রাজধানীসহ সারা দেশে হঠাৎ করেই জ্যামিতিক হারে বেড়ে চলেছে ডায়রিয়ার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। শুধু রাজধানীর আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর’বি) হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ১৩ শতাধিক রোগী ভর্তি হচ্ছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ তীব্র ডায়রিয়া বা কলেরায় আক্রান্ত রোগী।
এদিকে আইসিডিডিআরবির মত রাজধানীর অন্য সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও ক্রমেই বাড়ছে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা।
হঠাৎ করে গরম বেড়ে যাওয়ায় এই পরিস্থিতি হয়েছে বলে মনে করছেন আইসিডিডিআরবির চিকিৎসকরা। এছাড়া রোগীর চাপ সামলাতে আইসিডিডিআরবি হাসপাতালে খোলা জায়গায় তাঁবু টাঙিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে রোগীদের।
যে হারে বাড়ছে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা
হঠাৎ ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় রাজধানীর মহাখালীর আইসিডিডিআরবিতে রোগীর চাপ বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। শুধু এই হাসপাতালে ভর্তি হয় গত ১ এপ্রিল এক হাজার ২৭৪ জন, ২ এপ্রিল এক হাজার ২৭৪, ৩ এপ্রিল এক হাজার ১৭১, ৪ এপ্রিল এক হাজার ৩৮৩ এবং ৫ এপ্রিল এক হাজার ৩৭৯। তবে এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত অর্থাৎ আজ দুপুর ২ টা পর্যন্ত ৭০০ এর অধিক রোগী ভর্তি হয়েছে।
এদিকে আইসিডিডিআরবি ও মিটফোর্ড হাসপাতালে ডায়রিয়া রোগীর চাপ বেশি। ফলে দুই হাসপাতালে বিপুল রোগীর চাপে চিকিৎসকরা সেবা দিতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
হাসপাতালে রোগীর চাপ
আইসিডিডিআরবি অস্থায়ী তাঁবুতে চিকিৎসাধীন যাত্রাবাড়ীর বাদল হাসানের (২০) হাতে স্যালাইন লাগানো। মঙ্গলবার (৫ এপ্রিল) বেলা ১১টায় তিনি ভর্তি হয়েছেন। তার মা পাশে বসে আছেন।
বাদল সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “পরশু (সোমবার) অনেকবার পাতলা পায়খানা হয়েছে। ভয়ে হাসপাতালে চলে এসেছেন।”
যশোর জেলার আরাফাত হোসেন রোহান। রাজধানীতে আসেন বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য। মঙ্গলবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ভর্তি হওয়ার আগে বেশ কয়েকবার পাতলা পায়খানা ও বার-বার বমি হয়েছিল তার।
মধ্য বাড্ডার বেপারীপাড়া থেকে দেড় বছরের মেয়ে ঐশী রহমানকে নিয়ে এসেছেন মা পারভীন আক্তার। মেয়ের পাতলা পায়খানার সঙ্গে বমি হচ্ছিল বারবার। হাসপাতালে একদিন চিকিৎসা নেওয়ার পর এখন ভালো আছেন মুক্তামণি।
এছাড়া নরসিংদী থেকে আসা মধ্য বয়স্ক বাদশা মিয়া সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “দুই দিন ধরে প্রচণ্ড পেট ব্যাথা ও পাতলা পায়খানা হয়। মঙ্গলবার বমি শুরু হলে শরীর বেশি দুর্বল হয়ে পড়ে। এরপর এখানে আসি। এখন কিছুটা সুস্থ, রাতের মধ্যেই বাসায় চলে যাবো।”
রাজধানীর যেসব এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ
ঢাকার সব জায়গা থেকেই রোগী আসছেন। ফলে বলা যায় রাজধানীর সর্বত্র রোগটির বিস্তার ঘটেছে।
রাজধানীর যেসব এলাকা থেকে বেশি রোগী আসছেন সেগুলো হলো যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, উত্তরখান, মানিকনগর, জুরাইন, মুগদাসহ আরও কিছু এলাকা থেকে বেশি রোগী আসছেন। আর ঢাকার বাইরে নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা থেকে প্রচুর রোগী আসছেন।
আসলে যেসব জেলা থেকে ঢাকার সড়ক পথে দূরত্ব কম- সেসব জেলা থেকে রোগী বেশি আসছেন বলে জানা গেছে।
আইসিডিডিআরবি চিকিৎসকরা যা বললেন
আইসিডিডিআরবির সিনিয়র মেডিকেল অফিসার ডা. মোস্তফা পারভেজ সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “প্রতিবছরই এই মৌসুমে ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়ে যায়। একটু বৃষ্টি হলে আর তাপমাত্রা কমলে এর প্রকোপ কমে যাবে আশা করছি।”
ডা. মোস্তফা পারভেজ আরও বলেন, “ডায়রিয়া পানিবাহিত রোগ। হঠাৎ গরম বেড়েছে। বাসাবাড়ির পানির উৎস, রাস্তার ও হোটেলের পচা-বাসি ও অপরিষ্কার খাবার থেকে ডায়রিয়া ছড়াচ্ছে। ঋতু পরিবর্তন হচ্ছে। এ সময় বয়স্ক ও শিশুরা বেশি ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে থাকে। গত তিনদিনে তিন হাজারের বেশি মানুষ ডায়রিয়ার চিকিৎসা নিয়েছেন।”
জনবল কম থাকলেও তারা সাধ্যমতো ডায়রিয়ার রোগীদের সেবা দিচ্ছেন বলে জানান এই চিকিৎসক।
ডায়রিয়া নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত
দেশে হঠাৎ ডায়রিয়ার এমন প্রকোপ বাড়ায় শঙ্কিত সাধারণ মানুষ। ডায়রিয়ার এমন প্রকোপ বাড়ায় সরকারকে বিশেষ ভূমিকা নিতে হবে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী।
সংবাদ প্রকাশকে তিনি বলেন, “দেশে মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকে আশঙ্কাজনকভাবে বাড়তে শুরু করেছে ডায়রিয়া রোগী। ডায়রিয়া সারা বছরের একটি রোগ হলেও প্রতিবছর গরমের শুরু থেকেই ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য সরকার দেশব্যাপী ইপিআই কেন্দ্রের মাধ্যমে লিফলেট বিলি করতে পারে। ডায়রিয়া সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার জন্য রেডিও ও টেলিভিশনে সঠিক তথ্য প্রচার করতে হবে।”
ডা. লেলিন চৌধুরী আরও বলেন, “এ সময় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলে রোগীকে স্যালাইন খাওয়াতে হবে। তাতে কাজ না হলে কোনো ঝুঁকি না নিয়ে রোগীকে হাসপাতালে আনতে হবে। ডায়রিয়া থেকে রক্ষা পেতে নিরাপদ পানি ও খাবারের বিকল্প নেই। সবচেয়ে ভালো করে তৈরি করা খাবার ও ফুটানো পানি খেতে হবে। পাশাপাশি বারবার হাত ধোয়ার অভ্যাস করতে হবে। রাস্তার পাশের খাবার ও বাসি খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। খাওয়া, হাত ধোয়া এবং রান্না থেকে শুরু করে প্রতিদিনের কাজকর্মে বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, বাইরের খাবার, দুষিত বা পচা খাবার এড়িয়ে চলার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন।”
ডায়রিয়া হলে করণীয়
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরীর মতে ডায়রিয়া হলে রোগীকে নিয়মিত খাবার স্যালাইন দিতে হবে। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে আইভি ফ্লুয়িড স্যালাইন বা ওষুধ দিতে হবে। রোগী দুর্বল হয়ে পড়লে অবশ্যই নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। ডায়রিয়ায় শরীর থেকে যে পানি ও লবণ বের হয়ে যায়, স্যালাইন খাওয়ার মাধ্যমে তা পূরণ করা হয়। এখন রাইস স্যালাইনও খেতে দেওয়া হয়।
ডা. লেলিনের মতে, রোগী যদি বমি শুরু করে, প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যায় বা জিহ্বা শুষ্ক হয়ে পড়ে, তাহলে কোনোরকম বিলম্ব না করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। কারণ তখন শরীর ডিহাইড্রেট হয়ে পড়তে শুরু করেছে। এ সময়ে বাসি খাবার, রাস্তার খাবার, বিশেষ করে শরবত, আখের রস না খাওয়ার পরামর্শ সবার প্রতি।