ভারতীয় উপমহাদেশের সংস্কৃতির অংশ হিসেবে নারীদের সাজের অন্যতম একটি অংশ হলো ‘টিপ’। বাঙালি নারীর কাছে টিপ কেবল সাজের উপাদান নয়, বরং বাঙালি সংস্কৃতির একটি অংশও বটে। নারী তার সাজের পূর্ণতার লক্ষে অনেক সময় টিপ পরে থাকেন। আবার কেউ সাজের একমাত্র অলংকার হিসেবেও টিপকে বেছে নেন। তাই কোনো সমাজ বা শ্রেণির পক্ষ থেকে নারীর টিপ পরা নিয়ে কটুক্তিমূলক আচারণ শোভন হতে পারে না।
সম্প্রতি রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন তেজগাঁও কলেজের এক শিক্ষিকা। পথে বাইকের ওপর বসে থাকা মধ্যবয়সী এক পুলিশ সদস্য তাকে দেখে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেন এবং টিপ পরা নিয়ে বাজে মন্তব্য করেন।
জানা গেছে, ওই শিক্ষিকা রাজধানীর তেজগাঁও কলেজের থিয়েটার অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষক লতা সমাদ্দার। এই ঘটনায় তিনি শেরে বাংলা নগর থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। ঘটনার আকস্মিকতায় নিজেকে সামলে নিয়ে প্রতিবাদ করেন । তাতে সেই পুলিশ সদস্য আরও বাজে গালিগালাজ করতে থাকেন এবং তার পায়ের ওপর দিয়েই বাইক চালিয়ে চলে যান।
এ বিষয়ে প্রসাশনের কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পেয়েছেন কি না জানতে চাইলে ভুক্তভোগী ওই শিক্ষিকার স্বামী মলয় বালা সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “তারা এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছেন বলে আমাকে জানিয়েছেন। পুলিশ সূত্রে আমরা জেনেছি, লতা যে বাইকের নাম্বারটা দিয়েছিল সেটা একটি চুরি যাওয়া বাইক। এখন এক্ষেত্রে দুইটি বিষয় হতে পারে, এক, প্রসাশনের কেউ চুরি যাওয়া বাইকটি ব্যবহার করছেন, দুই ভিকটিম যেহেতু নাম্বারটা মনে রেখে অভিযোগ করেছেন, তারও ভুল হতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা প্রতিবাদী হয়েছি কারণ টিপ কোনো সাম্প্রদায়িকতার প্রতীক হতে পারে না। বাঙালি নারীর একটা বড় অংশ সাজের ক্ষেত্রে নিয়মিত টিপ পরে থাকেন। তাছাড়া সেই পুলিশ সদস্য ধর্মকে কেন্দ্র করে বাজে মন্তব্য করেছেন। স্বাধীনতার ৫০ বছরেও বাঙালি নারী তার সাজ পোশাক নিয়ে লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছেন। তাই আমরা চাই আমাদের সঙ্গে সবাই একত্রে আওয়াজ তুলুক। আমি প্রত্যাশা করি, অপরাধীকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া হোক।”
এদিকে এই ঘটনার পরপরই প্রতিবাদে সরব হয়েছেন হাজারও মানুষ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিজেদের টিপ পরা ছবি দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন তারা।
বুলবুল ললিতকলা একাডেমি বাচিককলা বিভাগের শিক্ষক ও বিশিষ্ট আবৃত্তিশিল্পী সাফিয়া খন্দকার রেখা। দীর্ঘদিন আবৃত্তিচর্চার মধ্যে আছেন। সাজের সঙ্গে মিলিয়ে টিপ পরতে পছন্দ করেন তিনি। আকস্মিক এই ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়ে নিজের ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন “আকাশও টিপ পরে, দিনে সূর্যের টিপ, রাতে চাঁদের টিপ।
আবৃত্তি ও উপস্থাপনা শৈলীর প্রশিক্ষক রূপশ্রী চক্রবর্তী কবি আসাদ চৌধুরীর ‘জানাজানি’ কবিতার অংশবিশেষ প্রকাশ করেছেন এই প্রতিবাদে।
‘বাংলাদেশের আকাশ কেন কপালে টিপ আঁকে, জানো?
জানি জানি জানি।
উদার আকাশ যে – ইশারায় ডাক দিয়ে যায় প্রাণে,
বাঙালি তা জানে।
তাইতো আকাশ টিপ দিয়ে যায়, ললাটের মাঝখানে।’
ঘটনার প্রতিবাদে নিজের বেশ কিছু টিপ পরা ছবি পোস্ট করে তামান্না সারওয়ার। “টিপ আমি পরবোই। তোরা অন্য চুলোয় গিয়ে মর। যাহ্”
বাচিকশিল্পী ফারহানা লিখেছেন, “দিনরাত টিপ পরা থাকবে। আমরা সবাই টিপ পরি। কয়জনের পায়ের উপর দিয়ে বাইক চালিয়ে নিয়ে যাবি তোরা?”
দেশের প্রথম রূপান্তরিত নারী সংবাদ উপস্থাপক তাসনুভা আনান শিশির যতখুশি ততবার টিপ পরবে জানিয়ে, উক্ত ঘটনার বিচারের দাবি জানিয়েছেন তিনি।
এছাড়া শুধু প্রতিবাদ নয়, অভিযুক্ত অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনারও দাবি জানিয়েছেন প্রতিবাদকারীরা।
সাংবাদিক প্রতীক ইজাজ লিখেছেন, ‘টিপ পরার জন্য নারীকে আক্রমণ করার দায়ে অভিযুক্ত পুলিশকে দ্রুত আটক করে বিচারের আওতায় আনা হোক।’
কবি ও ঔপন্যাসিক অসীম সাহার রচিত অনেক লেখায় নারী সৌন্দর্যের উপকরণ হিসেবে উঠে এসেছে টিপ। তাই নারীর এ সৌন্দর্য চর্চার দিকে আঙুল তোলায় মর্মাহত এই লেখক। তিনি বলেন, “নারীর টিপ আমি সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে দেখি। এখানে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। মানুষের এ ধরনের চিন্তাধারা দেখে আমার লজ্জা হয় বাঙালি হিসেবে।”