমাধ্যম উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে কাজ করেছিল। তাঁর উদারতার সুযোগ নিয়ে অনেকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে সেই সময়।”

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক আরো বলেন, “একটা কথা প্রায়ই শোনা যায়, বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে চারটি পত্রিকা রেখে বাকি পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এ কথাটি ঠিক নয়। ওই সময় আরো ১২০টি পত্রিকা চালু ছিল। তিনি সেইসব পত্রিকার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন, যারা অপসাংবাদিকতা করছিল; তাদের নিয়ন্ত্রণের মূলত একটা চেষ্টা হয়েছিল।”

লেখক, সাংবাদিক তৎকালীন সাপ্তাহিক বিচিত্রার সহকারী সম্পাদক শাহরিয়ার কবির সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর তো ‘মার্শাল ল’ জারি করা হয়েছিল। ‘মার্শাল ল’-তে পৃথিবীর কোনো প্রধান পত্রিকাই স্বাধীনভাবে লিখতে পারে না। প্রেস রিলিজ যা দেবে, সেগুলো হুবহু ছাপতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। পত্রিকার নিজস্ব কোনো ভূমিকা ছিল বলে আমার তো মনে হয় না।”

পত্রিকাগুলোর কোনো দায়িত্বজ্ঞানহীন ভূমিকা আপনি দেখছেন কিনা? —এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমি মনে করি না। কারণ তখন ছিল ‘মার্শাল ল’। বাকশালের পর চারটি পত্রিকাই ছিল সরকারি মালিকানাধীন। সরকারি মালিকানার বাইরে কোনো পত্রিকা ছিল না তখন। সরকারি মালিকানার পত্রিকা কী করে সরকারের বিরুদ্ধে লিখবে? তবুও খুব কায়দা করে আমার যতটুকু মনে পড়ে, দৈনিক অবজারভারের সম্পাদক আবদুস সালাম সম্পাদকীয় লিখেছিলেন। তারপরে তো উনার চাকরি চলে গিয়েছিল।”