করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। প্রতিদিন হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। যদিও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কয়েক দিন ধরে চিরুনি অভিযান পরিচালনা করছে। কারও বাসা বা প্রতিষ্ঠানে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক জরিমানা করা হচ্ছে। তাতেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না। ফলে করোনার সঙ্গে ডেঙ্গু আতঙ্ক ভর করেছে মানুষের মধ্যে।
দেশে জুন থেকে হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য এমনটাই বলছে। তথ্য অনুযায়ী, এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত চলতি বছর ২ হাজার ৯৮ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে কেবল জুলাই মাসে ১ হাজার ৭১৭ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ ছাড়া জানুয়ারিতে ৩২ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৯ জন, মার্চে ১৩ জন, এপ্রিলে ৩ জন, মে মাসে ৪৩ জন ও জুনে ২৭১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এ তো গেল সারা দেশের পরিসংখ্যান। এর বাইরে শুধু ঢাকায় প্রতিদিন ১৫০ জনের বেশি ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন।
ডেঙ্গু নিয়ে ডিএনসিসির দুই মেয়রের বক্তব্য
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম এডিস মশা থেকে মুক্তি পেতে সবাইকে তাদের ঘরের আশপাশে পরিষ্কার রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে নিয়মিত চিরুনি অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। সবাইকে সচেতন করতে রোড-শো পরিচালনা করছি। আমি সব সময় বলে আসছি—তিন দিনে এক দিন জমা পানি ফেলে দিন। সবাই যদি এই কথাটি মেনে চলেন তাহলে মশার বংশবিস্তার রোধ করা সম্ভব।”
ডিএনসিসির ৪৪টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষা করা হচ্ছে জানিয়ে মেয়র বলেন, “আপনারা হয়তো জানেন না যে আপনাদের ঘরে বিভিন্ন জায়গায় জমে থাকা পানিতেই এডিস মশা ডিম পাড়ছে, বংশবিস্তার করছে। তাই করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও রাস্তায় নেমেছি। আসুন, আমরা সবাই মিলে ভালো থাকি। এই শহর শুধু মেয়র, কাউন্সিলর কিংবা এই শহর শুধু মশার নয়, এই শহর সবার।”
এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ফজলে নূর তাপস বলেন, “আপনারা যদি লক্ষ করেন যেকোনো প্রতিবেশীর আঙিনায় পানি জমে আছে এবং আপনারা যদি তাকে দিয়ে পরিষ্কার না করাতে পারেন, তাহলে আমাদের জানান। আমরা কাউন্সিলরসহ উপস্থিত হব, আমাদের ভ্রাম্যমাণ আদালত উপস্থিত হবে।”
যা বলছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা
সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে পারে বলে মনে করেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। সে জন্য সবাইকে ব্যক্তি উদ্যোগে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
বিশিষ্ট কীটতত্ত্ববিদ ড. মঞ্জুর এ চৌধুরী বলেন, “গত বছরের তুলনায় এ বছর এডিস মশা ও ডেঙ্গু ভাইরাস দুটোর উপস্থিতিই বেশি। ভাইরাসের বাহক এডিস এলবোপিক্টাস ও ইজিপ্ট দেশের বিভিন্ন জায়গাতেই আছে। এতেই ধারণা করা যায়, এটা দেশব্যাপী বিরাজমান এবং মৌসুমে ছড়িয়ে পড়বে।”
ড. মঞ্জুর এ চৌধুরী আরও বলেন, “ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট প্রিন্সিপাল অনুসারে সারা দেশে সার্ভিলেন্স করা দরকার ছিল। সেই অনুসারে এডিস নির্মূল কর্মসূচি গ্রহণ করতে হতো। কিন্তু সেটা করা হয়নি। এখন যেসব জায়গা থেকে রোগী পাওয়া যাচ্ছে, সেসব এলাকায় হিট করতে পারলে ভাইরাস এবং বাহক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কিন্তু এর জন্য শক্তিশালী ফগিং মেশিন ও কার্যকর কীটনাশক প্রয়োজন। সেই ব্যবস্থাও করেনি সিটি করপোরেশন। এ অবস্থায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব শুরু হয়ে গেলে নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।”
এদিকে করোনার সঙ্গে হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর চাপ বাড়ায় চিকিৎসকদের ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম।
মহাপরিচালক বলেন, “একদিকে করোনা, অন্যদিকে ডেঙ্গু। গত বছরের মতো এ বছরও এই দুটোকে একসঙ্গে মোকাবিলা করা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই চিকিৎসকরা চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন। আমরা সব জেলা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে সব ধরনের সহায়তার জন্য ডেঙ্গু সেলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছি।”
সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেলা সদর ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষার অ্যান্টিজেন কিটের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে। সরকারি হাসপাতালে এ পরীক্ষাটি বিনা মূল্যে করার সুযোগ রয়েছে। ডেঙ্গুর উপসর্গ দেখা দিলে বিলম্ব না করে সরকারি কিংবা বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ডেঙ্গু পরীক্ষা করার অনুরোধ জানান তিনি।