সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিয়ন হয়ে জাহাঙ্গীর আলম দুই হাত ভরে কামিয়ে নেন বিপুল অর্থ। রাজপ্রাসাদ তৈরি করে ছাড়েন টিনের ঘর। চারতলা বাড়িটির সামনে রয়েছে নৌকার আদলে তৈরি বিশাল ফটক।
স্থানীয়দের মতে, ওই বাড়ির গেট তৈরিতে জাহাঙ্গীর ব্যয় করেছেন অন্তত ৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া গ্রামের বাড়িতে বিপুল পরিমাণ কৃষিজমি রয়েছে তার। ঢাকায় রয়েছে তার ও পরিবারের সদস্যদের সম্পদের পাহাড়। আওয়ামী লীগ আমলে দুর্নীতি করে গড়েন এই সম্পদের পাহাড়। এ নিয়ে অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
জাহাঙ্গীর আলম নোয়াখালীর চাটখিল থানার খিলপাড়া ইউনিয়নে নাহারখিল গ্রামের বাসিন্দা। তার বাবা মৃত রহমত উল্ল্যাহ ছিলেন কেরানি। টিনের ঘরে ছিল তাদের বসবাস।
ছিলেন মিরপুরের চা-দোকানি। রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে পল্টন এলাকাতেও চা-পানির দোকান নিয়ে বসতেন বলে শোনা যায় জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদদের মুখে। চা বিক্রি করতেন বলে লোকজন ডাকত ‘কেটলি জাহাঙ্গীর’ নামে।
চাটখিলের স্থানীয় বাসিন্দা ও জাহাঙ্গীর আলমকে কাছ থেকে দেখেছেন এমন কয়েকজন জানান, ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনা মোড় ঘুরিয়ে দেয় জাহাঙ্গীর আলমের। এর আগ পর্যন্ত জাহাঙ্গীর নিজেকে আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে পরিচয় দিতেন।
গ্রেনেড হামলার দিন পল্টন থাকার সুবাদে নিজে আহত হয়েছেন বলে দাবি করেন। একই সঙ্গে আহত অনেককে হাসপাতালে নেওয়ার কাজও করেছেন, এমন ছবি তিনি নিজেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করেন। এরপর থেকেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন, যাতায়াত বাড়ে পল্টন আওয়ামী লীগ অফিসে।
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পর ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে কপাল খুলে যায় জাহাঙ্গীর আলমের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই ব্যক্তির নাম জাহাঙ্গীর আলম ওরফে ‘কেটলি জাহাঙ্গীর’ ওরফে ‘পানি জাহাঙ্গীর’ শেখ হাসিনা বিরোধী দলে থাকার সময়ও জাহাঙ্গীর আলম তার বাসভবন সুধা সদনে ব্যক্তিগত স্টাফ হিসেবে কাজ করেছেন। সেস ময় বিভিন্ন প্রোগ্রামে শেখ হাসিনার জন্য যে খাবার পানি বাসা থেকে নেওয়া হতো, সেটা এই জাহাঙ্গীর বহন করতেন। এজন্যই তিনি ‘পানি জাহাঙ্গীর’ হিসেবে পরিচিতি পান। পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি তার ব্যক্তিগত কর্মচারী হিসেবে কাজ শুরু করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে থাকা যে দুজন পিয়নকে বহিষ্কার করা হয় তাদের একজন ৪০০ কোটি টাকার মালিক নোয়াখালীর জাহাঙ্গীর। অপরজন গোপালগঞ্জের আব্দুল মান্নান। বহিষ্কারের পর ২০২৩ সালের ৬ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এক প্রজ্ঞাপন জারি করে জাহাঙ্গীরের বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে বলা হয়। জাহাঙ্গীর বিগত নির্বাচনে নোয়াখালী-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টা করেন। নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে এলাকায় যেতেন হেলিকপ্টারে।
অথচ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ২২ দিন আগে সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তার পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার মালিক। হেলিকপ্টার ছাড়া চলেন না। আমি তার কার্ড সিজ করেছি, চাকরি থেকে বের করে দিয়েছি। যা করার আমি ব্যবস্থা নিয়েছি।’
জানা যায়, ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর পিওন হিসেবে যোগ দেয়ার পর বদলে যায় জাহাঙ্গীরের জীবন। নিজেকে পরিচয় দিতে থাকেন শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে। গণভবনে থাকার সময় আওয়ামী লীগ নেতাদের চেয়েও হয়ে ওঠেন ক্ষমতাবান। করেন বেপরোয়া তদবির-বাণিজ্য। এমনকি আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছ থেকেও হাতিয়ে নেন বিপুল অর্থ। নিজ গ্রামে গড়ে তোলেন বিশাল প্রাসাদ ও খামার।
বিপুল অবৈধ অর্থের মালিক হওয়ার পাশাপাশি নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতির পদও বাগিয়ে নেন জাহাঙ্গীর। এক সময় বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত ভাই ও ভাগিনাকেও আনেন জেলা কমিটিতে।
স্থানীয়রা জানান, জাহাঙ্গীর মাঝেমধ্যে আসতেন কালো রঙের একটি গাড়ি নিয়ে। তিনি নিজেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পিএস পরিচয় দিতেন। শেখ হাসিনার আমলেই তিনি শত শত কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছেন।
চাটখিল উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ইউসুফ দফাদার বলেন, ‘ জাহাঙ্গীরের আত্মীয় এলাকার আলমগীর করতেন বিএনপি। পরে জাহাঙ্গীর তাকে আওয়ামী লীগ থেকে নমিনেশন দিয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এলাকার চেয়ারম্যান বানিয়ে দেন। তার ভাগিনাকে তিনি জেলা পরিষদের সদস্য করেছেন।’
এদিকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নোয়াখালীর এক আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিলে জাহাঙ্গীরের অবৈধ সম্পদের বিষয়টি সামনে চলে আসে। এরপরই প্রধানমন্ত্রীর পিয়নের চাকরি হারান। স্থানীয়দের অভিযোগ, গ্রামের বাড়ি ও ঢাকায় সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তিনি।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় জাহাঙ্গীর কৃষিখাত থেকে তার প্রতিবছর আয় ৪ লাখ টাকা, বাড়ি ও দোকান ভাড়া থেকে সাড়ে ১১ লাখ টাকা আয়, শেয়ার, সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক আমানত থেকে ৯ লাখ টাকা আয়, চাকরি থেকে ৬ লাখ ও অন্যান্য উৎস থেকে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টাকা আয়ের তথ্য জানান। হলফনামার হিসাব অনুযায়ী, বছরে প্রায় ৫০ লাখ টাকার আয়ের কথা জানিয়েছেন জাহাঙ্গীর।
এ ছাড়া জাহাঙ্গীরের নিজের নামে আড়াই কোটি টাকা ও স্ত্রীর নামে ব্যাংকে প্রায় সোয়া এক কোটি টাকা ছিল হলফনামার তথ্য অনুযায়ী। ডিপিএস ছিল পৌনে তিন লাখ টাকা, এফিডিআর ছিল সোয়া এক কোটি টাকা। স্ত্রীর আছে গাড়ি। বিভিন্ন কোম্পানিতে কোটি টাকার শেয়ারও রয়েছে। এ ছাড়া, একটি অংশীদারী প্রতিষ্ঠানে তার ৬ কোটি টাকার বিনিয়োগও রয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, সব প্রতিষ্ঠান থেকে জাহাঙ্গীর বা তার লোক চাঁদা নিতেন। চাটখিল ও সোনাইমুড়িতে জাহাঙ্গীরের কারণে একটি সন্ত্রাসী জনপদে পরিণত হয়েছে। তিনি সোনাইমুড়িতে অপরাজনৈতিক করার চেষ্টা করেছেন।
চাটখিল উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হুদা শাকিল বলেন, “এখানে তো এখন শাক দিয়ে মাছ ঢাকার সুযোগ নেই। জাহাঙ্গীর এখানে অনেক সম্পদের মালিক হয়েছেন।”
জাহাঙ্গীর কীভাবে এত অর্থবিত্তের মালিক হলেন, তা অনুসন্ধান করছে দুদক। শিগগিরই প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে বলে জানান দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা।