২০২৫ এর মধ্যে সরকারি নির্মাণে পোড়া ইট ব্যবহার বন্ধ হবে : পরিবেশ উপদেষ্টা

সংবাদ প্রকাশ প্রতিবেদক প্রকাশিত: নভেম্বর ১৫, ২০২৪, ০৩:৫৬ পিএম
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। ছবি : সংগৃহীত

২০২৫ সাল নাগাদ সকল সরকারি নির্মাণে পোড়ানো ইটের ব্যবহার বন্ধ হবে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। 

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, সরকারি অফিসে ইতোমধ্যে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে যেন নির্মাণ কাজে পোড়ানো ইট ব্যবহার না করা হয়। সরকারই হচ্ছে নির্মাণ কাজে ইটের সবচেয়ে বড় গ্রাহক। রাস্তাঘাট ও ভবন নির্মাণে সরকার ইট ব্যবহার করে থাকে। বড় বড় কাজে ইট ব্যবহার হয়ে থাকে।

বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা বাসস-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা জানান।

উপদেষ্টা বলেন, সরকারকে পোড়ানো ইটের বিকল্প ব্যবস্থায় যেতে হবে। সরকার চাহিদাপত্র দিলেই এর সমাধান হতে পারে।

পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ ইটভাটা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটি বন্ধের বিষয়ে সরকার কঠোর অবস্থানে রয়েছে। দেশে নতুন ইটভাটার ছাড়পত্র দেওয়া হবে না। ৩ হাজার ৪৯১টি ইটভাটার পরিবেশ ছাড়পত্র না থাকায় তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হবে। অন্যদিকে, জেলাগুলোতে অবৈধভাবে স্থাপিত ইটভাটাকে জনস্বার্থে অন্য স্থানে সরিয়ে নেওয়া হবে। তবে ব্লক ইট তৈরির কাজে প্রয়োজনে প্রণোদনা দেবে সরকার।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান আরও বলেন, “নতুন কোনো ইটভাটার অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে না। যেকোনো ফর্মেই হোক না কেন আমরা ইটভাটার অনুমোদন দিচ্ছি না। যে সমস্ত এলাকা থেকে ইটভাটার দূষণ নিয়ে অভিযোগ আসছে, আমরা সেইসব এলাকার ইটভাটা বন্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি।”

উপদেষ্টা বলেন, “জিগজ্যাগ ইটভাটাতে আপাতত আমরা কোনো অভিযান চালাচ্ছি না, কারণ অনেকেই জিগজ্যাগ ইটভাটায় ইনভেস্ট করেছে। আমরা এসব ইটভাটার মালিকদেরকে সতর্ক করে কমিটি গঠন করে দিয়েছি; যাতে তারা নিয়ম-নীতি মেনে ইট উৎপাদন করে। এলাকা এবং কমিটি যদি পরিদর্শন কালে কোনো অনিয়ম খুঁজে পায় তাহলে এসব ইটভাটা ভেঙে দেওয়া হবে।”

পরিবেশ দূষণে পলিথিনের ব্যবহার প্রসঙ্গে রিজওয়ানা হাসান বলেন, “গত ৩ নভেম্বর থেকে নিষিদ্ধ পলিথিন বা পলিপ্রপাইলিন শপিং ব্যাগের বিরুদ্ধে কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন শপিংমলে পলিথিন ব্যবহার বন্ধেও নানা কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।”

নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করতে ৩ নভেম্বর থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে পলিথিন উৎপাদন, বিক্রি, সরবরাহ ও বাজারজাত করার দায়ে ১২৪টি মোবাইল কোড অভিযান পরিচালনা করে ২৬৮টি প্রতিষ্ঠানকে ১২ লাখ ৫২ হাজার ১০০ টাকা জরিমানা আদায় এবং ২৬ হাজার ৮৭১ দশমিক ছয় কেজি পলিথিন জব্দ করা হয়েছে।

হর্ন জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি স্বরূপ এ কথা উল্লেখ করে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, “হর্নের আওয়াজ বন্ধ করাটা আমি জাতীয় কর্তব্য বলে মনে করি। কারণ এই হর্নের কারণে বহু মানুষ বধির হয়ে যাচ্ছে, তাদের শারীরিক অসুস্থতা বাড়ছে। কোনো মধ্যম আয়ের দেশে এ ধরনের কার্যক্রম মেনে নেওয়া যায় না।”

তিনি আরও বলেন, “জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এরই আওতায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় যানবাহনের হর্ন বাজানো নিষিদ্ধ করে এসব এলাকা হর্নমুক্ত এলাকা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।”

তিনি জানান, ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে রাজধানী ঢাকার ১০টি রাস্তা হর্নমুক্ত ঘোষণা করা হবে। পর্যায়ক্রমে সারাদেশে হর্নমুক্ত নীরব এলাকা ঘোষণা করা হবে।

পরিবেশ উপদেষ্টা আরও বলেন, যেমন করেই হোক, গাড়ির হর্ন বন্ধ করা হবে। চালক কিছু হওয়ার আগেই হর্ন দেয়। এ অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে।

একদিনে এই সমস্যার সমাধান হবে না। তবে একটু হলেও আশা জেগেছে যে সরকার অবস্থান নিচ্ছে। আগামী ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে হর্ন বন্ধ করার একটা ক্যাম্পেইন চালু করব আমরা, যোগ করেন তিনি।

তিনি বলেন, ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টে অভিজ্ঞ তরুণদেরকেও রাস্তায় হর্ন বন্ধ করার কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা হবে। হর্ন বন্ধ করতে জনসচেতনতার বিকল্প নেই। সবাই সচেতন হলে হর্নমুক্ত নীরব বাংলাদেশ করা সম্ভব হবে।

সৈয়দা রিজওয়ানা বলেন, এখন জনগণের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে কিন্তু আইনের ছোট্ট গ্যাপ থাকায় আমরা কিছু সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। আইনের এক জায়গায় বলা হয়েছে, নীরব এলাকায় হর্ন বাজানো যাবে না। কিন্তু নীরব এলাকায় হর্ন বাজালে কী শাস্তি হবে? ওই শাস্তির ধারায় গিয়ে এটাকে আবার ইনক্লুড করা হয়নি। এ আইন সংশোধন করে শাস্তি যুক্ত করতে হবে।

উপদেষ্টা বলেন, কিছু যানবাহন ব্রেক করে গতি নিয়ন্ত্রণ করে না। হর্ন বাজিয়ে চলে। হর্নের কারণে সড়ক দুর্ঘটনাও একটি বড় কারণ। সুতরাং হর্ন বন্ধ করলে সড়ক দুর্ঘটনাও কমতে পারে।

দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন নিয়ে পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, সেন্টমার্টিন ও পর্যটন শিল্পকে একসঙ্গে রক্ষা করতে বিভিন্ন উদ্যোগ ও পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার।

তিনি আরও বলেন, সেন্টমার্টিন নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ওই নরম ভূখণ্ডে কেউই কোনো সামরিক ঘাঁটি করতে পারবে না। এখন যারা সেন্টমার্টিন নিয়ে আন্দোলন করছেন তারা হলেন জাহাজ মালিক ও হোটেল মালিক। তারা ওখানকার স্থানীয় মানুষকে উসকে দিচ্ছে।

তিনি বলেন, এই যে পর্যটন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে বলা হচ্ছে তা কিন্তু একদিনের সিদ্ধান্ত নয়। বিভিন্ন সময়ে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলোই পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ সুরক্ষায় আমরা সীমিত পরিসরে বিধিনিষেধ আরোপ করছি। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে সেন্টমার্টিনে পর্যটন কার্যক্রম চলবে। কাজেই পর্যটন যে বন্ধ- এ কথাটা তো ঠিক নয়। মিথ্যা প্রচারণা।

রিজওয়ানা হাসান বলেন, জনসচেতনতা ও জীববৈচিত্র রক্ষায় সেন্টমার্টিনে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক মুক্ত করতে আমরা কাজ করছি। গত বছর সেন্টমার্টিন বন্ধ ছিল কিছু সময়। তখন তো কেউ প্রতিবাদ করেননি। এখন এমন কথা বলা হচ্ছে যে সেন্টমার্টিনে দুর্ভিক্ষ হবে। হীন ব্যক্তিস্বার্থে কেউ কেউ এসব বিভ্রান্তিকর কথা ছড়াচ্ছে। সেন্টমার্টিন নিয়ে কোনো বিভ্রান্তি নেই। এই বিভ্রান্তিগুলো রাজনৈতিক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, দেশের ৬৪ জেলায় ডিসিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল দুই মাসের মধ্যে অন্তত একটি নদী দূষণমুক্ত করতে হবে। তারা সময়ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা দেবে। ৪ নভেম্বর দুই মাস শেষ হয়েছে। এর মধ্যে কিছু জায়গার ডিসি পরিবর্তন হয়েছে। গত ১১ নভেম্বর পর্যন্ত আমরা ৬৩টি জেলার কর্মপরিকল্পনা পেয়েছি। শুধু রাঙ্গামাটি জেলার ডিসি জানিয়েছেন তাদের রাঙ্গামাটি জেলার নদীগুলো দূষিত নয়।

তিনি জানান, ঢাকাসহ সারাদেশের নদ-নদী ও খাল খনন ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানসহ দেশের কিছু জায়গায় নদী ও খাল খনন কার্যক্রম শুরু হয়েছে এবং তা চলমান রয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে শহরে যেকোনো একটা নদীকে দূষণমুক্ত করতে দেশের নদ ও নদী সমূহের দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে বিভিন্ন মেয়াদে কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। জনগণও নদী ও খাল খননে স্বেচ্ছাসেবক হয়ে কাজ করছে।

কপ২৯ সম্মেলন নিয়ে পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, “এ সম্মেলন নিয়ে আমাদের অবস্থানটা খুবই স্পষ্ট। বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব ব্যাংক অর্থ সাহায্য দেবে বলেছে। বাংলাদেশের থেকে এই সম্মেলনে বলা হয়েছে ১০০ বিলিয়ন ডলারের যে টার্গেটটা ছিল তা সম্পূর্ণ করতে। কারণ এ টার্গেট থেকে তারা এক চতুর্থাংশ ফান্ড দিয়েছে।”

জলাবদ্ধ ভবদহ নিয়ে তিনি বলেন, “২০০৫ সাল থেকে ভবদহ বিল নিয়ে কাজ করেছি। ২০২৪-এ এসে এখনো ভবদহ বিল নিয়ে কোনো সমস্যার সমাধান হয়নি। এটাকে জাতীয় দুর্যোগ ঘোষণা করা উচিত ছিল। এখানে আমরা চেষ্টা করছি আপাতত পানি কমিয়ে আনতে। সেখানকার মানুষকে বাঁচাতে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের মাইক্রোক্রেডিট রেগুলারিটি অথরিটির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা বলেছে, ওখানে ঋণ আদায় স্থগিত রাখবে। পরে এটি শিথিল করে দেওয়া হবে।”

তিনি বলেন, “জলাবদ্ধতায় থাকা মানুষদের ত্রাণ সামগ্রী বিতরণের জন্য বলা হয়েছে। সেখানকার সার্বিক পরিস্থিতি জানতে জুম মিটিং করব।”

উপদেষ্টা বলেন, “ভবদহের সমস্যার সমাধানে এবার শুধু পানি উন্নয়ন বোর্ডের দিকে তাকিয়ে থাকব না। বুয়েট, আহসানুল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়ে কমিটি গঠন করে দেওয়া হবে। প্রয়োজনে বিদেশ থেকেও বিশেষজ্ঞ এনে এর কারণ নির্ণয় করা হবে।”