সরকারি ৬টি, বেসরকারি ২০টি মেডিকেল কলেজ বন্ধের চিন্তা

সংবাদ প্রকাশ ডেস্ক প্রকাশিত: মার্চ ১১, ২০২৫, ১০:০৮ এএম
প্রতীকী ছবি

আওয়ামী লীগের আমলে ১৫ বছরে অর্ধশতাধিক মেডিকেল কলেজের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এসব কলেজের বড় অংশই চালুর ৮ থেকে ১০ বছর হলেও এখনো স্থায়ী ক্যাম্পাস গড়ে ওঠেনি।

এমনকি কোনো কোনো ক্যাম্পাসের জায়গাও ঠিক হয়নি। পাঠদানের জন্য নেই প্রয়োজনীয় শিক্ষক। ভাড়া হাসপাতালের কক্ষে চলছে শিক্ষা কার্যক্রম। এমনকি শ্রেণিকক্ষ ও গবেষণার সংকটও পাওয়া গেছে।

অথচ যেকোনো মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠায় অবকাঠামোর পাশাপাশি দক্ষ লোকবল ও আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জামের ব্যবস্থা থাকা বাধ্যতামূলক। এসব কিছু না থাকায় শিক্ষার ঘাটতি নিয়েই প্রতিবছর বের হচ্ছেন হাজার হাজার চিকিৎসক, যাদের বেশির ভাগই থেকে যাচ্ছেন অদক্ষ। এটি ভবিষ্যতে স্বাস্থ্য খাতের জন্য চরম হুমকি হয়ে উঠতে পারে বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এমন পরিস্থিতিতে জোড়াতালি দিয়ে চলা অন্তত ২৬টি সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজ বন্ধ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ইতিমধ্যে অনেকগুলো সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রতিবেদনও তৈরি হচ্ছে। তবে সংস্কারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ভার থাকবে নির্বাচিত সরকারের ওপর।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একজন সচিব একটি গণমাধ্যমকে বলেন, গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার তাদের রাজনৈতিক সংকটে মানুষের আস্থা অর্জনে কোনো ধরনের প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা ছাড়াই জেলায় জেলায় মেডিকেল কলেজ গড়ে তোলে। অবকাঠামো ছাড়া এসব প্রতিষ্ঠানের বড় অংশেই সুযোগ-সুবিধা নেই। এতে করে হাতে-কলমে শিক্ষার ঘাটতি নিয়ে প্রতিবছর হাজার হাজার চিকিৎসক বের হচ্ছে।’

ওই সচিব বলেন, ‘নিজস্ব ক্যাম্পাস ও কিছু ক্ষেত্রে আবাসন সুবিধা না পাওয়ায় মেডিকেল শিক্ষার্থীদের মধ্যেও হতাশা তৈরি হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে মানসম্মত চিকিৎসা পাওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। তাই মেডিকেল কলেজের আসনসংখ্যা কমিয়ে আনার পাশাপাশি মানহীন সরকারি-বেসরকারি এই মেডিকেল কলেজগুলো বন্ধের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি ছয় থেকে সাতটি। বাকিগুলো বেসরকারি।’

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সাল থেকে গত বছরের ৫ আগস্ট পতনের আগ পর্যন্ত ১৫ বছরে ৫২টি মেডিকেল কলেজের অনুমোদন দিয়েছে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সরকার। এর মধ্যে ২০টি সরকারি আর ৩২টি বেসরকারি। আবার এক বছরেই (২০১৪ সালে) অনুমোদন পেয়েছে ১৬টি কলেজ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক দেশে ৫০ বছরেও এত মেডিকেল অনুমোদন পায়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব মেডিকেল কলেজের অধিকাংশই হয়েছে তদবির আর রাজনৈতিক বিবেচনায়। ফলে দেখা হয়নি প্রয়োজনীয়তা। ছিল না প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা। ফলে এখনো এসব প্রতিষ্ঠানে সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা না হলেও থেমে নেই শিক্ষার্থী ভর্তি। এতে করে তৈরি হচ্ছে অদক্ষ চিকিৎসক।

মেডিকেলের শিক্ষার্থীরা বলছেন, এমবিবিএসে ভর্তির পর প্রথম পর্বের দেড় বছরের মধ্যে অ্যানাটমি, ফিজিওলজি ও বায়োকেমিস্ট্রি পড়তে হয়। দ্বিতীয় পর্বে এক বছরে ফার্মাকোলজি ও ফরেনসিক মেডিসিন বিষয়ে। তৃতীয় পর্বে এক বছরের জন্য পড়তে হয় কমিউনিটি মেডিসিন, প্যাথলজি ও মাইক্রোবায়োলজি। চতুর্থ পর্বে ক্লিনিক্যাল বিষয় পড়তে হয়।

সেখানে গাইনি, মেডিসিন ও সার্জারি তিনটি প্রধান বিষয় রয়েছে। এসব বিষয় হাসপাতালে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে ব্যবহারিকভাবে করতে হয়। কিন্তু নিজস্ব হাসপাতাল না থাকায় ব্যবহারিকে ঘাটতি নিয়েই শিক্ষাজীবন শেষ করতে হচ্ছে। দায়সারাভাবে ব্যবহারিক শিক্ষা চলছে সংশ্লিষ্ট জেলা হাসপাতালগুলোতে।

খোদ সরকারি ছয়টি হাসপাতালেও এমন তথ্য পাওয়া গেছে। এই তালিকায় রয়েছে, রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ, হবিগঞ্জ মেডিকেল কলেজ, নওগাঁ মেডিকেল কলেজ, নেত্রকোনা মেডিকেল কলেজ, মাগুরা মেডিকেল কলেজ ও নীলফামারী মেডিকেল কলেজ।

২০১৫ সালে তিনজন শিক্ষক নিয়ে চালু হয় রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম। কলেজটিতে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৩০১ জন। কলেজের জন্য শহরের রাঙাপানি এলাকায় জমি অধিগ্রহণ করা হলেও অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি। হবিগঞ্জ মেডিকেল কলেজের স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য স্থান নির্ধারণ হলেও একনেকে অনুমোদন না পাওয়ায় কাজ থমকে আছে।

একই অবস্থা নওগাঁ মেডিকেলের। কলেজের কার্যক্রম চলছে ২৫০ শয্যার নওগাঁ জেনারেল হাসপাতালের পুরোনো ভবনের দ্বিতীয় তলার একটি অংশে। এই কলেজের ৩২০ শিক্ষার্থীর জন্য ন্যূনতম সাতটি লেকচার হল (শ্রেণিকক্ষ) দরকার হলেও আছে চারটি।

রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালের হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীদের জন্য নির্মিত করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) ভবনে অস্থায়ীভাবে মেডিকেল কলেজের শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম চলছে। শিক্ষার্থীদের জন্য ন্যূনতম ১৫টি শ্রেণিকক্ষ প্রয়োজন।

অন্যদিকে আইন ও নীতিমালা অনুসারে মানসম্পন্ন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে না পারায় গত বছর বেসরকারি দুটি মেডিকেল কলেজের নিবন্ধন বাতিল করে সরকার। একই সঙ্গে চারটি মেডিকেল কলেজের নিবন্ধন স্থগিত করা হয়। বন্ধ হওয়া দুই কলেজ কেয়ার মেডিকেল কলেজ ও আশুলিয়ার নাইটিংগেল মেডিকেল কলেজের পাশাপাশি নিবন্ধন স্থগিত হওয়া ঢাকার উত্তরার আইটি মেডিকেল কলেজ, ধানমন্ডির নর্দান ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ, রংপুরের নর্দান প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ ও রাজশাহীর শাহ মখদুম মেডিকেল কলেজের ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এগুলোসহ আরো ১৬ থেকে ১৭টি কলেজ স্থায়ীভাবে বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সরকারি ও বেসরকারি মিলে দেশে মোট মেডিকেল কলেজ ১১১টি। এর মধ্যে সরকারি ৩৮টি, যার আসন সংখ্যা ৫ হাজার ৫০৫টি। এ ছাড়া বেসরকারি ৭২টি মেডিকেল কলেজে আসন সংখ্যা ৬ হাজার ৫৫৭টি। এসব চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিবছর ১২ হাজার ৬২ জন চিকিৎসক পেশায় যুক্ত হন।

এমন পরিস্থিতিতে মেডিকেল কলেজের আসনসংখ্যা সীমিত করার পাশাপাশি মানহীন কলেজ বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান।

অধ্যাপক সায়েদুর বলেন, ‘চিকিৎসা শিক্ষার মানের কথা চিন্তা করেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কারণ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এত কলেজের শিক্ষক ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা কঠিন। কলেজগুলোতে ক্লিনিসিয়ান, পর্যাপ্ত চিকিৎসক, শিক্ষক থাকলেও বেসিক সায়েন্সে অবস্থা এতটাই খারাপ যে, অর্ধেক কলেজ চালানোর মতো অবস্থা নেই। অনুশীলনে সুবিধার জন্য ক্লিনিক্যাল শিক্ষক বেশি হওয়ায় বেসিক সায়েন্সে সংকট পড়েছে। ফলে শিক্ষার মান দিন দিন কমে যাচ্ছে।’

এদিকে মানহীন মেডিকেল কলেজ বন্ধের পাশাপাশি হাজারের বেশি আসন কমিয়ে আনার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের একজন পরিচালক এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

একই সঙ্গে বেসরকারি কলেজ বন্ধের ক্ষেত্রে আগামী বছর থেকে প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। সবকিছু এখন পর্যালোচনায় রয়েছে, তালিকা হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আরেকটা সংকট হলো দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষকদের পদোন্নতি হয়নি। সেটি না হলে শিক্ষক সংকট হবেই। এ বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।’ সূত্র :আমার দেশ